(ডিসেম্বর ১৯৯২-এর পঞ্চম পার্টি কংগ্রেসে গৃহীত রাজনৈতিক-সাংগঠনিক রিপোর্ট থেকে)

১। বিগত পাঁচ বছরে দুনিয়াজুড়ে যে ঘটনাপ্রবাহ বয়ে গিয়েছে তার তাৎপর্য প্রকৃতই বিশ্ব-ঐতিহাসিক। বিংশ শতাব্দীর মধ্যে বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্রের বিজয়ের যে আশা লেনিন দেখেছিলেন তার বিপরীতে ৭৫ বছরের তিক্ত সংগ্রামের পর আজ পুঁজিবাদী আপাতদৃষ্টিতে সমাজতন্ত্রের উপর বিজয় অর্জন করেছে।

পুঁজিবাদের এই আপাত বিজয়ে উৎফুল্ল বুর্জোয়া মতাদর্শের বিশিষ্ট প্রবক্তা ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা একটি “একক, সুসংবদ্ধ, বিবর্তনশীল প্রক্রিয়া” অর্থে ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘোষণা করে দিয়েছেন। ফুকুয়ামার মতে “উদারনীতিবাদী পুঁজিবাদের থেকে উন্নত কোনো সামাজিক রূপের কথা আর ভাবা যায় না” এবং “এর পরেও সমাজে যে বৈষম্য থেকে যাবে তার মূলে থাকবে মানুষে মানুষে প্রতিভার স্বাভাবিক তারতম্য, অর্থনৈতিকভাবে প্রয়োজনীয় শ্রম বিভাজন এবং সংস্কৃতি”।

পুঁজিবাদ ও উদারনৈতিক গণতন্ত্রের ব্যবস্থাতেও উত্তেজনা থাকবে, ফুকুয়ামা আমাদের বলছেন, তা উদ্ভূত হবে শ্রেণীগত বিরোধের কারণে নয় ‘বরং অসমান মানুষকে সমান চোখে দেখার ও সমান স্বীকৃতি দেওয়ার যে প্রবণতা উদারনৈতিক গণতন্ত্রের রয়েছে সেই প্রবণতা থেকেই’। এই অশান্তি কি আবার উদারনৈতিক গণতন্ত্রকে কোণঠাসা করে ফ্যাসিবাদকে ডেকে আনবে না যে ফ্যাসিবাদ অসমান জনগণের প্রতি অসম আচরণ করে থাকে? ফুকুয়ামা এ প্রশ্নে নীরব থাকলেও ইউরোপে সমাজতন্ত্রের পতনের সাথ সাথে জার্মানি, ফ্রান্স ও ইতালীতে নাৎসীবাদ আবার স্পষ্টতই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে যদিও এবার নিশানা বহিরাগত জনসমুদয়।

২। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ছিল একই সঙ্গে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ঠাণ্ডা যুদ্ধের সূচনা, পরবর্তীকালে যা দুই বৃহৎশক্তির মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা হিসাবে সামনে এসেছে। দুই সামরিক জোট ন্যাটো ও ওয়ারশ প্যাক্ট ইউরোপের বুকে এমন এক মুখোমুখি প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হয়েছিল যে তা লাগামহীন অস্ত্র প্রতিযোগিতা এবং বিশাল পরিমাণে পারমাণবিক বোমা মজুত করে তুলেছিল যা দিয়ে সমগ্র মানব জাতিকে কয়েকবার ধ্বংস করে ফেলা যায়।

৩। সাম্রাজ্যবাদ ও সমাজতান্ত্রিক ব্লকের মধ্যেকার এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সোভিয়েত নেতৃত্ব সর্বোচ্চ গুরুত্ব ও কেন্দ্রাভিমুখ আরোপ করেছিল যা সমস্ত সমাজবাদী দেশ, কমিউনিস্ট পার্টি ও তৃতীয় বিশ্বের আন্দোলনকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পিছনে দাঁড়ানোরই দাবি করে। কিন্তু বাস্তব জীবনে, এটি সমাজতান্ত্রিক শিবিরে ভাঙ্গন সৃষ্টি করেছিল। ১৯৬৮ সালে চেকোশ্লোভাকিয়ার উপর আক্রমণ এবং পরবর্তীকালে সীমাবদ্ধ সার্বভৌমত্বের ধারণার উদ্ভব কার্যত পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিকে সোভিয়েতের তাঁবেদারে পরিণত করেছিল।

৪। বৃহৎশক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করার পর সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্রুতই নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে। চীনের সঙ্গে স্থায়ী উত্তেজনায় জড়িয়ে পড়া, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে জাতীয় ভাবাবেগের বিরাগভাজন হয় পড়া, এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের সাথে সামরিক জোটে আবদ্ধ হওয়া ইত্যাদির পর শেষপর্যন্ত সে আফগানিস্তানে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে।

অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে, সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা বহু পূর্বেই তার স্পন্দন হারিয়ে ফেলেছিল এবং স্থবির হয়ে পড়েছিল। পচনের প্রক্রিয়া অনেক আগেই শুরু হলেও তা বৃহৎশক্তিসুলভ দম্ভের আড়ালে লুকানো ছিল। ঐ বুদবুদের বিস্ফোরণ অনিবার্যই ছিল। ১৯৮০ দশকের মধ্যভাগে সোভিয়েতের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হওয়ার সাথে সাথে, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলির একের পর এক সোভিয়েত কক্ষপথ থেকে বেরিয়ে যেতে থাকে এবং ফলত সোভিয়েত ধাঁচের সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে থাকে। বৃহৎ শক্তিসুলভ অবস্থা টলমল হয়ে পড়ার পর কোনো বন্ধনই আর অবশিষ্ট থাকল না যা সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারে।

৫। রোমানিয়া, যুগোশ্লাভিয়া ও আলবেনিয়াও, আগে অথবা পরে, নিজ নিজ পথে সোভিয়েত পতনকে অনুসরণ করল। ইউরো কমিউনিজমের তথাকথিত বাহ্যিক চেহারাটি পরিবর্তনের হাওয়ার প্রথম ধাক্কাতেই মুখ থুবড়ে পড়ল এবং তাদের সমাজতান্ত্রিক অন্তর্বস্তু উন্মোচিত হয়ে গেল। ইউরোপের প্রায় সমস্ত সোভিয়েতপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিগুলি রাতারাতি ভোল পার্টে বিভিন্ন ধারার ও বিভিন্ন মাত্রার সমাজতন্ত্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করে। সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি প্রবাদের ডাইনোসোরের মতোই তার গতি হারিয়ে ফেলেছিল। পেরেস্ত্রৈকা ও গ্লাসনস্তের মধ্যে সে নিজের ফ্রাঙ্কেনস্টাইন সৃষ্টি করে ফেলে।

৬। ঠাণ্ডা লড়াই পরবর্তী যুগে সবচেয়ে লাভবান হয়েছে জার্মানি। পূর্ব জার্মানিকে পশ্চিম জার্মানির মধ্যে অঙ্গীভূত করে ফেলা হয়েছে এবং পূর্ব জার্মানির রাষ্ট্রপ্রধান হোনেকার এখন বিচারের অপেক্ষায় জার্মানির কারাগারে দিন কাটাচ্ছেন। নতুন ‘ঐক্যবদ্ধ’ জার্মানি যুগোশ্লাভিয়ার ভাঙ্গনে প্ররোচনা সৃষ্টি করতে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। সংক্ষেপে বলা যায় যে যুদ্ধ পরবর্তী যুগে জার্মানির বিরুদ্ধে যেসব নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা হয়েছিল তা ভেঙ্গে পড়েছে এবং ইউরোপীয় অর্থনৈতিক সম্প্রদায়ের কাঠামোর ভেতর ও বাইরে জার্মানির আর্থিক ও রাজনৈতিক প্রতিপত্তি বেড়েই চলেছে।

৭। ১৯৮০-র দশকে জাপান এক অর্থনৈতিক অতিবৃহৎ শক্তি হিসাবে নিজেকে সংহত করেছে এবং এই দিক থেকে তার স্থান কেবলমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরেই। এই অর্থনৈতিক বলে বলীয়ান হয়ে জাপান আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সক্রিয় রাজনৈতিক ভূমিকা গ্রহণ করতে সচেষ্ট হচ্ছে। নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্যের আসন পাওয়ার লক্ষ্যে নিরাপত্তা পরিষদের পুনর্বিন্যাসের জন্য ওকালতি করা এবং রাষ্ট্রসংঘের এক শান্তি উদ্যোগে সামিল হয়ে দেশের সীমানার বাইরে কাম্পুচিয়ায় সৈন্যবাহিনী পাঠানোর উদ্দেশ্যে সংবিধান সংশোধন করা – অন্যান্য বিষয় ছাড়াও এগুলি স্পষ্টভাবেই ঐ উদ্দেশ্যকে প্রতীয়মান করছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের অবলুপ্তি এবং তার সঙ্গে মার্কিন ছত্রছায়া দুর্বল হয়ে পড়ায় জাপান সামরিকীকরণের এক উচ্চাকাঙ্খী কর্মসূচিতে নেমে পড়েছে। তার সামরিক বাজেট এখন পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম।

৮। জাপানের পাশাপাশি ‘এশীয় শার্দুলেরাও’ অর্থাৎ দক্ষিণ কোরিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর ও তাইওয়ান দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করেছে। মালয়েশিয়া, থাইল্যাণ্ড ও ইন্দোনেশিয়াও তাদের থেকে এখন খুব একটা পিছিয়ে নেই। একসাথে বিশ্ব বাণিজ্যের দশ শতাংই হয় তাদের মাধ্যমে। আমেরিকা ও ব্রিটেনের পড়ন্ত অর্থনীতির তুলনায় এশিয়াকে ৯০-এর দশকের অতিবৃহৎ বাজার হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।

