(লিবারেশন, এপ্রিল ১০০১ থেকে)

‘যুদ্ধের রাজনীতি’ নিবন্ধে আমি উল্লেখ করেছিলাম যে সাম্প্রতিক যুদ্ধ বর্তমান বিশ্বের জোটগুলি ও তার দ্বন্দ্বগুলিকে প্রতিবিম্বিত করে। একইসঙ্গে তা শক্তিগুলির পারস্পরিক সম্পর্কের পরিবর্তনেরও মাধ্যম।

বিগত কয়েক বছর ধরেই সোভিয়েত রাশিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘাতের প্রক্রিয়ায় তার অতিবৃহৎ শক্তির অবস্থান থেকে স্পষ্টতই পিছু হটেছে – আর এই পিছু হটাকে পরিহাসছলে (euphemistically) শান্তি অভিযান নামেই ভূষিত করা হচ্ছে। এছাড়াও, সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে সোভিয়েতের তত্ত্ব এবং পাশ্চাত্য দুনিয়ার সঙ্গে যে নিবিড় যোগাযোগ সে গড়ে তুলছে তা সোভিয়েত রাশিয়াকে স্পষ্টতই তৃতীয় বিশ্বের স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। সমস্ত ব্যবহারিক দিক থেকে, একেবারে গোড়া থেকেই পশ্চিম এশিয়ার ক্ষেত্রে মার্কিনী পরিকল্পনার এক অধস্তনকারী ভূমিকা ইচ্ছাকৃতভাবেই পালন করে এসেছে সোভিয়েত রাশিয়া। তত্ত্বগতভাবে আমরা এই সবকিছুই জানতাম আর তা সামনাসামনি খোলাখুলি রেখেছিলাম। একেবারে শেষ পর্যায়ে শান্তির এক প্রস্তাব সামনে হাজির করানোর সোভিয়েতের প্রচেষ্টা ইরাকের আত্মসমর্পণের রাস্তা প্রস্তুত করানো ছাড়া আর কিছুই নয়। আর যুদ্ধোত্তর পশ্চিম এশিয়ায় নিজের একটু জায়গা করে নেওয়ার এক দুর্বল প্রচেষ্টাই তার মধ্যে নিহিত ছিল। মার্কিনীরা সোভিয়েত নপুংসকতার সারাংশ সম্পর্কে ওয়াকিবহালই ছিল। তাই তারা তা প্রত্যাখ্যান করে।

কেবল এক খণ্ডিত সংস্করণ নিয়ে সোভিয়েত তার প্রত্যুত্তর দিতে চেয়েছিল। সেটি পুনরায় প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর তারা মার্কিনের অনুসরণকারী হয়ে পড়ে। আমি সেই দিনই নিবন্ধটি লিখেছিলাম যেদিন সোভিয়েতের প্রস্তাব এসেছিল। আর আমি জানতাম সেটিই ছিল সাদ্দামের প্রতিরোধের পরিসমাপ্তি। সে কারণে, ইরাকের আরেকটি ভিয়েতনামে পরিণত হওয়ার আগেকার গুরুত্বের বদলে আমি সাদ্দামের সম্ভাব্য পরায়জের উল্লেখ করে যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে শক্তিগুলির সম্ভাব্য পুনর্বিন্যাসের এক ছবি দিয়ে লেখা শেষ করি। সোভিয়েতের ভূমিকা নিয়ে আমার কখনই কোনো মোহ ছিল না। ইতিমধ্যেই সোভিয়েত ইউনিয়ন তার গৃহীত অবস্থানের যুক্তিসঙ্গত পরিণতির দিকে স্খলিত হয়েছে। এ সম্পর্কে অনেক আগে থেকেই আমাদের মূল্যায়ন থাকা সত্ত্বেও আমাদের কমরেডরা পরিবর্তিত সোভিয়েতের ভূমিকা সম্পর্কে নিজেদের মানসিকভাবে ধাতস্থ করতে পারেননি। যুদ্ধ কেবলমাত্র আসল সোভিয়েতকে বেআব্রু করেছে। অন্যদিকে, যুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়নে এক নতুন ধরনের উদ্বেগ দৃষ্টিগোচর হয়েছে। আর আমি আমার নিবন্ধে লিখেছিলাম যে আমেরিকার সঙ্গে শান্তির পর্যায়ে ক্রমে ক্রমেই উভয়ের মধ্যে উত্তপ্ত সম্পর্কের দিকেই নিয়ে যেতে পারে। তারা প্রচুর আশা পোষণ করত বলেই সোভিয়েত রাশিয়ার প্রতি অত্যধিক সমালোচনায় মুখর হওয়া সিপিআই, সিপিআই(এম)-এর সাজে। আমাদের বরং লক্ষ্য রাখা উচিত, আমেরিকার সঙ্গে তার সম্পর্কের সাপেক্ষে পরিস্থিতি নতুন কোনো মোড় নেয় কিনা।

চীন সম্পর্কে বলা যায় যে, বর্তমান আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে এক সমাজতান্ত্রিক দেশের কাছ থেকে বিশেষ ধরনের ভূমিকা প্রত্যাশা করা অলীক আকাঙ্খা ছাড়া আর কিছুই নয়। বেশ কিছুদিন যাবত চীন এটাই বোঝাতে চেয়েছে যে সোভিয়েত রাশিয়াকে প্রতিস্থাপিত করার মতো কোনো ভূমিকা নিতে আদৌ আগ্রহী নয়। যদিও তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসাবে চীন অবশ্যই সোভিয়েত রাশিয়া থেকে নিজের ফারাক টেনেছে এবং ভোটদানে বিরত থেকেছে (রাষ্ট্রসংঘে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি প্রস্তাবের ক্ষেত্রে – সম্পাদক)। আর এইভাবেই চীন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির সপক্ষে থেকেছে। আর্থিক পুনর্গঠনের লক্ষ্যে চীন পাশ্চাত্য দুনিয়ার সঙ্গে বহুমুখী সম্পর্কের বিকাশ ঘটিয়েছে। আর তিয়েন-আন-মেন ঘটনার পর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সাপেক্ষে পশ্চিমী দুনিয়ার মুখোমুখি হয়ে তার আক্রমণাত্মক অবস্থান খুইয়েছে। পারস্পরিক অবিশ্বাসের সম্পর্কগুলিকে স্বাভাবিক করে নেওয়াই তার কাছে জোর দেওয়ার বিষয়। বিগত বছরগুলিতে চীন যে অবস্থায় জড়িয়ে পড়েছিল সেখান থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এসে খুব বেশি বিপ্লবী অবস্থান নেওয়া তার পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। এ কারণেই আমি বলেছিলাম য়ে এই যুদ্ধ বিভিন্ন দেশগুলির মধ্যেকার প্রকৃত বিদ্যমান সম্পর্কগুলিকেই কেবলমাত্র উন্মোচিত করে দিল। আমরা এ সবকিছুই তত্ত্বগতভাবে জানি। কিন্তু নাছোড়বান্দার মতো পুরোনো মোহ পিছু ছাড়ে না। জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে যখন তা প্রমাণিত হয় তখন আমরা থমকে যাই এবং আবেগপ্রবণ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে আত্মতৃপ্তি খোঁজার চেষ্টা করি। আমার মতে মোদ্দা কথা হল সম্পর্কগুলির পরিবর্তিত বিন্যাসের ওপরই আমাদের নজর রাখতে হবে। কারণ আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে চীনারা এবং একইভাবে অনেক দেশই মার্কিনের নয়া বিশ্ব ব্যবস্থার বিপদ সম্পর্কে খুবই উদ্বিগ্ন। আর এই যুদ্ধ সর্বত্রই পুনরায় চিন্তা ভাবনা করার এক জোয়ার সৃষ্টি করেছে। নতুন সম্পর্কগুলি দানা বাঁধতে এখনও কিছুদিন সময় নেবে।

চীন বা রাশিয়া সম্পর্কে নিজের মতো করে সমালোচনামুখর যদি কেউ হতে চান, আপত্তি নেই। কারণ তা আমাদের পার্টি লাইনের পরিপন্থী নয়। এমনকি কিছু কমরেড যদি চীনা দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন তবে তাতেও আমার আপত্তি নেই। কিন্তু আমি আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে এক আবেগবর্জিত মূল্যায়নেরই পক্ষে থাকতে চাই কারণ বিশ্ব ইতিহাসের ঘটনাক্রম পরিমাপ করা হয়ে থাকে বছরের হিসাবে নয় দশকের নিরিখেই।