(কমরেড মদন ভাণ্ডারীর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্চলি। লিবারেশন, জুন ১৯৯৩ থেকে)

১৭ মে ভোরে আমি ছিলাম পাটনায়। কয়েকজন কমরেড ছুটে এসে আমাকে দেখালেন সংবাদপত্রের একটি ছোটো রিপোর্ট – কমরেড মদন ভাণ্ডারী ও জীবরাজ আশ্রিত জীপ দুর্ঘটনায় পড়েছেন। ফোনে খবর নিয়ে জানলাম, কমরেড ভাণ্ডারীর দেহ তখনও পাওয়া যায়নি। অনেক আশঙ্কা আর একটু আশা বুকে নিয়ে আমি রওনা দিলাম বেনারসে।

কিন্তু ১৯ তারিখে যে খবর পেলাম, সব আশা তাতে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। পার্টির একটি বৈঠক অসমাপ্ত রেখে আমি কাঠমাণ্ডুর বিমান ধরলাম ২০ মে। সেখানে বিমানবন্দরের চত্বরে সিপিএন(ইউএমএল) নেতারা আমাকে দুর্ঘটনার রহস্যজনক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করান। কাঠমাণ্ডু থেকে আমি সোজা চলে যাই দশরথ রঙ্গশালায় নেপালের সমসাময়িক কমিউনিস্ট আন্দোলনের দুই মহান নেতার প্রতি অন্তিম শ্রদ্ধা নিবেদন করতে। সেখানে তখনও দুচোখে জল নিয়ে কাতারে কাতারে মানুষ প্রয়াত নেতাদের শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে যাচ্ছেন। দুটি শোকসন্তপ্ত পরিবারের সঙ্গেও আমি দেখা করি।

মাত্র কয়েক মাস আগেই আমি কাঠমাণ্ডু এসেছিলাম সিপিএন(ইউএমএল)-এর পার্টি কংগ্রেসে যোগ দিতে। কংগ্রেস শেষ হওয়ার মুখে আমি কাঠমাণ্ডু ছেড়ে চলে যাই। কমরেড ভাণ্ডারী স্বভাবতই কংগ্রেসের কাজকর্ম নিয়ে প্রচণ্ড ব্যস্ত ছিলেন, তবু তার মধ্যেই তিনি বিমানবন্দরে আমাকে বিদায় জানাতে আসেন। তাঁর সঙ্গে আমার সেই শেষ সাক্ষাৎ। আমি ভাবতেই পারিনি যে, এত অল্প সময়ের মধ্যে এরকম একটি পরিস্থিতিতে আমাকে আবার কাঠমাণ্ডুতে আসতে হবে।

অনেক আগে, কমরেড ভাণ্ডারী সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হওয়ার পর আমরা পাটনায় বেশ কয়েকদিন ধরে আলাপ-আলোচনা চালিয়েছিলাম। তারপরে আমরা দিল্লীতে কয়েকদিনের জন্য মিলিত হয়েছিলাম। তখন তিনি আমাকে পরবর্তী দফা আলোচনার জন্য নেপালে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আমাদের দুই পার্টির মধ্যে সম্পর্কের সূত্রপাত ১৯৭০ দশকের শেষ দিকে। তখন থেকেই আমাদের মধ্যে নিয়মিতভাবে কেন্দ্রীয় স্তরে কথাবার্তা চলে আসছে। আমাদের মধ্যেকার সম্পর্ক হল আদর্শ ভ্রাতৃপ্রতিম। বহু বিষয়েই আমরা অভিজ্ঞতা ও মতামত বিনিময় করেছি, কিন্তু পরস্পরের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কখনো হস্তক্ষেপ করিনি। আমাদের দুই পার্টি মোটামুটি একই ধারায় গড়ে উঠেছে। তবে গণকাজের কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাঁরা আমাদের চাইতে আগেই এগোতে শুরু করেন।