৯। বিশ্ব অর্থনীতির নতুন শক্তিকেন্দ্র হিসাবে চীন আত্মপ্রকাশ করেছে যার বার্ষিক বৃদ্ধির হার ৯০-এর দশকে জাপান ও কোরিয়াকে অতিক্রম করে যাবে বলে আশা করা যায়। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক শক্তির ভিত্তিতে চীনও উন্নয়নশীল বিশ্বের অংশ হিসাবে বিশ্ব রাজনীতিতে আরও সক্রিয় ভূমিকা বাড়ানোর চেষ্টা করছে। ১০০০ মেগাটনের পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা, পর্যবেক্ষক হিসাবে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে যোগ দেওয়া, জাপানী অগ্রগতিকে মাথায় রেখে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা এবং খুব সম্প্রতি মার্কিন আপত্তি অগ্রাহ্য করে পারমাণবিক রি-এ্যাক্টর বিক্রি করার জন্য ইরানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়া – এগুলি সাম্প্রতিক সময়ে চীনের কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ।

১০। ঠাণ্ডা লড়াইয়ের মতাদর্শগত বিজয়ী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তার বিশ্ব আধিপত্যকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে চাইছে গদগদভাবে ‘নয়া বিশ্ব ব্যবস্থার’ ওকালতির মধ্য দিয়ে। ইরাকের সঙ্গে যুদ্ধ নির্দিষ্টভাবে এই ইঙ্গিতই বহন করে। ইরাকের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক মার্কিন কার্যকলাপ নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করছে যে রাষ্ট্রপুঞ্জের নির্দেশে কুয়েতকে মুক্ত করার অজুহাত ছিল আসলে তার প্রকৃত মতলবকে আড়াল করার কৌশলমাত্র। অবশ্য, আমেরিকার আধিপত্য বিভিন্ন শিবির থেকে বিরোধিতার মুখোমুখি হচ্ছে এবং তার দুরাকাঙ্খা যাইই হোক না কেন বাস্তব জীবনে সে এক পতনোম্মুখ বৃহৎশক্তি মাত্র।

১১। সাম্রাজ্যবাদ ও সর্বহারা বিপ্লবের যুগ হিসাবেই বর্তমান যুগকে আজ সবচেয়ে ভালোভাবে চরিত্রায়িত করা যায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গন এবং সোভিয়েত শিবিরের অবলুপ্তির পর সমাজতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী দেশগুলির দ্বন্দ্ব আজ আর আলাদা করে বিশ্বের একটি বড় দ্বন্দ্ব হিসাবে থাকছে না। অন্যদিকে, সাম্রাজ্যবাদ ও তৃতীয় বিশ্বের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব কিন্তু ক্রমেই তীব্র হয়ে উঠছে। সমাজতান্ত্রিক শিবিরের ওপর সোভিয়েত আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা যেমন সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির মধ্যে বিভাজনই ডেকে এনেছিল তেমনি সাম্রাজ্যবাদ বনাম তৃতীয় বিশ্বের দ্বন্দ্বকে সমাজতন্ত্র বনাম সাম্রাজ্যবাদের দ্বন্দ্বের অধীনস্থ করে রাখার চেষ্টাও কেবলমাত্র তৃতীয় বিশ্বকে বিভক্তই করেছিল, যার ফলস্বরূপ তৃতীয় বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ভূমিকা দুর্বল ও বিকৃতই হয়ে পড়ে। আজ যখন সোভিয়েত প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে তৃতীয় বিশ্বকে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েই সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে, তখন তৃতীয় বিশ্বের মধ্যে এক ঐক্য ও সংকল্পও দেখা যাচ্ছে। তৃতীয় বিশ্বের মধ্যকার সোভিয়েত ঘেঁষা দেশগুলির দরকষাকষির ক্ষমতা নিশ্চয়ই মার খেয়েছে, কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির ক্রমবর্ধমান দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে তারাও দ্রুতই নিজেদের সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস ও হৃত শক্তির পুনরুদ্ধারের পথে এগিয়ে চলেছে। তাছাড়া আজকের অবশিষ্ট সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি তৃতীয় বিশ্বেরই প্রতিনিধিত্ব করে এবং প্রধানত সেই সামর্থের ওপর দাঁড়িয়েই তারা সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে। বর্তমান ঐতিহাসিক যুগে, সাম্রাজ্যবাদ ও তৃতীয় বিশ্বের মধ্যকার দ্বন্দ্বই তাই প্রধান দ্বন্দ্ব হিসাবে থাকছে।