(চতুর্থ পার্টি কংগ্রেস, ১৯৮৭-র রাজনৈতিক-সাংগঠনিক রিপোর্ট থেকে)

মধ্য বিহারে সাতটি জেলা জুড়ে আন্দোলন চলছে। জেলাগুলি হল : ভোজপুর, রোহতাস, পাটনা, গয়া, জাহানাবাদ, ঔরঙ্গাবাদ ও নালন্দা। আমাদের পার্টি এই আন্দোলনের প্রধান নেতৃত্বকারী শক্তি। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত ভোজপুর ও পাটনার বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে কৃষক আন্দোলনের এই পর্যায়টির আবির্ভাব ঘটে। ১৯৪৬-৪৯ সালে তেলেঙ্গানা ও ১৯৬৭-৭১ নকশালবাড়ি পর্যায়ের পরবর্তীতে এই হল তৃতীয় মাইলস্টোন।

বর্তমান কৃষক আন্দোলনের স্তর শুরু হয় ১৯৮০-র দশকের গোড়ার দিকে, পাটনার গ্রামাঞ্চলে। পরে তা দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে নালন্দা ও জাহানাবাদে। ভোজপুর, ঔরঙ্গাবাদ, রোহতাস ও গয়ার কিছু অঞ্চলে এক নতুন জাগরণ দেখা যায়। সরকার এর জবাব দিল ব্যাপক পুলিশী অভিযান চালিয়ে। কখনও কখনও এই অভিযানকে অপারেশন টাস্ক ফোর্স নামে অভিহিত করা হয়েছে। ব্যক্তিগত সেনা হিসাবে সমধিক পরিচিত জমিদারদের সশস্ত্র বাহিনীকে মদত দেওয়া, কিছু কিছু প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু করা, প্রচার মাধ্যমকে ও হরেকরকমের রাজনৈতিক পার্টিকে বিশেষত সিপিআই ও সর্বোদয় গোষ্ঠীগুলিকে তার সমর্থনে দাঁড় করানো, এইসব বহুমুখী উদ্যোগ নিয়ে সরকার এই আন্দোলনকে দমনের চেষ্টা করে। সরকারের এই সমস্ত পদক্ষেপের মুখে পড়ে এবং আমাদের নিজেদের কিছু কৌশলগত ভুলের কারণে কয়েকটি এলাকায় আমরা ধাক্কা খাই, কিছু ক্ষয়ক্ষতিও হয়। অন্য অনেক কাজের এলাকায় আমরা পিছু হটি, কিছু পুনর্বিন্যাসও ঘটাতে হয়। যদিও সামগ্রিকভাবে, এই সমস্ত পদক্ষেপগুলিকে মোকাবিলা করতে আমরা সফল হয়েছি। ব্যক্তিগত সেনাবাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করতে, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ন্যূনতম মাত্রায় সীমিত রাখতে, নিজেদের হাতে উদ্যোগ ধরে রাখতে আমরা সক্ষম হয়েছি।

মর্মবস্তুতে, এই আন্দোলন তিনটি ইস্যুকে কেন্দ্র করে এগিয়ে চলেছে :

(১) কৃষি শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, যারা হলেন এইসব এলাকার গ্রামীণ জনসংখ্যার ৩০-৪০ শতাংশ। সামন্ত প্রথা ও সস্তা শ্রমের কারণে জমি মালিকদের একটি ভালো অংশ মাঠে শ্রম দেয় না। অনিবার্যভাবেই, এই সংগ্রামের লক্ষ্যবস্তু বিস্তৃত হয়ে যায় এবং প্রতিক্রিয়াশীলদের কাছে তা জাতপাতের ভিত্তিতে লোকজনকে সামিল করানো ও ব্যক্তিগত সেনাবাহিনী গড়ে তোলার সুযোগ করে দেয়। সাধারণত ধর্মঘটকেই সংগ্রামের রূপ হিসাবে গ্রহণ করা হয় যা প্রায়শই সশস্ত্র সংঘর্ষের আকার নিয়ে নেয়। আমরা দৃঢ়তার সাথে ধর্মঘটকে বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে এবং সম্ভব হলে জেলার বেশ কয়েকটি ব্লকে ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। কৃষি শ্রমিকদের মধ্যে শ্রেণীচেতনা ও শ্রেণী সংহতির বিকাশ ঘটাতে এই কাজটা একান্ত প্রয়োজন এবং কমিউনিস্ট হিসাবে আমাদের প্রধান কর্তব্য হচ্ছে এই শ্রেণীকে সংগঠিত করা যারা গ্রামাঞ্চলের সর্বাপেক্ষা অগ্রণী বাহিনী হিসাবে রয়েছে। উদারনৈতিক চিন্তাপদ্ধতি তথাকথিত ব্যাপক কৃষক ঐক্যের নামে এই ধরনের সংগ্রামকে এড়িয়ে যায়। এর বিপরীতে বাস্তব অনুশীলনে দেখা যায় যে ব্যাপক অঞ্চল জুড়ে ধর্মঘট সংগ্রাম সংগঠিত করতে পারলে তা জমিদারদের প্রগতিশীল জোটকে ভেঙে দিতে পারে এবং মধ্যবর্তী স্তরের সাথে সমঝোতা সহজতর করে।