কমরেড ভাণ্ডারী ব্যক্তিগতভাবে আমাদের কলকাতা পার্টি কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন। কংগ্রেস-পরবর্তী সমাবেশেও তিনি বক্তৃতা দেন। আমাদের পার্টি কংগ্রেসে তাঁর বক্তব্যে কমরেড ভাণ্ডারী পার্টির ভূমিকাকে পরিপূর্ণভাবে সামনে আনার ওপর জোর দেন। কঠিনতম পরিস্থিতিতেও আমরা বন্ধু থেকেছি, চিরদিন তাই থাকব – এই কথা বলে তিনি সেখানে বক্তব্য শেষ করেন। তিনি ঠিকই বলেছিলেন।

কমরেড ভাণ্ডারী ছিলেন এক আত্মপ্রত্যয়ী মানুষ। তাঁর মর্যাদা ও সম্মানবোধ ছিল প্রখর।

তাঁদের পার্টি কংগ্রেসে উপস্থিত থাকার পর আমি যখন ফিরে আসছিলাম, তখন তিনি আমাকে একটি খবরের কাগজ দেখান। সেখানে টনকপুর ইস্যুতে জনৈক ভারতীয় কমিউনিস্ট নেতার উপদেশ প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর পার্টির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এরকম স্থুল হস্তক্ষেপ দেখে কমরেড ভাণ্ডারী খুবই ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছিলেন। একান্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধুর, বলিষ্ঠ ও মর্যাদাসম্পন্ন এই ব্যক্তিত্বের নানান স্মৃতি ২০ মে সারারাত ধরে আমার চোখে ভাসতে থাকে।

পরদিন অর্থাৎ ২১ মে অন্তিম যাত্রার কথা ছিল। প্রয়াত নেতাদের প্রতি জাতীয় সম্মান জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নেপাল সরকার। সুতরাং শোক মিছিলের একেবারে সামনে মৃতের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে মিলিটারী ব্যাণ্ড বাজছিল। আমার জীবনে কোনোদিন আমি এত বড় শোক মিছিল দেখিনি। চারিদিক থেকে সমস্ত ধরনের মানুষের অন্তহীন স্রোত তাঁদের নেতাদের শেষবারের মতো দেখার জন্য আসতেই থাকছিল। মনে হচ্ছিল গোটা কাঠমাণ্ডু শহরই যেন রাস্তায় নেমে এসেছে। এই বিশাল মানব সমুদ্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে স্বেচ্ছাসেবকদের খুবই বেগ পেতে হচ্ছিল। এক মানবশৃঙ্খলা তৈরি করে তাঁরা গণতরঙ্গ সুশৃঙ্খল রাখার চেষ্টা করছিলেন।

শোকযাত্রার পুরো পথ জুড়ে দুধারে হাজার হাজার মানুষ দাঁড়িয়েছিলেন। বাড়িগুলির ছাদে ও বারান্দায় তিলধারণের স্থান ছিল না। মহিলারা সেখান থেকে শোক মিছিলে ফুল ও জল ছিটিয়ে দিচ্ছিলেন। শ্মশানে পৌঁছতে শোকযাত্রার পুরো চার ঘণ্টা লেগে গেল। ফিলিপাইনস কমিউনিস্ট পার্টির কমরেড এমিল, সিপিআই(এম)-এর কমরেড সুরজিৎ, সিপিআই-এর কমরেড ফারুকি, আমি এবং নেপাল পার্টির নেতারা একটি ট্রাকে মিছিলের শেষভাগে চলছিলাম। কমরেড এমিল এবং আমি পায়ে হেঁটে মিছিলে যাওয়ার জন্যই তৈরি ছিলাম। কিন্তু ব্যবস্থাপনা যেমন ছিল তাতে আমাদের ট্রাকেই চড়তে হল। কমরেড এমিল বারবার এই ব্যবস্থার প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন। শেষ পর্যন্ত আমরা কমরেড মাধব নেপালকে জানিয়ে ট্রাক থেকে নেমে পড়লাম। যাত্রার শেষ অংশটুকু আমরা দুজন শোকযাত্রীদের সাথে পায়ে হেঁটেই গেলাম।

