(লিবারেশন, এপ্রিল ১৯৯৭ থেকে)

“বিড়াল যদি ইঁদুর ধরতে পারে তবে তা সাদা না কালো তা দেখার দরকার নেই”। দেং-এর এই বিখ্যাত উক্তি সম্পর্কে এখনও পর্যন্ত সরকারিভাবে যা জানা গেছে তা হল, উল্লিখিত বিড়ালটি হলুদ, সাদা নয়।

চীনের প্রবীণ বিপ্লবীদের মধ্যে সর্বশেষ যোগসূত্র দেং শিয়াও পিং তাঁর সত্তর বছরব্যাপী রাজনৈতিক জীবনে এক বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব হিসাবেই থেকে গিয়েছিলেন। দেং চীনে সমাজতন্ত্র নির্মাণ করছিলেন না পুঁজিবাদকে বিকশিত করছিলেন সে বিতর্ক অমীমাংসিত থেকে গিয়েছে; তবুও একথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই তাঁর পরিচালনায় চীন মাত্র দশ থেকে পনেরো বছরের মধ্যে বিশ্বের এক গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক শক্তি হিসাবে উঠে এসেছে। চীনের অর্থনৈতিক বিকাশের গতিকে বিশ্বের ইতিহাসের নিরীখে অতুলনীয় হিসাবে – এক বিস্ময় হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং বিশেষজ্ঞদের ধারণা মোটামুটি এক দশক কালের মধ্যে চীন অর্থনৈতিক দিক থেকে এক অতিবৃহৎ শক্তি হয়ে ওঠার মতো অবস্থায় রয়েছে, যার স্থান হবে কেবলমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরেই।

চীনে বিপ্লবোত্তর পর্যায়ে সমাজতান্ত্রিক নির্মাণের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে মাও ও দেং-এর মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিতে শুরু করে। দেং মনে করতেন সমাজতান্ত্রিক নির্মাণের পর্যায়ে পশ্চাদপদ উৎপাদিকা শক্তি ও উন্নত উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে দ্বন্দ্বই হল চীনা সমাজের প্রধান দ্বন্দ্ব। অন্যভাবে বলতে গেলে, উৎপাদিকা শক্তির দ্রুত বিকাশ ঘটানো না গেলে উন্নত উৎপাদন সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখা যাবে না, ফলে সমাজতন্ত্র এক কল্পকথা হয়েই থাকবে। আর তাই লিউ শাও চি-র সঙ্গে তিনিও উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের উপরই প্রাথমিক গুরুত্ব আরোপের কথা বলেন। আর উৎপাদন সম্পর্কের বিষয়টির ধাপে ধাপে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বিকাশ ঘটানোর কথা বলেন।

চেয়ারম্যান মাও-এর নেতৃত্বে নতুন চীন সমাজতন্ত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে দ্রুত অগ্রগতি অর্জন করতে থাকে এবং ষাটের দশকের গোড়ার দিকেই সেখানে এক শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক পরিকাঠামো গড়ে ওঠে। বিকাশের পরবর্তী পর্যায়ে আন্তঃপার্টি বিতর্ক তীব্রতর হয়ে ওঠে এবং পরিণামস্বরূপ তা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের জন্ম দেয়। লিউ শাও চি-র পর দেং-কে ‘পুঁজিবাদী পথের দু-নম্বর পথিক’ হিসাবে অভিহিত করা হয় এবং তাঁকে বেজিং থেকে অনেক দূরে এক কারখানায় এক সাধারণ শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে পাঠানো হয়। শোনা যায় দেং অন্ততপক্ষে দু-বার আত্মসমালোচনা করেছিলেন এবং স্বীকার করেছিলেন যে তিনি সত্যিই পুঁজিবাদী পথের পথিক ছিলেন।