(২) জমিদার, মহান্ত ও ধনী কৃষকদের দখলে থাকা উদ্বৃত্ত জমি, খাস জমি ও বসত জমিকে দখল করে ভূমিহীন ও গরিব কৃষকদের মধ্যে বিলিবণ্টন করা। এই সংগ্রামে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু যথাসম্ভব মুষ্টিমেয় কয়েকজনের বিরুদ্ধেই পরিচালিত করা হয়। সাধারণত, খাস জমি আছে এমন মধ্য কৃষকদের ছাড় দেওয়া হয়। ধনী কৃষকদের ক্ষেত্রে বুঝিয়ে বলা ও চাপ সৃষ্টি করার পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। জমি বণ্টনের সময় জনগণকে সামিল করা ও ঐক্যবদ্ধ রাখার প্রচেষ্টা থাকে। জমি, শস্য ও পুকুর দখল করা এবং খাল বা নদীতে মাছ ধরার অধিকার আদায় করার সংগ্রামগুলি প্রায়শই সশস্ত্র সংঘর্ষের দিকে চলে যায়।

জমি দখল ও বণ্টন, পাট্টার অধিকার অর্জন করা, উৎপাদন সংগঠিত করা এবং পরিশেষে জনগণের মধ্যে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের হাত থেকে অর্জিত সাফল্যগুলি সুরক্ষিত করা – এই সমগ্র প্রক্রিয়ায় সংগ্রাম কোনো একটি স্তরের পরে সাধারণত আটকে যায়। এ ব্যাপারে সাফল্যের তুলনায় ব্যর্থতার ঘটনা বোধহয় বেশি। সাম্প্রতিককালে, কাজের সঠিক পথনির্দেশ সূত্রবদ্ধ করা এবং আরও কঠোরভাবে তা প্রয়োগে নিয়ে যাওয়ার ফলে অবস্থার ক্রমশ উন্নতি হচ্ছে বলে মনে হয়।

(৩) দলিত ও পশ্চাদপদ জাতিগুলির সামাজিক মর্যাদার আন্দোলন। এই সংগ্রাম সামন্ত কর্তৃত্বের মূলে আঘাত করায় যথেষ্ট তীব্রতা অর্জন করে, “বাবুসাহেব, বাভন ও বাবাজী” উচ্চবর্ণের এই সমগ্র স্তর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়ে পড়ে। অপরদিকে, পশ্চাৎপদ জাতের প্রায় সমস্ত শ্রেণীই এই ধরনের সংগ্রামকে সমর্থন করে। অবশ্য উভয় তরফ থেকে সবসময় কিছু না কিছু ব্যতিক্রম দেখা যায়। সাধারণত প্রত্যেকটি গ্রামে উঁচু জাতের ছোটো একটি প্রগতিশীল অংশ এই সংগ্রামে সহযোগিতা করে, আবার পশ্চাৎপদ জাতের কিছু অংশ উঁচু জাতের প্রতিক্রিয়াশীলদের সাথে হাত মিলিয়ে বসে। বেশ কয়েক বছর ধরে গড়ে ওঠা এই আন্দোলনের প্রভাবে কয়েকটি অঞ্চলের উঁচু জাতের কিছু অংশ তাদের সনাতন মনোভাবের পরিবর্তন ঘটাতে শুরু করেছে।

জনগণের মধ্যে শ্রেণীর ভিত্তিতে বড় ধরনের মেরুকরণ ঘটানোর লক্ষ্যে এবং গ্রামীণ জনসংখ্যার ব্যাপক অংশকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য আমরা বেশ কিছু অন্যান্য প্রাসঙ্গিক ইস্যুকেও হাতে নেওয়ার চেষ্টা করছি। ইস্যুগুলি হল, প্রজাসত্ব রেকর্ডভুক্ত করা, ব্লক কর্তৃপক্ষের দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনগণকে সামিল করানো প্রভৃতি। দুর্নীতির প্রশ্ন কৃষির বিকাশের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েছে, কারণ স্থানীয় প্রতিক্রিয়াশীলদের যোগসাজশে ব্লক কর্তৃপক্ষ সুযোগ-সুবিধার সিংহভাগই আত্মসাৎ করে ফেলে। এছাড়া ব্যাপক গ্রামীণ জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য ডাকাত দলকে শায়েস্তা করা, কিছু কিছু গ্রাম উন্নয়নের কাজ হাতে নেওয়া, রিলিফ দেওয়া, প্রভৃতি পদক্ষেপগুলি নেওয়া হয়।

আমরা মনে করি যে, এই সমস্ত ইস্যুতে সংগ্রাম ও বিভিন্ন উদ্যোগের এক অবিচ্ছেদ্য কর্মসূচিই কেবল কৃষি-শ্রমিক ও দরিদ্র কৃষকদের নেতৃত্বে ব্যাপক কৃষক ঐক্য গড়ে তুলতে পারে। রঙ-বেরঙের সুবিধাবাদীরা অনেক সময় আমাদের অভিযুক্ত করেন যে আমরা নাকি ব্যাপক কৃষক ঐক্যে ফাটল ধরাচ্ছি ও কৃষি-শ্রমিকদের দাঁড় করাচ্ছি কৃষকদের বিরুদ্ধে। কৃষি-শ্রমিক ও গরিব কৃষকদের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিলে এবং গণসংগ্রামে সামিল করাতে অস্বীকার করলে তাদের শ্রেণী চেতনা ও শ্রেণী সংহতি কখনই বাড়িয়ে তোলা যায় না। কৃষক আন্দোলনের ওপর তাদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠাও হয় না। স্বাভাবিকভাবেই, তথাকথিত ব্যাপক কৃষক ঐক্য নিছকই ধনী কৃষকের অধীনে কৃষক ঐক্যে পর্যবসিত হয়। এর মাঝামাঝি অন্য কোনো পথ নেই।

আমরা এখনও এটা দাবি করতে পারি না যে শ্রেণী ও জাতপাতের ভারসাম্যকে আমাদের অনুকূলে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি, তবে সম্পূর্ণ নতুন ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আমরা অভিষ্ট ঐক্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। কয়েকটি অঞ্চলে, মধ্য কৃষক ও উঁচু জাতের মধ্যবর্তী স্তর কিষাণ সভার পতাকাতলে সামিল হচ্ছে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন যে এই অঞ্চলে পার্টির সংহতকরণ অভিযান খুবই নিষ্ঠার সাথে ও কার্যকরীভাবে পরিচালনা করা হয়েছিল। পার্টি গঠনের কাজকে অবহেলা করা, (বিশেষত আন্দোলন যখন তুঙ্গে ওঠে) আমাদের পার্টির ইতিহাসে এক সাধারণ দুর্বলতা হিসাবে থেকেছে। বহু অঞ্চলে দীর্ঘকালীন ধাক্কার পিছনে এটাই প্রধান কারণ। আন্দোলন চলাকালীন যে নেতিবাচক ঝোঁকগুলি সামনে চলে আসে তাকে প্রতিহত করা, সঠিক কর্মনীতির সূত্রায়ন ও তার রূপায়ন, আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে শ’য়ে শ’য়ে এগিয়ে আসা কর্মীবাহিনীর রূপান্তর সাধন ঘটিয়ে পার্টির স্থায়ী সম্পদ হিসাবে গড়ে তোলা, আন্দোলনকে অব্যাহত রাখা ও ক্রমান্বয়ে উচ্চতর স্তরে উন্নীত করা – এই সমস্ত কাজগুলি সম্পাদনের জন্য পার্টিকে মজবুত করা একান্তভাবেই প্রয়োজন।

চিন্তার এমন এক ধারা আছে যা সচেতন প্রচেষ্টার গুরুত্বকে এই অজুহাতে খাটো করে দেখায় যে জনগণের স্বাধীন উদ্যোগ এর দরুণ মার খাবে। বাস্তবে সচেতন উদ্যোগের বাড়াবাড়ির জন্য নয়, বরং তার ঘাটতির জন্যই সংগ্রাম বিপথগামী হয়, সংকীর্ণ কৃষক মানসিকতা জোরদার হয়ে ওঠে, যোদ্ধারা ডাকাতদলে অধঃপতিত হয়, ছোটোখাটো কিছু অনর্থক সংঘর্ষের মধ্যে তা আটকে যায় এবং শেষপর্যন্ত জনগণের স্বাধীন উদ্যোগের দ্বার রুদ্ধ হয়ে যায়। ঔরঙ্গাবাদের কয়েকটি এলাকায় জাতপাতের শক্তিক্ষয়ী যুদ্ধে এমসিসি-র প্রশ্রয় এবং জাহানাবাদের কয়েকটি এলাকায় সিওসি(পি ইউ)-র কার্যকলাপ এটিই প্রমাণ করে। পাটনা, নালন্দা ও জাহানাবাদের কিছু কিছু জায়গায় আমাদেরও একই অভিজ্ঞতা হয়েছে। সৌভাগ্যবশত আমাদের পার্টি সংগঠন এই ধরনের নেতিবাচক প্রবণতাগুলিকে প্রধানত কাটিয়ে তুলেছে এবং পার্টির কাজ এখন অনেক বেশি যুক্তিসঙ্গতভাবে সংগঠিত হচ্ছে। আর এই প্রশ্নে একান্ত প্রয়োজনীয় অগ্রগতি শুরু হয়েছে পার্টির সংহতকরণ অভিযানের মধ্য দিয়েই।

গত কয়েক বছরের অনুশীলনের ভিতর দিয়ে আন্দোলন থেকে বহু কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক উঠে এসেছে। এগুলিকে সারা অঞ্চল জুড়ে জনপ্রিয় করা হচ্ছে এবং সমগ্র কাজটি পুনর্বিন্যাস করা হচ্ছে। এখন আমরা এই পরিবর্তন ও বিকাশগুলিকে এই অধ্যায়ে আলোচনা করব।

গ্রাম কমিটির গঠন সম্পর্কে

আমরা লক্ষ্য করি যে ভোজপুরের কোনো একটি গ্রামে স্থানীয় কমরেডরা গ্রাম কমিটি গঠনের জন্য যে পদ্ধতি নিয়েছেন তা কিষাণসভার এযাবৎ অনুসৃত আনুষ্ঠানিক পদ্ধতির থেকে আলাদা। গ্রামটি সংগ্রামের এক স্থানীয় কেন্দ্র এবং গ্রাম কমিটি গঠনের সময় নতুন এক অগ্রণী ধারণা নিয়ে আসা হয়। তারা গ্রাম কমিটি গঠনের কাজটিকে জনগণের উৎসবে পরিণত করার শপথ নেন এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে তাদের নিজস্ব কমিটিকে নির্বাচিত করার জন্য তারা জনগণকে ধাপে ধাপে সামিল করেন। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখেছি যে আন্দোলনের জোয়ারের সময় সমস্ত ধরনের কার্যকলাপ চালানোর জন্য জনগণ নিজেদের গ্রাম কমিটিকে কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলেন। কিন্তু বিপরীতে, কিষাণসভার দিক থেকে তারই সর্বনিম্ন ইউনিট হিসাবে এই গ্রাম কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া খুবই গৎবাঁধা ও আনুষ্ঠানিক এক ব্যাপার হয়ে উঠেছিল। বহুক্ষেত্রে, গ্রাম কমিটিগুলি শ্রেণীসংগ্রাম ত্যাগ করে, কিষাণসভা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিছক এক গ্রামোন্নয়ন সংস্থায় পরিণত হয়ে পড়ে। ভোজপুরের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে পার্টি গ্রাম কমিটির ধারণাকে আরও সমৃদ্ধ করে। এরপর থেকে নীচুতলায় জনগণের উদ্যোগ উন্মুক্ত করার চাবিকাঠি হিসাবে, তাদের গণতান্ত্রিক চেতনা উন্নত করার এক জীবন্ত মাধ্যম হিসাবে এবং তাদের বিষয়ীগত চেতনায় বিপ্লবী গণতন্ত্রের ধারণা একাত্ম করার জন্য গ্রাম কমিটির উপর গুরুত্ব আরোপিত করা শুরু হয়। কৃষকদের জঙ্গী আন্দোলন অথবা সাধারণ রাজনৈতিক সমাবেশগুলি ব্যাপক জনগণের চেতনার বিপ্লবীকরণের সমস্যার সমাধান করতে পারে না, যে চেতনা আনুষ্ঠানিক গণতন্ত্রসর্বস্ব বুর্জোয়া প্রতিষ্ঠানগুলির নিষ্ফলতা সম্পর্কে সজাগ করতে পারে। শ্রেণী সংগ্রামের বিকাশের উপর ভিত্তিশীল গ্রাম কমিটি যখন আন্তরিকভাবেই গণতান্ত্রিক রীতিনীতি অনুসরণ করে চলে তখন তা নির্দিষ্টভাবেই জনগণকে আমাদের গণতন্ত্রের সাথে তাদের গণতন্ত্রের ফারাক টানতে শেখায়।

পকেট গড়ে তোলা সম্পর্কে

সংগঠকদের ভ্রাম্যমান কাজের ধারার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালানোর জন্য এবং নীচুতলায় পার্টি কাঠামোকে মজবুত করার লক্ষ্যেই পকেট-এর ধারণা নিয়ে আসা হয়। প্রত্যেক সংগঠককে সংশ্লিষ্ট পার্টি কমিটির তরফ থেকে ১০-১৫টি গ্রামের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেখানে একটি পার্টি ইউনিট ও তাকে ঘিরে এক পুরোদস্তুর সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তোলার নির্দেশ দেওয়া হয়, যাতে এমনকি শ্বেতসন্ত্রাসের সময়েও তিনি তাঁর পকেটে থাকতে পারেন, সেখানকার জনগণের সাথে সম্পর্ক রেখে চলতে পারেন এবং প্রতিবাদী কার্যকলাপে তাদের সংগঠিত করতে পারেন। কেবলমাত্র পার্টি কমিটির নির্দেশ অনুসারে তিনি তাঁর অঞ্চল থেকে উঠে যেতে পারবেন। এই ধারণা সংগঠকদের কাজকর্মে আরও নিষ্ঠা যুগিয়েছে এবং এমন অনেক সংগঠক কমরেড এগিয়ে আসেন যাঁরা তার আগে পর্যন্ত পার্টি সংগঠনের প্রান্তসীমায় থেকে যাচ্ছিলেন। এই ধারণা তাঁদের পরিকল্পনা রচনা ও কাজকর্মকে আরও ভালোভাবে সংগঠিত করতে সাহায্য করেছে। পকেটগুলিকে নিয়মিতভাবে মূল্যায়ন করা ও সেইমতো শ্রেণীবিন্যাস করা হচ্ছে। পকেটের সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে আন্তরিক ও সফল প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন এমন সংগঠকদের সংখ্যা এবং কয়েকটি পকেটে ইতিমধ্যেই শক্তিশালী পার্টি ইউনিট গড়ে উঠেছে।

কৃষক সমিতিকে পুনর্গঠিত করা সম্পর্কে

কৃষক সমিতিকে ব্লক স্তরে সংগঠিত করার উপর জোর দেওয়া হয়েছে, প্রথমে ৩০-৪০টি গ্রামে কাজ কেন্দ্রীভূত করা, তারপরে ক্রমান্বয়ে ব্লকের বাকি অংশে কাজ সম্প্রসারিত করার কর্মপদ্ধতি স্থির করা হয়েছে। এলাকাভিত্তিক কৃষক সমিতিকেই সবচেয়ে নির্মম দমন-পীড়নের মুখে পড়তে হয়। তাই নেতৃত্বের মধ্যে কিছু পুনর্বিন্যাস ঘটানো প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। শত্রুর কাছে সব নেতাদের প্রকাশ করে দেওয়া কোনো বিচক্ষণ কর্মনীতি নয়। সুতরাং, তাদের আধা-গোপন পদ্ধতিতে কাজ করার বিষয় রপ্ত করতে হবে। অপরদিকে, তাদের ব্যাপক পরিমাণে সভ্য সংগ্রহের অভিযানে নামতে, নিজেদের সম্মেলনের সময়ে জনগণকে বিশাল সংখ্যায় সমাবেশিত করতে এবং ব্লক অফিসের কার্যকলাপে আরও বেশি মাত্রায় হস্তক্ষেপ ঘটাতে বলা হয়েছে যাতে প্রশাসন কর্তৃক গৃহীত হরেকরকম সংস্কারমূলক পদক্ষেপগুলির আসল চরিত্র উদ্ঘাটন করা যায়।

কয়েকটি এলাকায় কৃষক সমিতি ভাগচাষি ও মধ্য কৃষকদের নিয়ে সম্মেলন সংগঠিত করেছে। কোনো কোনো জায়গায়, তাঁরা বিভিন্ন গ্রামের সাধারণ কৃষক প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক সংগঠিত করেছেন, যাতে সরাসরি তাঁদের দাবিগুলি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া যায়। আজকাল বহু জায়গায় তাঁরা শ’য়ে শ’য়ে হাজারে হাজারে কৃষকদের নিয়ে ব্লক অফিসগুলিতে চড়াও হন। সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কৈফিয়ত দাবি করেন, ত্রাণ ও সংস্কারের জন্য সরকারি অফিসারদের ক্যাম্পগুলিকে গরিব পাড়ায় স্থানান্তরিত করতে বাধ্য করেন এবং জনগণের দাবির প্রতিনিধিত্ব করেন। তাদের স্লোগান হল : সবকিছুই কৃষক সমিতির মাধ্যমে করতে হবে। ছিটেফোঁটা সংস্কার কর্মসূচির মারফৎ সংগঠনকে দুর্বল করার সরকারি চক্রান্ত বানচাল করতে এই কৌশল সহায়ক হয়ে উঠেছে।

গ্রামরক্ষীদল সংগঠিত করা সম্পর্কে

পূর্ববর্তী পর্যায়গুলির তুলনায় আজকের দিনে এই দিকটির উপর বেশি নজর দেওয়া হচ্ছে। কয়েকটি এলাকায় ব্যাপক সংখ্যক যুবকদের এই দলগুলিতে সংগঠিত করা হচ্ছে। বর্শা হাতে নিয়ে তাদের মূর্তি দেখলে শত্রুর বুকে সৃষ্টি হয় আতঙ্ক। এরাই হলেন সেই শক্তি যাঁরা প্রতিরোধ সংগ্রামের সময়, কৃষক নেতাদের বিপদের হাত থেকে উদ্ধার করার ক্ষেত্রে এবং মিছিল সংগঠিত করা ও রক্ষা করার ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকেন। গ্রাম কমিটির পরিচালনাধীনেই এই গ্রামরক্ষী বাহিনী তার কার্যকলাপ চালায়।

নীচুতলার সংগঠনের এই রূপগুলি পার্টির সংহতকরণ অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে আরও গুরুত্ব ও স্পষ্টতা নিয়েই গড়ে তোলা হচ্ছে। ভোজপুরের চারপোখরী, নালন্দার ইসলামপুর এবং ঔরঙ্গাবাদের দাউদনগর হল এই তিনটি এলাকা, যেখানে এ পর্যন্ত আলোচিত কাজের সমস্ত দিকগুলিকে ভালো পরিমাণে মেলানো হয়েছে। আমাদের কাজের অনেকগুলি পুরোনো অঞ্চলে এই সমস্ত বিষয়ের বেশ কিছু রূপায়িত হয়েছে এবং রোহতাস ও গয়া জেলায় অনেক নতুন কাজের পয়েন্ট গড়ে উঠেছে। নালন্দা ও ঔরঙ্গাবাদ জেলায় পার্টি কাঠামো দীর্ঘদিন ধরে খুবই দুর্বল অবস্থায় ছিল। বর্তমানে জেলা পার্টি কমিটি ও সমগ্র পার্টি কাঠামোর অবস্থা অনেক উন্নত হয়েছে।

জনগণের সশস্ত্র শক্তি সম্পর্কে

এটা হয়তো সব কমরেডদের জানা নেই যে ১৯৭৫-এর শেষদিকে ভোজপুরের সাহারে আমাদের একটি মাত্র সশস্ত্র ইউনিট অবশিষ্ট ছিল। এমনকি তার মধ্যেও ভ্রাম্যমানতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল এবং রাজনৈতিক কমিশারের পক্ষেও তা নিয়ন্ত্রণ করা রীতিমতো কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে, ১৯৭৬-এর শেষে স্কোয়াড সদস্যদের বিকেন্দ্রীভূত করে ব্যক্তিগতভাবে তাদের সংগঠন গড়ে তোলার দায়িত্ব দেওয়া হয়। একটি নতুন কাজের অঞ্চলে কমরেড জিয়ুতকে ঘিরে তখন আরেকটি সশস্ত্র ইউনিট সবেমাত্র গড়ে উঠেছিল। পাটনাতেও একটিমাত্র সশস্ত্র ইউনিট অবশিষ্ট ছিল এবং সেটিও ভেঙ্গে পড়ার মুখে এসে দাঁড়িয়েছিল। বেশিরভাগ নেতা ও ক্যাডার তখন হয় নিহত অথবা গ্রেপ্তার হয়ে গেছেন। আমাদের পুরোনো কাজের সমস্ত অঞ্চল জুড়েই তখন চলছিল শ্বেতসন্ত্রাস। জনগণ হতোদ্যম অবস্থায় ছিলেন। যে সংগঠক কমরেডরা টিকে ছিলেন, তাঁরা ঐ প্রতিকূল অবস্থা তুচ্ছ করে কাজকর্ম এগিয়ে নিয়ে যান, জ্বালিয়ে রাখেন সংগ্রামের অনির্বাণ শিখা। ১৯৭৭ সালে শুদ্ধিকরণ আন্দোলন ও ১৯৭৯-তে বিশেষ সম্মেলনে রাজনৈতিক লাইনের বিরাট পরিবর্তন ছাড়া আজকের এই কৃষক আন্দোলন বা সশস্ত্র সংগ্রাম সম্ভব হত না। নতুন উদ্দীপনা নিয়ে সশস্ত্র এ্যাকশনগুলি ১৯৭৭ সাল থেকে ফের শুরু হয়। সশস্ত্র ইউনিট ও আগ্নেয়াস্ত্রের দিক থেকে, সশস্ত্র অভিযানের মাত্রার দিক থেকে আমরা আগেকার স্তরকে অনেক ছাড়িয়ে গেছি। সেদিনের বিপ্লবী কমিটির তুলনায় আজকের গ্রাম কমিটি অনেক বেশি কর্তৃত্ব চালাতে পারে এবং সেদিনের লাল অঞ্চলের তুলনায় আজকের লাল এলাকা অনেক বেশি লাল। বাস্তব জীবনে আজকের এই অগ্রগতি ঘটেছে ধারণার পশ্চাদপসরণ ঘটিয়ে, আর অতীতে ধারণার ক্ষেত্রে অগ্রগতি বাস্তব জীবনে পশ্চাদপসরণই নিয়ে আসে।

তবুও, আমরা মনে করি যে বিহারের বিপ্লবী কৃষক সংগ্রাম এখনও তার প্রাথমিক স্তরে রয়েছে। এর অর্থ হল, শ্রেণীশক্তির ভারসাম্যকে পাল্টানোর জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ অতিক্রম করতে হবে। আমাদের সশস্ত্র ইউনিটগুলিকে সংরক্ষিত করতে হবে, সঞ্চয় করতে হবে শক্তি এবং ধাপে ধাপে সম্প্রসারণ ঘটিয়ে সংগ্রামকে উন্নতস্তরে উন্নীত করতে হবে।

এই বাস্তবতা আমাদের সশস্ত্র শক্তির বর্তমান অবস্থা নির্ধারণ করে দিচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে আমরা যত বেশি সংখ্যায় সম্ভব নিয়মিত সশস্ত্র ইউনিট গড়ে তোলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছিলাম। আমাদের অভিজ্ঞতা দেখায় যে, অনেক লড়াকু লোকজন এই ইউনিটগুলিতে যোগ দিলেও তারাই শেষপর্যন্ত টিকে যান যাদের পরবর্তীকালে পার্টি ক্যাডার হিসাবে গড়ে তোলা গিয়েছিল। আমাদের সমস্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও নিয়মিত ও স্থায়ী সশস্ত্র ইউনিটের বিকাশ খুবই মন্থরগতিতে চলেছিল।

এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, আমরা এলাকাভিত্তিক স্কোয়াড গড়ে তোলার ওপর জোর দিই। নতুন পরিস্থিতি অনুসারে এই স্কোয়াডগুলির নির্দিষ্ট কাজ আমরা সূত্রায়িত করতে না পারায় ঐ লক্ষ্যে বিশেষ অগ্রগতি ঘটানো যায়নি। খতমের জন্য এবং খতমের মধ্যে দিয়েই স্কোয়াড গড়ে তোলা – স্কোয়াড গঠনের আগেকার এই প্রক্রিয়াকে আমরা নিরুৎসাহিত করে এসেছি। এরপর সশস্ত্র প্রচার স্কোয়াডের ধারণা নির্দিষ্ট করা হয় এবং এলাকাভিত্তিক সশস্ত্র স্কোয়াডগুলিকে নিয়মিত সশস্ত্র ইউনিট ও গ্রামরক্ষী বাহিনীর মধ্যকার যোগসূত্র হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়। এলাকা হিসাবে ১৫-২০টি গ্রাম নির্দিষ্ট করা হয়, যেখানে প্রত্যেক মাসে এই স্কোয়াডগুলি একটা নির্ধারিত সময়ের জন্য মার্চ করবে। নিয়মিত সশস্ত্র ইউনিটে স্থায়ীভাবে থাকতে পারছেন না এমন বহু যোদ্ধাকে এই স্কোয়াডগুলিতে সামিল করানো হয়। নিয়মিত ইউনিট এই স্কোয়াডগুলির সাথে যোগাযোগ রেখে চলে। প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের সশস্ত্র কার্যকলাপে সামিল করানো হয়। তারা স্থানীয় প্রতিক্রিয়াশীলদের শায়েস্তা করে থাকে, নিজেদের উদ্যোগে আগ্নেয়াস্ত্রও তারা দখল করে। তারা গ্রামের সাধারণ যুবকদেরও গ্রামরক্ষী বাহিনীতে সংগঠিত করে।

আমরা মনে করি যে, সশস্ত্র সংগ্রামের বর্তমান পর্যায়ে, এই সশস্ত্র প্রচার স্কোয়াডের উপরই প্রধান জোর দেওয়া উচিত। এগুলি নিয়মিত সশস্ত্র ইউনিটের প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো হিসাবে কাজ করে। ভবিষ্যতে এই স্কোয়াডগুলি থেকে ব্যাপক পরিমাণে শক্তি নিয়োগ করে নিয়মিত সশস্ত্র ইউনিট গড়ে উঠতে পারে।

গত কয়েক বছরে কৈথী (ঔরঙ্গাবাদ), বুনাই (ভোজপুর), গঙ্গাবিঘায় (নালন্দা) আমাদের নিয়মিত সশস্ত্র ইউনিট কিছু বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। সমস্ত ঘটনাগুলিকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে সংশ্লিষ্ট গ্রামগুলির মধ্যে এমন কিছু চর ছিল জমিদারদের কাছে যারা খবর পাচার করে দিত এবং সেখান থেকে তা যেত পুলিশের কাছে। আমরা এই চরদের গতিবিধি সম্পর্কে অন্ধকারে ছিলাম। আমাদের সশস্ত্র ইউনিটের নিরাপত্তা সংক্রান্ত সমগ্র ধারণা এখানেই ঘুরপাক খেত যে জমিদার ও চিহ্নিত চরদের সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে এবং সারা রাত ধরে টহল দিতে হবে।

এই ঘটনাগুলির পরে, প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে চরদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। কিন্তু এই ধরনের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি শত্রুর গোয়েন্দাদের সমস্ত জালকে (Net Work) নির্মূল করতে পারেনি এবং তা করতেও পারে না। শ্রেণীসংগ্রাম খুবই জটিল এক প্রক্রিয়া আর আমাদের গ্রামগুলি থেকে তাদের এজেন্ট নিয়োগ করার ব্যাপারে শত্রু যথেষ্ট পারদর্শী। আমাদের বড় ধরনের পাল্টা আক্রমণের মুখে পড়ে শত্রুর জাল প্রায়শই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু তারা তাকে আরও ধূর্ত ও সূক্ষ্ম কায়দায় আবার গড়ে তোলে।

আধুনিক যুদ্ধের কলাকৌশলের কাছে আমাদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত ধারণা ছিল খুবই সাদামাটা ও সেকেলে। আমরা এখন আমাদের গোয়েন্দা ব্যবস্থা গড়ে তোলার উপর জোর দিচ্ছি। শত্রুর শিবিরের মধ্যে থেকে যোগাযোগ গড়ে তুলতে হবে এবং খবরাখবর সংগ্রহের নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত লোকজনদের নিয়োগ করতে হবে। এমনকি আজকের এই স্তরে, নিয়মিত সশস্ত্র ইউনিট ও সুব্যবস্থিত স্থানীয় স্কোয়াড ছাড়াও একটি পূর্ণাঙ্গ সশস্ত্র সংগঠনের যা যা থাকা দরকার তা হল : তার নিজস্ব গোয়েন্দা বাহিনী (Net Work), আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি করা ও তার যন্ত্রাংশ সংগ্রহ করার উপায়, চিকিৎসা শাখা এবং স্কাউট সেবাদল বাহিনী। এই ধরনের এক পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থাই সশস্ত্র ইউনিটগুলির গতিবিধিকে অবাধ করে তুলতে সাহায্য করবে এবং কেবল তাহলেই তাদের কার্যকলাপে তারা পর্যাপ্ত উদ্যোগ নিতে পারবেন। আমরা মনে করি যে এই অঞ্চলগুলিতে জেলা পার্টি কমিটির তরফ থেকে জেলা স্তরের একজন করে যোগ্য কমরেডকে এই ব্যবস্থা গড়ে তোলার ব্যাপারে দায়িত্বশীল হিসাবে রাখতে হবে। সশস্ত্র ইউনিট ও সশস্ত্র সংগ্রাম খেলার জিনিস নয়, তাই এ সম্পর্কে কোনো ধরনের দায়সারা মনোভাব থাকা অনুচিত।

এই স্তরের সংগ্রামে নিয়মিত সশস্ত্র ইউনিটগুলিকে ক্ষমতাবান জমিদারদের গুণ্ডাবাহিনীর বিরুদ্ধে এমন কিছু সশস্ত্র হামলা সংগঠিত করতে হবে যা নির্ধারক হয়ে উঠবে। তাদের কাজ হল পুলিশী দমন-পীড়ন থেকে জনগণকে রক্ষা করা এবং দোষী পুলিশ অফিসারদের যথাযথ শাস্তি প্রদান করা।

উপসংহারে আমি বলতে চাই যে :

এই প্রথম ভারতের কমিউনিস্টরা এত দীর্ঘ পর্যায় ধরে কৃষক সংগ্রামকে সফলতার সাথে অব্যাহত রেখেছেন, ক্রমাগত সম্প্রসারিত করে চলেছেন তার সীমান্ত।

এই প্রথম ভারতের কমিউনিস্টরা সংগ্রামের সমস্ত রূপ হাতে তুলে নিয়েছেন। আইনি ও বেআইনি, সংসদ বহির্ভূত ও সংসদীয়, সশস্ত্র কার্যকলাপ ও গণসংগ্রাম, এবং এগুলির মধ্যে একটির জন্য অপরটিকে জলাঞ্জলি দেওয়ার পরিবর্তে, সমস্ত রূপগুলির মেলবন্ধন ঘটাতে ঐকান্তিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।

এই প্রথম ভারতের কমিউনিস্টরা জাতপাত ও শ্রেণীসংগ্রামের এই দ্বৈত সমস্যাকে মোকাবিলা করার চেষ্টা চালিয়েছেন, জাতপাতভিত্তিক নিপীড়নের উপর জোরালো আঘাত হেনেছেন। একইসাথে, কৃষিশ্রমিক, গরিব ও মধ্য কৃষকদের শ্রেণীগত দাবিতে ঐক্যবদ্ধ করার সাথে সাথে দলিত সম্প্রদায়কে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সাহায্য করেছেন।

এই প্রথম অগণিত নেতা ও ক্যাডার উঠে এসেছেন গ্রামীণ দরিদ্র জনতার মধ্য থেকে এবং এঁরাই হলেন আমাদের পার্টির মেরুদণ্ড শক্তি। সমস্ত ফ্রন্টে তাঁরাই কাজকর্ম ও সংগ্রাম পরিচালনা করে থাকেন। জাতীয়স্তরের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলীতে দরিদ্র গ্রামীণ জনতার ব্যাপক অংশকে প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক সংগ্রামে সামিল করানো হয়েছে।

আর, শাসকশ্রেণীগুলির সমস্ত ধরনের চালাকি সত্ত্বেও, বিলোপপন্থী ও আধা নৈরাজ্যবাদীদের সমস্ত ধরনের বিশৃঙ্খল কার্যকলাপ সত্ত্বেও, ক্ষয়ক্ষতির অনেক টানাপোড়েন সত্ত্বেও, এই প্রথম ভারতের কমিউনিস্টরা সেই পার্টি সংগঠনের অটুট ঐক্য ধরে রেখেছেন, যে সংগঠন আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা আমাদের লাইন ও কর্মনীতির আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছি। গুরুতর মতপার্থক্য ও বিতর্ক হয়েছিল আমাদের মধ্যে, কিন্তু আমরা বরাবরই কঠোর শৃঙ্খলার মনোভাব নিয়ে কদম বাড়িয়েছি একসাথে।