শ্মশানে আমি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখি। আমি বলি, কয়েক বছর আগে নেপাল যখন এক মহান ঐতিহাসিক মোড় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তখন এখানকার কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল এমন একজন তাত্ত্বিকের যিনি মার্কসবাদের বিশ্বজনীন সত্যকে নেপালের নির্দিষ্ট অবস্থার সাথে একাত্ম করবেন; নেপালে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল এমন এক নেতার যিনি নির্ভীকভাবে সুসঙ্গত গণতন্ত্রের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরবেন এবং নেপালী জাতির প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল এমন এক জাতীয় ব্যক্তিত্বের যিনি নেপালের জাতীয় স্বার্থ ও আশা আকাঙ্খার জন্য দৃঢ়ভাবে লড়বেন। প্রয়াত কমরেড মদন ভাণ্ডারী এই তিনটি প্রয়োজনই মিটিয়েছিলেন আর এটাই ছিল তাঁর অতুলনীয় অবদান। প্রয়াত কমরেডদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই এবং আমাদের পার্টির পক্ষে থেকে দুটি শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই।

অবশেষে চিতায় অগ্নিসংযোগ করা হয়, পুড়ে ছাই হয়ে যেতে লাগল দুই নেতার মৃতদেহ, পরে চিতাভষ্ম ছড়িয়ে দেওয়া হবে গোটা নেপালে। স্মৃতির অরণ্যে হারিয়ে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি, চমক ভাঙল একজন কমরেডের কথায় “কমরেড সব শেষ”! ফেরার পথে ফিলিপাইনসের কমরেড তাঁর দেশের এ্যাকুইনো এবং একজন ট্রেড ইউনিয়ন নেতার অনুরূপ শোকমিছিলের কথা স্মরণ করছিলেন। আমাদের মধ্যে কথা হচ্ছিল, কমরেড ক্রিস হানি ও মদন ভাণ্ডারী তাঁদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যে কথা প্রমাণ করে দিয়েছেন তা হল : বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের কাছে কমিউনিজমই সবচেয়ে জনপ্রিয় মতাদর্শ।

আমাদের কলকাতা সমাবেশে বক্তব্য রাখার সময় কমরেড ভাণ্ডারী তাঁদের পার্টির খবরাখবর চেপে যাওয়া ও বিকৃত করার জন্য ভারতীয় সংবাদপত্রগুলিকে সরাসরি সমালোচনা করেছিলেন। আমাদের কোনো কোনো কমরেডের মনে হয়েছিল, এটা তিনি না করলেই পারতেন। এর কয়েক দিন পরে আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, ভারতের সংবাদপত্রগুলি সিপিএন(ইউএমএল)-এর ঐতিহাসিক পার্টি কংগ্রেসের কথা কেমন চেপে গেল। আর এবার দেখলাম স্ব-আরোপিত সেন্সরব্যবস্থার এক চরম নিদর্শন : নেপালে এ যাবৎকালের সর্ববৃহৎ শোকযাত্রা সম্পর্কে ভারতীয় সংবাদপত্রগুলির সম্পূর্ণ নীরবতা। আমি জানি না, ভারতীয় সংবাদজগতের এ হেন আচরণের কারণ কি কমিউনিস্ট বিদ্বেষ? নাকি যে মানুষটি ভারতীয় উচ্চাকাঙ্খার বিরুদ্ধে নিজের দেশের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য লড়ছিলেন তাঁর প্রতি আক্রোশ? আমি এখন বুঝতে পারি, ভারতীয় প্রেসের বিরুদ্ধে কমরেড ভাণ্ডারীর ক্ষোভ প্রকাশ কত সঙ্গত ছিল।

কমরেড মদন ভাণ্ডারীর যাত্রা শেষ হল। তবে শুরু হল তাঁর পার্টি সিপিএন(ইউএমএল)-এর এক নতুন যাত্রা। আমি নিশ্চিত, পার্টি এই আঘাত সামলে উঠবে, মূর্খ কুৎসা রটনাকারীদের আশা ব্যর্থ করে আগামী দিনগুলিতে তাকে পরিণত করবে এক নতুন শক্তিতে। কমরেড মাধব নেপালের সর্বসম্মতিক্রমে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়া তারই ইঙ্গিত।