এসব সত্ত্বেও যে আদর্শবোধগুলি সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পিছনে প্রেরণা হিসাবে কাজ করেছিল, যেমন পুঁজিবাদের প্রত্যাবর্তনের বিপদকে প্রতিহত করা, উন্নত সমাজতান্ত্রিক সচেতনতার বিকাশ ঘটিয়ে সমাজতান্ত্রিক মানুষ গড়ে তোলা ইত্যাদি কিন্তু সুদূরের স্বপ্নই রয়ে গিয়েছিল, এবং দীর্ঘ দশ বছর পর সাংস্কৃতিক বিপ্লব ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। কিন্তু পরিহাসের বিষয় হল সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সবথেকে বড় প্রবক্তা লিন পিয়াও ষড়যন্ত্রকারী হিসাবে প্রমাণিত হলেন, যিনি মাও-কে হত্যা করে ক্ষমতা কব্জা করার চক্রান্ত করেছিলেন। লিন পিয়াও-এর চক্রান্ত ব্যর্থ করার কৃতিত্ব কিন্তু ছিল চৌ এন লাই-এর, সাংস্কৃতিক বিপ্লবপন্থীদের তুলনায় যিনি যথেষ্ট নরমপন্থী বলেই পরিচিত। মাও দেং-কে ফিরিয়ে আনেন, কিন্তু এই প্রত্যাবর্তন এক সংক্ষিপ্ত সময়কালের জন্যই হয়েছিল। চৌ-এর মৃত্যুর পর কুখ্যাত চারচক্রের দুরভিসন্ধি দেং-কে পুনরায় অপসারিত করে। মাও-এর মৃত্যুর পর এবং চারচক্রের স্বরূপ আরও উন্মোচিত হওয়ায় দেং-এর নাটকীয় প্রত্যাবর্তন ঘটে এবং তারপর থেকে তাঁকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনিই ছিলেন চীনের সর্বময় নেতা।

তিনি প্রাথমিক স্তরের সমাজতন্ত্রের ধারণাকে সামনে আনেন – যা অবশ্যই দীর্ঘস্থায়ী এক স্তর – এবং উৎপাদন সম্পর্কের আমূল পুনর্বিন্যাস ঘটান আর বিদেশী পুঁজি ও প্রযুক্তির ব্যাপক আমদানির জন্য চীনের দরজা খুলে দেন। ‘প্রথমে কিছু অঞ্চল বিকশিত হোক’ – এই প্রেক্ষিতের উপর ভিত্তি করে তিনি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল সৃষ্টি করেন।

পশ্চিমী পুঁজিবাদী দুনিয়া তাঁর আর্থিক সংস্কারের নীতিকে ব্যাপকভাবে স্বাগত জানায়। এর থেকে পর্যায়ক্রমে রাজনৈতিক সংস্কারের সম্ভাব্যতা সম্পর্কে পশ্চিমী দুনিয়ায় ব্যাপক উচ্ছ্বাস দেখা যায়, যে সংস্কার চীনে কমিউনিস্ট পার্টির একচেটিয়া শাসনের অবসান ঘটাবে এবং বহু-দলীয় সংসদীয় ব্যবস্থার জন্ম দেবে।

এই ক্ষেত্রে দেং কিন্তু নিজেকে কট্টরপন্থী হিসাবেই প্রমাণিত করলেন। তিয়েন-আন-মেন স্কোয়ারে বুর্জোয়া রাজনৈতিক সংস্কারের দাবিকে তিনি নির্মমভাবে চূর্ণ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা দেখাননি। এর জন্য বুর্জোয়া প্রচার মাধ্যম তাঁকে ঐ ঘটনার খলনায়ক হিসাবেই তুলে ধরে।

মাও-এর প্রবল ভাবমূর্তি সম্পন্ন নেতৃত্বে গঠিত সমাজতান্ত্রিক পরিকাঠামোর উপর ভিত্তি করেই দেং আধুনিক চীনের উপরিকাঠামোকে গড়ে তুলেছেন। কমিউনিস্ট পার্টির শাসন ও সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে প্রতিশ্রুতবদ্ধ মাও এবং দেং উভয়েই ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব এবং উভয়েই তাঁদের ঐতিহাসিক ভূমিকার চূড়ান্ত স্ফূরণ ঘটিয়েছেন। তবুও মাও যে লাখ টাকার প্রশ্ন তুলে ধরেছিলেন, ‘কে জিতবে, সমাজতন্ত্র না পুঁজিবাদ?’ সে প্রশ্নের মীমাংসা যেমন মাও-এর সাংস্কৃতিক বিপ্লব করতে পারেনি, তেমনি করতে পারেনি দেং-এর সমাজতান্ত্রিক আধুনিকীকরণের কর্মসূচি। কোন পথে এর মীমাংসা হবে, সে প্রশ্ন একবিংশ শতাব্দীর চীনকেও তাড়িত করবে।

তাঁর জীবনে দু-দুবার পুনর্বাসিত হওয়ার অনন্য কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন দেং শিয়াও পিং। প্রবাদের বিড়ালের মতোই – সাদা বা হলুদ যাই হোক না কেন তিনি ছিলেন প্রবল জীবনীশক্তির অধিকারী।

যে সমস্ত ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের ভূমিকায় বিংশ শতাব্দী রূপ পরিগ্রহ করেছিল, তাদের শেষতম মহান ব্যক্তির প্রতি লিবারেশন শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছে।