(লিবারেশন, এপ্রিল ১৯৯৪ থেকে)
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ভারতবর্ষ জুড়ে এক সামাজিক আলোড়ন চলছে, যার পিছনে অনুঘটক হিসাবে কাজ করেছে দুই যমজ সত্তা – জাতপাত ও ধর্ম। ১৯৯০ সালে ভি পি সিং-এর নেতৃত্বাধীন জনতা দল সরকার অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণীগুলির জন্য সংরক্ষণ প্রশ্নে মণ্ডল কমিশনের সুপারিশগুলি কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরই গোটা ব্যাপারটা সামনে আসে। কংগ্রেস-বিরোধিতার ওপর ভিত্তি করে বিজেপির প্রচ্ছন্ন সমর্থন নিয়েই জনতা দল ক্ষমতায় এসেছিল। কিন্তু এই আঁতাত বেশি দিন টেকেনি। আর এই দুটি দল ভারতের সাম্প্রতিক ইতিহাসের দুটি প্রধান সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের মুখ্য চরিত্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। পরস্পর বিরোধী এই দুই আন্দোলনের দ্বন্দ্ব জনপ্রিয় ভাষায় মণ্ডল বনাম মন্দির দ্বন্দ্ব হিসাবে পরিচিত। প্রথমদিকে, দুর্নীতির (বোফর্স) বিরুদ্ধে সংগ্রামে জনতা দলের সমর্থন-ভিত্তি ছিল অনেক ব্যাপক। কিন্তু অন্য সবকিছুকে ছেড়ে একমাত্র মণ্ডলকেই তুলে ধরার ফলে তার সমর্থন-ভিত্তি অনেকটাই ক্ষয়ে যায় এবং ধারাবাহিক কয়েকটি রাজনৈতিক সংকটের পরিণতিতে এই দল আজ ভারতীয় রাজনীতির এক প্রান্তিক শক্তিতে পর্যবসিত হয়েছে।
ভি পি সিং ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের কথা অনুসারে, যথাস্থিতি ও ধর্মীয় গোঁড়ামিবাদের শক্তিগুলির বিরুদ্ধে তথা তাদের রাজনৈতিক প্রতিনিধি যথাক্রমে কংগ্রেস(ই) ও বিজেপির বিরুদ্ধে মণ্ডলের এক নজিরবিহীন সমাজ বিপ্লবের জন্ম দেওয়ার কথা ছিল।
ইতিহাসের এমনই পরিহাস, মণ্ডলের সুপারিশগুলি কার্যকর করে কংগ্রেস(ই) সরকার এবং এই প্রক্রিয়ায় সে জনতা দলের পালের হাওয়া অনেকটাই কেড়ে নেয়।
‘ন্যায়যোদ্ধা’ ভি পি সিং অবশ্য সহজে ক্ষান্ত দিতে চান না। তাঁর লড়াই এখন মতাদর্শগত-রাজনৈতিক অবস্থান নির্বিশেষে একজন দলিতকে রাষ্ট্রপতি বা একজন অনগ্রসর জাতের মানুষকে প্রধানমন্ত্রীর আসনে দেখার দাবিতে এসে ঠেকেছে। এর পাশাপাশি রয়েছে যতদিন না কোনো অনগ্রসর সংরক্ষণ কোটার ভিত্তিতে চাকরি পাচ্ছেন ততদিন দিল্লী থেকে সরে থাকার চমকসর্বস্ব ঘোষণা। এইভাবে তাঁর বিপ্লব অধঃপতিত হয়েছে প্রসাধনসর্বস্ব সংস্কারে আর তাঁর আন্দোলন পর্যবসিত হয়েছে নিছক প্রতীকসর্বস্বতায়।
সংরক্ষণের নির্দিষ্ট প্রশ্নে জনতা দলের সামনে এখন যে বিকল্পগুলি রয়েছে সেগুলি হল সুবিধাভোগী স্তর সংক্রান্ত রায়ের বিরোধিতা করা এবং উচ্চবর্ণের জন্য অর্থনৈতিক মানদণ্ডের ভিত্তিতে ১০ শতাংশ সংরক্ষণের জন্য চাপ সৃষ্টি করা, যে প্রতিশ্রুতি ভি পি সিং দিয়েছিলেন মণ্ডল-বিরোধী বিক্ষোভ প্রশমিত করার জন্য। স্বাভাবিক কারণে এই দুই বিকল্পের কোনোটাকে নিয়েই তারা আন্তরিকভাবে আন্দোলনে নামতে পারে না।
ভি পি সিং ও তাঁর জনতা দলের রাজনৈতিক অস্তগমন মুলায়ম সিং ও কাঁসিরামের উত্থানের সূচনা করে। মুলায়ম নিজেকে বহিরাগত ভি পি সিং-এর তুলনায় অনগ্রসরদের সহজাত প্রতিনিধি হিসাবে দাবি করেন। লোহিয়াকে স্মরণ করে তিনি তাঁর রাজনীতিকে সাজিয়েছেন এক সমাজতান্ত্রিক বাচনভঙ্গিতে, যার মধ্যে এক বলিষ্ঠ উত্তরাধিকার ও উদ্দেশ্যের আন্তরিকতা প্রতীয়মান। অন্যদিকে দলিত রাজনীতির উদীয়মান নক্ষত্র কাঁসিরাম স্মরণ করেন আম্বেদকরের উত্তরাধিকারকে। এক চরম দলিতবাদী অবস্থান এবং কমিউনিস্টদের সম্পর্কে ঘৃণাকে সম্বল করে তিনি স্বয়ং আম্বেদকরকেও ছাড়িয়ে যেতে উদ্যোগী।
এইসব নাটকীয় ঘটনা ভারতীয় বাম ও কমিউনিস্ট আন্দোলনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। একদিকে বিহার ও উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলিতে অনগ্রসর জাতের কৃষক জনতার মধ্যে কমিউনিস্টদের সামাজিক ভিত্তিতে মণ্ডল বিরাট ক্ষয় ধরিয়েছে, অন্যদিকে উত্তরপ্রদেশে বাম দলগুলির পরম্পরাগত দলিত সমর্থন-ভিত্তিকে বিএসপি নিশ্চিহ্ন করেছে। এই পরিস্থিতি বাম ও কমিউনিস্ট মহলে এক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, যার মূল কথা হল ভারতীয় সমাজে জাতিভেদের বিষয়টি নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে হবে এবং বিশেষ করে সোভিয়েত বিপর্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে, শ্রেণী সম্পর্কে “সনাতন” ধারণাটিকেও নতুনভাবে বিচার করতে হবে। সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশে সিপিআই-এর প্রথম সারির নেতৃবৃন্দের দলত্যাগ করে সমাজবাদী পার্টিতে যোগদান, অন্ধ্রপ্রদেশে জনযুদ্ধ গোষ্ঠীর নকশালপন্থীদের বিএসপি-তে ভিড় করা এবং বিহারে কয়েকজন আইপিএফ বিধায়কের জনতা দলে যোগদান – এ সমস্তই পরিস্থিতির গুরুত্ব ও জটিলতার পরিচায়ক।
আমার সামনে এখন একটা বই। নাম, জাত ও শ্রেণীর গতিসূত্র – র্র্যাডিকাল আম্বেদকরপন্থী তত্ত্বানুশীলন (Caste and Class Dynamics – Radical Ambedkarite Praxis)। লেখক, জনৈক ডঃ টমাস ম্যাথু। জাত ও শ্রেণীর আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে লেখক বেশ কিছু চমকপ্রদ মতামত রেখেছেন। বইটিতে উপস্থাপিত ধারণাগুলির বিশ্লেষণের প্রক্রিয়ায় আমি জাত ও শ্রেণীর মধ্যকার সম্পর্কের জট খোলার চেষ্টা করব।
লেখকের ঘোষিত উদ্দেশ্য মার্কসবাদ ও আম্বেদকরবাদের সমন্বয় সাধন, যা তাঁর মতে “ভারতবর্ষের লক্ষ কোটি মানুষের একমাত্র ভরসা”। তিনি এই কঠিন দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন এমন এক পরিস্থিতিতে যখন “মার্কসবাদী অনুশীলন, অন্তত তার প্রধান প্রধান ধরনগুলি, বিশ্ব জুড়ে ঐতিহাসিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন”, কিন্তু “আম্বেদকরীয় তত্ত্বানুশীলনের ধারা ভারতে তার শৈশবের সমস্যাগুলিকে কাটিয়ে এগিয়ে চলেছে”। তা সত্ত্বেও ঐ সমন্বয়কে “মার্কসীয় কাঠামোয় আম্বেদকরবাদকে অঙ্গীভূত করে নেওয়া” হিসাবেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে, প্রাসঙ্গিক পরিপ্রেক্ষিতের উল্লেখ থেকে যদিও বিপরীতটাই স্বাভাবিক হত বলে মনে হয়। লেখকের মার্কসবাদী পরিচিতি পরিষ্কার হয় শ্রী কে ভেনুর প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতা স্বীকারের মধ্যে দিয়ে। তাঁর ভাষায়, “মার্কসবাদী মৌলবাদ তথা নেতৃত্বের “বিপ্লবী কর্তৃত্বের” ধারণার বিরুদ্ধে সংগ্রামে তাঁর পথপ্রদশন ও নেতৃত্ব ছাড়া আমার পক্ষে অনেক মার্কসবাদী অন্ধবিশ্বাসকেই প্রশ্ন করে ওঠা সম্ভব হত না।” এ প্রসঙ্গে আরও কথা পরে।
এগোনো যাক। বইটির প্রথম অংশে গান্ধী ও গান্ধীবাদের বিরুদ্ধে আম্বেদকরের সংগ্রাম নিয়ে আলোচনা রয়েছে। ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ এই সংগ্রামের বর্ণনা রয়েছে আম্বেদকরের কংগ্রেস, গান্ধী ও আস্পৃশ্যরা শীর্ষক বইটিতে। দিল্লীর এক লাইব্রেরী থেকে বইটির আদি সংস্করণের এক পুরোনো কপি লেখক জোগাড় করেছেন। ব্যাপারটা উল্লেখযোগ্য, কেননা লেখক দাবি করেন যে পরবর্তী সংস্করণগুলিতে এর বিষয়বস্তুকে পাল্টে দেওয়ার ও লঘু করার চেষ্টা হয়েছে।
লেখকের দাবি, শাসকশ্রেণী, কংগ্রেস ও গান্ধীবাদ সম্পর্কে ডঃ আম্বেদকরের বিশ্লেষণ ও সূত্রায়নগুলি স্বীকৃত আম্বেদকরপন্থী অবস্থানের থেকে অনেকাংশেই পৃথক। তাছাড়া, “পশ্চিমী সংসদীয় ব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন এবং প্যারি কমিউন ও সোভিয়েত ব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁর অনুমোদসূচক উল্লেখ আম্বেদকরকে কমিউনিস্ট-বিরোধী হিসাবে উপস্থাপিত করার সমস্ত তত্ত্বকে নাকচ করে দিয়েছে।”
বোঝা যায়, গান্ধীর দৃষ্টিভঙ্গি মূলত ছিল তথাকথিত “গঠনমূলক কাজের” মাধ্যমে হিন্দু ধর্মের কিছু সংস্কারসাধন করা, যাতে স্বাধীনতা সংগ্রামে কংগ্রেসের উচ্চবর্ণ নেতৃত্বের পিছনে অস্পৃশ্যদের সমর্থন আদায় করা যায়। অন্যদিকে, আম্বেদকরের প্রচেষ্টা ছিল হিন্দু ধর্মের আমূল পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে জাতিভেদ প্রথার বিলোপসাধন এবং দলিতদের ক্রমবর্ধমান আশা-আকাঙ্খাকে একটি রাজনৈতিক মঞ্চে উপস্থাপিত করা। গান্ধী ও আম্বেদকরের দৃষ্টিভঙ্গির এই বৈপরীত্যই তাঁদের পারস্পরিক সম্পর্ককে তথা মুসলিম ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে এবং ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ককে নির্ধারিত করেছে।
গান্ধীর অর্থনৈতিক দর্শন সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে আম্বেদকর লিখেছিলেন, “সমস্ত অর্থনৈতিক অন্যায়ের মূলে যন্ত্র ও যন্ত্রনির্ভর সভ্যতা – এই গান্ধীবাদী বিশ্লেষণের মধ্যে নতুনত্ব কিছু নেই। এগুলি পুরোনো ও বস্তাপচা যুক্তি; রুশো, পুশকিন, তলস্তয়ের পুনরাবৃত্তি। তাঁর অর্থনৈতিক ধারণা নিতান্তই ভ্রান্ত, কারণ যন্ত্রনির্ভর উৎপাদন ও সভ্যতা কর্তৃক সৃষ্ট অমঙ্গলগুলির জন্য যন্ত্রকে দায়ী করা চলে না। ... এর মূলে রয়েছে একটি ত্রুটিপূর্ণ সমাজব্যবস্থা, যা ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও ব্যক্তিগত লাভের পিছনে ছোটাকে এক মহান ও পবিত্র ব্যাপার করে তুলেছে ... সুতরাং যন্ত্র ও সভ্যতাকে বর্জন করেই এর সমাধান করা যাবে না। প্রয়োজন সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন, যাতে সমস্ত সুযোগসুবিধা মুষ্টিমেয়ের করায়ত্ত না হয়ে সকলের মধ্যে সমানভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে”।
গান্ধীর সঙ্গে সংঘাতে আম্বেদকরকে নিঃসন্দেহে স্বাধীনতা সংগ্রামের এক র্র্যাডিক্যাল সামাজিক অর্থনৈতিক কর্মসূচির অন্যতম প্রবক্তা হিসাবে দেখা যায়।
হরিজন থেকে দলিত – এই রূপান্তরের মধ্যে নিহিত রয়েছে অস্পৃশ্যদের আত্মোপলব্ধির সমগ্র প্রক্রিয়াটি। আর এই রূপান্তরের পিছনে প্রধান প্রেরণা হিসাবে থেকেছেন আম্বেদকর স্বয়ং। তিনিই সম্ভবত প্রথম দলিত নেতা যিনি দলিতদের সামাজিক জাগরণকে তাঁদের রাজনৈতিক আত্মঘোষণার রূপ দিতে যথেষ্ট সফল হয়েছিলেন।
আম্বেদকরের অপর গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনা। আধুনিক ভারত সম্পর্কে নেহরুর বীক্ষার তিনিও অংশীদার ছিলেন এবং কোনো কোনো দিক থেকে তিনি নেহরুর চেয়ে বেশি দূরদৃষ্টি দেখিয়েছিলেন। ভারতের আত্মাবিষ্কারের ওপর নেহরুর জোর দেওয়ার বিপরীতে তিনি ঘোষণা করেন, “আমরা যদি মনে করি যে আমরা একটা জাতি হয়ে উঠেছি, সেটা নিছকই কল্পনাবিলাস। আমরা জাতি হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় থাকার চেষ্টা করতে পারি মাত্র”।
তিনি সংবিধান-নির্ভর রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়ান, এক শক্তিশালী কেন্দ্রের কথা বলেন এবং এমন এক অর্থনৈতিক কর্মসূচির পক্ষে রায় দেন যার মূল কথা হবে জমির জাতীকরণ ও সমবায় ভিত্তিতে চাষের জন্য তা কৃষকদের মধ্যে বণ্টন তথা বুনিয়াদী শিল্পের জাতীয়করণ। তিনি বিশ্বাস করতেন, নিপীড়িত শ্রেণীগুলির অনুকূলে রাষ্ট্রের কল্যাণমূলক পদক্ষেপগুলির পাশাপাশি ঐরকম এক অর্থনৈতিক কর্মসূচি ‘জাতের বিলোপ’ ঘটাবে, আর সেটাই ছিল তাঁর অন্তিম লক্ষ্য।
দলিতদের সামাজিক মুক্তির জন্য সংগ্রামই ছিল তাঁর জীবনের ধ্যানজ্ঞান। তাই রক্ষণশীল শক্তিগুলির চাপে নেহরু হিন্দু নাগরিক আইনসংক্রান্ত বিলে সম্মতি দেওয়ার পর তিনি নেহরুর সঙ্গ ত্যাগ করেন। এই ঘটনায় আম্বেদকরের এই ধারণা আরও দৃঢ়মূল হয় যে জাতপাত হিন্দু ধর্মের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, আর তাই এর সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছেদ করা ছাড়া দলিতদের গত্যন্তর নেই।
এই কারণে তিনি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি এই ধর্মের এক আধুনিক ব্যাখ্যা দেন ও আশা প্রকাশ করেন যে তা দলিতদের মধ্যে এক সামাজিক-সাংস্কৃতিক জাগরণের জন্ম দেবে। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জগতে তিনি নিপীড়িত শ্রেণীগুলির স্বাধীন গণতান্ত্রিক দল হিসাবে রিপাবলিকান পার্টি গড়ে তোলেন।
এইভাবে আম্বেদকরের সংগ্রাম তার চরম শিখরে পৌঁছায়। দুর্ভাগ্যবশত, একমাত্র তাঁর নিজের সম্প্রদায় মাহাররাই তাঁর সঙ্গে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। আর তাঁর মৃত্যুর পর রিপাবলিকান পার্টির মধ্যে প্রতিফলিত তাঁর রাজনৈতিক আন্দোলন বিভাজনের সম্মুখীন হয় এবং কংগ্রেস তাকে গ্রাস করে নেয়।
শ্রেণীগত বিচারে আম্বেদকর দলিতদের পেটিবুর্জোয়া অংশেরই প্রতিনিধিত্ব করেন, যার মধ্যে ছোটো ও মাঝারি কৃষকরাও রয়েছেন। তাঁদের নির্দিষ্ট আর্থ-সামাজিক অবস্থানের মধ্যেই রয়েছে আম্বেদকরের রাডিক্যালিজমের শিকড়, আবার সেটাই তাঁর সীমাবদ্ধতারও উৎস। তৎকালীন পরিস্থিতিতে তিনি কেবলমাত্র পুঁজিবাদের পরিপূর্ণ বিকাশ ও এক কল্যাণমূলক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের জন্যই প্রচেষ্টা চালাতে পারতেন, যা যুগ-সঞ্চিত স্থবিরতা ও জড়তা কাটাতে হাতিয়ার হিসাবে কাজ করবে। কমিউনিস্ট অনুশীলনের কিছু কিছু দিক সম্পর্কে অনুমোদনসূচক উল্লেখ ও সমাজতান্ত্রিক পরিভাষার ব্যবহার তাঁর র্র্যাডিক্যাল বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক মর্মবস্তুরই পরিচায়ক। এর অর্থ কিন্তু আম্বেদকরকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো নয়, বরং এই মূল্যায়ন তাঁকে সমকালের অনেক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের চেয়ে উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত করে, যাঁরা আম্বেদকরের নিজের ভাষায় “ব্রাহ্মণ-বেনিয়া আঁতাতকে” অক্ষুণ্ণ রেখে পুঁজিবাদী বিকাশের এক রক্ষণশীল পথের ওকালতি করতেন।
আম্বেদকরের দোদুল্যমানতা, তাঁর আপোশ ও শেষপর্যন্ত ধর্মানুশীলনকে আশ্রয় করা, এ সবকিছুরও মূলে রয়েছে তাঁর অস্তিত্বের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট। স্বাধীনতা আন্দোলনের এক বিকল্প রণনীতি রচনা করতে গিয়ে একজন দলিত পেটিবুর্জোয়া হিসাবে তাঁর সহজাত সীমাবদ্ধতা কখনও তাঁকে গান্ধী ও কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতায় যেতে, আবার কখনও ব্রিটিশের ওপর আস্থা রাখতে বাধ্য করেছে। এই বিকল্প রণনীতি রচনা করা সম্ভব ছিল একমাত্র কমিউনিস্টদের পক্ষেই, যাঁরা ছিলেন ভারতের গ্রামীণ ও শহুরে সর্বহারার প্রতিনিধি, যাঁদের একটা বড় অংশই দলিত। সব ধরনের র্র্যাডিক্যাল বুর্জোয়া গণতন্ত্রীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক আঁতাত এই বিকল্প রণনীতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হওয়া উচিত ছিল। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি এই দায়িত্ব গ্রহণে ব্যর্থ হয়। তবে সে এক ভিন্ন কাহিনী।
লেখকের আক্ষেপ, “আম্বেদকরবাদ বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক চেতনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে”, কেননা, “কৃষক শ্রেণী-উৎসের দ্বারা নির্ধারিত সীমাকে তিনি অতিক্রম করে যেতে পারেননি”।
যে সীমানা অতিক্রম করতে আম্বেদকর ব্যর্থ হয়েছেন, তা অতিক্রম করতে আমাদের লেখক এক দুঃসাহসিক তাত্ত্বিক অভিযানে নেমেছেন। তিনি শুরু করেছেন এক বিচিত্র বিশ্লেষণ দিয়ে।
“আম্বেদকরবাদের ভিত্তি এমন কোনো শ্রেণীর মধ্যে ছিল না যা পূর্ণ ঊর্ধ্বগতিসম্পন্ন – যে শ্রেণীর, বা এমনকি সেই শ্রেণীভুক্ত ব্যক্তিবিশেষ বা কোনো ক্ষুদ্র অংশের পক্ষে বুর্জোয়া ব্যবস্থার সম্পূর্ণ অঙ্গীভূত হয়ে যাওয়া সম্ভব। তা ছিল এমন এক কৃষক সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী, যা অংশত সর্বহারাকরণের পথগামী ও অংশত সম্পত্তিচ্যুত, যার সর্বোচ্চ অংশেরও উন্নতির আকাঙ্খা অপূর্ণই থেকে গেছে। এই ব্যাপারটাই অস্পৃশ্য সম্প্রদায় ও শাসক বুর্জোয়া শ্রেণীর মধ্যে আঁতাতের সমস্ত প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়েছে। এই কারণেই শাসক শ্রেণীগুলির সঙ্গে প্রতিটি মুলাকাতই ডঃ আম্বেদকরকে তাদের কাছ থেকে আরও দূরে সরিয়ে দিয়েছে। এটাই আম্বেদকরবাদের মধ্যে বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার এক মহান সম্ভাবনা এনে দিয়েছে”।
এইভাবে ঐ সম্ভাবনাকে প্রতিষ্ঠা করার পর লেখক মার্কস, প্যারি কমিউন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে আম্বেদকরের কিছু অনুমোদনসূচক উল্লেখকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করেছেন। ব্রাহ্মণ্যবাদ ও পুঁজিবাদ এই দুই শত্রুর বিরুদ্ধে আম্বেদকরের সমালোচনা এবং একটি “সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচির” পক্ষে তাঁর রায়ের সঙ্গে মিলিয়ে এই সবকিছুকে সাম্যবাদের পথে আম্বেদকরের উত্তরণের পরিচায়ক হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এমনকি তাঁর বৌদ্ধধর্ম গ্রহণকেও ব্যাখ্যা করা হয়েছে সাধারণভাবে মার্কসবাদের ও নির্দিষ্টভাবে ভারতে তার অনুশীলনের তুলে ধরা সমস্যাবলীর সমাধান হিসাবে। তাঁর ধর্মীয়-রাজনৈতিক অনুশীলনকেও দেখানো হয়েছে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অগ্রদূত হিসাবে, মার্কসবাদী মতাদর্শে ও আন্দোলনে গণতান্ত্রিকতার পুনরুত্থানের অগ্রদূত হিসাবে। “একদিক থেকে আম্বেদকর কর্তৃক বৌদ্ধধর্ম পুনরুদ্ধার মাও-এর সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পূর্বসূরী”। এইভাবে আমাদের লেখক মার্কসবাদ ও আম্বেদকরবাদের সমন্বয়ের ভিত্তি স্থাপন করেছেন এবং পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে অত্যন্ত সুকৌশলে সেই কাজ সম্পন্ন করেছেন।
লেখক গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করেছেন যে, “আম্বেদকরের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা চালু করা হল এবং কংগ্রেস ‘সমাজতন্ত্রকে’ বরণ করল। অনগ্রসর শ্রেণীগুলির জন্য সংরক্ষণের জন্য কাকা কালেলকর কমিশন গঠিত হল। প্রায় ঐ সময়েই নেহরু সরকার দিল্লীতে বুদ্ধের ২৫০০তম মহাপরিনির্বাণ বার্ষিকী উদযাপন করে। ... সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সহযোগিতাও বৃদ্ধি পায়”। এরপরই তিনি এর এক উদ্ভট ব্যাখ্যা হাজির করেছেন, “ভারতের শাসকশ্রেণীগুলি স্তালিনের সঙ্গে আপোশ করে নিয়ে আম্বেদকরকে উৎখাত করে”।
আম্বেদকর-উত্তর পর্যায়ের ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করতে গিয়ে লেখক বিভিন্ন অনগ্রসর জাতের অগ্রগতি সঠিকভাবেই লক্ষ্য করেছেন।
“কেরলে সংখ্যাগত দিক থেকে শক্তিশালী শূদ্র সম্প্রদায় সাবর্ণ গোষ্ঠীতে উন্নীত হয়েছে, বিশেষত এই কারণে যে ব্রাহ্মণ-কায়স্থ-বেনিয়া সম্প্রদায় সংখ্যাগতভাবে নগণ্য। যে নায়ার সম্প্রদায়কে এককালে “দেবতারা” দূষিত বলে মনে করত, তারাই এখন প্রায় “পৃথিবীর বুকে দেবতার” সমতুল। ... এঝাভা নামক অপর এক অস্পৃশ্য সম্প্রদায়ও এখন আর্থ-সামাজিক মানদণ্ডে অনেক এগিয়ে গেছে”।
কেরলের ক্ষেত্রে যে কথা খাটে, ভারতের অন্যান্য অংশেও সে কথা বিভিন্ন মাত্রায় খাটে। ভূমি-সংস্কার তথা আর্থ-সামাজিক অন্যান্য পদক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে ব্রাহ্মণ্যবাদ-বিরোধী বিভিন্ন আন্দোলনের ফলেই বেশ কিছু অনগ্রসর জাতের এই অগ্রগতি ঘটেছে। হিন্দী বলয়ে এই কৃতিত্ব মূলত লোহিয়াবাদী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের।
সমাজে যে কোনো সামাজিক-রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের সঙ্গে সঙ্গে অবশ্যম্ভাবীভাবেই শাসক শ্রেণীগুলির সামাজিক গঠন ব্যাপকতর ভিত্তিতে পুরর্গঠিত হয়। ব্রিটিশ-উত্তর ভারতও কেবল ব্রিটিশ যুগের পুরোনো সামাজিক আঁতাতের ভিত্তিতে টিকে থাকতে পারত না। সুতরাং কয়েকটি অনগ্রসর জাতের এই অগ্রগতি ও তাদের সুবিধাভোগী অংশের শাসক শ্রেণীগুলিতে স্থান পাওয়া ছিল এক অবশ্যম্ভাবী প্রক্রিয়া। কোনো কোনো রাজ্যে অগ্রসর-অনগ্রসর মেরুকরণ স্পষ্টতর করা ছাড়াও এই প্রক্রিয়া এতদিনকার অনগ্রসর সম্প্রদায়গুলির মধ্যেই ক্রমবর্ধমান জাত-শ্রেণী বিভাজনের জন্ম দেয়। ক্ষেতমজুর প্রধান দলিত সম্প্রদায় ও কৃষিতে বিকাশনীতির সর্বাধিক সুবিধাভোগী মধ্যবর্তী জাতের সম্পন্ন কৃষকদের মধ্যে সংঘাতের তীব্রতা বৃদ্ধিও এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।
লেখক অবশ্য কিছু দলিত জাত, গোষ্ঠী ও ব্যক্তিবিশেষের শাসনব্যবস্থার অঙ্গীভূত হয়ে পড়ার ঘটনাকে ধূর্ত ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসক শ্রেণীগুলির “সুচতুর চালের” ফলশ্রুতি হিসাবেই ব্যাখ্যা করেছেন। দলিত জাত বলতে লেখক অস্পৃশ্য ও শূদ্র জাতগুলির, অর্থাৎ সরকারি ভাষায়, তফশিলী জাতি, উপজাতি ও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণীর সামগ্রিকতাকেই বোঝাতে চেয়েছেন এবং তিনি এমন এক তাত্ত্বিক অনুশীলনের সন্ধান করেছেন যা এক দলিত মহা-ঐক্যের বার্তাবহ। আর এটি তিনি খুঁজে পেয়েছেন বহুজন সমাজ পার্টির মধ্যে।
“রিপাবলিকান আন্দোলন ধাক্কা খায় যুক্তমোর্চার প্রশ্নটিতে এসে। ডঃ আম্বেদকরের রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল বঞ্চিত শ্রেণীগুলির শাসক শ্রেণী হয়ে ওঠা, আর এই উদ্দেশ্যেই এই পার্টির জন্ম। কিন্তু সমাজের নিপীড়িত অংশগুলির প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক শক্তিগুলির সঙ্গে আঁতাত ছাড়া সেটা সম্ভব নয়। ডঃ আম্বেদকর ঐ দিশা দিতে পারেননি, তাঁর পার্টিও এই রণনীতি উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়নি। যেটুকু আঁতাত তাঁরা করেছেন তা ছিল ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকশ্রেণীর পার্টিগুলির সঙ্গে। এর বিকল্প ছিল পার্টির কাঠামোটিকেই বিভিন্ন শোষিত ও নিপীড়িত শ্রেণী ও সম্প্রদায়ের যুক্তমঞ্চ হিসাবে খাড়া করা। বহুজন সমাজ পার্টি ঠিক এটাই করতে পেরেছে। এইভাবে বিএসপি আম্বেদকরপন্থী অনুশীলনের ক্ষেত্রে এক বিশেষ তাত্ত্বিক অগ্রগতি হিসাবে হাজির হয়েছে। বিএসপি-র লক্ষ্য তফশিলী জাতি, উপজাতি ও অনগ্রসর শ্রেণী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলিকে নিয়ে এক ব্যাপকতর মঞ্চ গড়ে তোলা। ‘বিভেদ সৃষ্টি করে শাসন কর’ ভারতের শাসক শ্রেণীগুলির এই রাজনীতির এটাই সবচেয়ে শক্তিশালী তাত্ত্বিক জবাব”।
তা ক্রমবর্ধমান সামাজিক বিভাজনের মোকাবিলা করে লেখকের সাধের দলিত মহা-ঐক্য গড়ে তুলতে ও তাকে টিকিয়ে রাখতে বিএসপি কতদূর সফল হবে সেটা দেখা এখনও বাকি, কিন্তু প্রয়োজনবাদী এক জগাখিচু়ড়িকে আম্বেদকরকে পেরিয়ে যাওয়া এক বিরাট তাত্ত্বিক অগ্রগতি হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টা চূড়ান্ত তাত্ত্বিক বাতুলতা। ডঃ আম্বেদকর সমাজের নিপীড়িত অংশগুলির প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক শক্তিগুলির সঙ্গে আঁতাতের দিশা দিতে পারেননি এবং ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকশ্রেণীর পার্টিগুলিকেই আঁকড়ে থেকেছেন, লেখকের এই অভিযোগ আম্বেদকরের এক অনৈতিহাসিক মূল্যায়নকেই শুধু নয়, সত্যেরও অপলাপ।
বিএসপি-কে “সবচেয়ে শক্তিশালী তাত্ত্বিক জবাব” ইত্যাদি আখ্যা দেওয়ার অব্যবহিত পরেই এক নিখুঁত তাত্ত্বিক ডিগবাজি খেয়ে লেখক চলে গেছেন জনতা দলের প্রশংসায়। তাঁরা নাকি “মণ্ডল-মসজিদ প্রচার ধারাকে” সামনে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে “(বিএসপি-র) অনুরূপ মঞ্চকে” ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করেছেন। উপরন্তু, ওপর থেকে আসা জনতা দলের এই উদ্যোগ তৃণমূল স্তরে কাঁসিরামের সংগ্রামের চেয়ে বেশি সাড়া জাগিয়েছে। তাছাড়া, বিএসপি-র পার্টিজান আচরণ দলিত সম্প্রদায়ের বাইরে কোনো মিত্র জোটাতে পারেনি (গুরুত্ব আমাদের)। সমস্ত নিপীড়িত সম্প্রদায়ের সাধারণ স্বার্থের প্রতিভু এক সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট সামাজিক ন্যায়ের মঞ্চকে তুলে ধরতে জনতা নেতৃত্বকে বাধ্য করা নিঃসন্দেহে এক বিরাট রাজনৈতিক কৃতিত্ব। উত্তর ভারতের জঙ্গী সমাজবাদী ঐতিহ্যই এই মতাদর্শগত অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়”।
জনতা দলের প্রায় মুখপাত্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে লেখক জনতা দলের সামাজিক ন্যায়ের মঞ্চের সাফল্যের এক তালিকা হাজির করেছেন। আম্বেদরকে ভারতরত্ন প্রদান, তাঁর জন্মশতবর্ষ উদযাপন উৎসবের আয়োজন, গ্রামাঞ্চল এবং তফসিলী জাতি ও উপজাতির জন্য আনুপাতিক যোজনা বরাদ্দ, বাঁধা মজুর, ঠিকা মজুর ও ক্ষেত মজুরদের জন্য পর্যাপ্ত সাহায্যদান, সংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্য সাহায্য (প্রস্তাবিত), কাজের অধিকারকে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতিদান (প্রস্তাবিত), কৃষকদের জন্য ব্যাপক সুযোগসুবিধা, বিরাট সাক্ষরতা অভিযান (প্রস্তাবিত), নিপীড়িত জাতিগুলির জন্য কিছু হাঁফ ছাড়ার সুযোগ, বাবরি মসজিদ প্রশ্নে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলির বিরুদ্ধে দৃঢ় পদক্ষেপ, ইত্যাদি। বিহারের জনতা সরকারের বিশেষ প্রশংসা করা হয়েছে, কেননা তারা বিচারবিভাগকেও সংরক্ষণের অধীনে এনেছে এবং তফশিলী জাতি ও উপজাতির জন্য আনুপাতিক যোজনা বরাদ্দের নীতি বাস্তবে রূপায়ন করেছে। লেখকের মতে, “এই সমস্ত পদক্ষেপের পথ ধরেই আসে মণ্ডল কর্মসূচি। এই রাজনৈতিক স্লোগান ও নির্দিষ্ট দিশা স্থিতাবস্থার শক্তিগুলির কাছে এক বাস্তব বিপদ হিসাবে হাজির হয়। এরই ফলে শাসক শ্রেণীগুলি জনতা দলকে ক্ষমতাচ্যুত করার ও ধ্বংস করার চক্রান্ত করতে শুরু করে”। এখন, উল্লিখিত পদক্ষেপগুলির পথ ধরেই মণ্ডল কর্মসূচি আসে, নাকি এক ৠাডিক্যাল আর্থ-সামাজিক কর্মসূচির বিনিময়ে, বিশেষত কাজের অধিকারকে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি এড়াতেই এর উপস্থাপনা, সে প্রশ্নের মীমাংসা এখনও বাকি। এই রাজনৈতিক স্লোগান ও নির্দিষ্ট দিশা স্থিতাবস্থার শক্তিগুলির কাছে এক বাস্তব বিপদ হিসাবে হাজির হয়, নাকি কিছু কিছু অনগ্রসর শ্রেণীর ক্রমবর্ধমান আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিপত্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে ক্ষমতার কাঠামোয় নতুন ভারসাম্য আনার হাতিয়ার হিসাবে এর জন্ম, সে প্রশ্নও এখনও বিচারসাপেক্ষ। কংগ্রেস সরকার কর্তৃক মণ্ডল সুপারিশগুলির রূপায়ন দ্বিতীয় সম্ভাবনাটিকেই প্রতিষ্ঠিত করেছে। জনতা দলের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হিসাবে অবশিষ্ট আছে সুবিধাভোগী স্তরের ধারণার বিরোধিতা করা, যা এই প্রক্রিয়ায় তার প্রকৃত মর্মবস্তুকেই উন্মোচিত করেছে।
আমাদের লেখকের মতে অবশ্য মণ্ডল এমন এক কেন্দ্রীয় বিষয়, যা শুধুমাত্র ভারতীয় সমাজেই নয়, কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যেও মেরুকরণ ঘটিয়েছে।
“দলিতদের মধ্যে ভিত্তিসম্পন্ন এই (নকশালপন্থী) আন্দোলনগুলি মণ্ডল সংরক্ষণকে এক গণতান্ত্রিক পদক্ষেপ হিসাবে সমর্থন করেছে, আর শহুরে শ্রমিকদের মধ্যে ভিত্তিসম্পন্ন প্রথাগত কমিউনিস্টরা মণ্ডলের বিরোধিতা করেছে”। “প্রথাগত কমিউনিস্ট পার্টিগুলি দ্বিধায় পড়ে, এবং সিপিআই(এম) নেতৃত্ব ও এমনকি নকশালপন্থী সংগঠন ইন্ডিয়ান পিপলস ফ্রন্টও কংগ্রেস ও বিজেপির তুলে ধরা ‘অর্থনৈতিক মানদণ্ডের’ দিকেই ঝোঁকে”।
নিজের তাত্ত্বিক কাঠামোর সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য তথ্যকে বিকৃত করার এটা একটা স্পষ্ট নিদর্শন। মণ্ডল ইস্যুতে সিপিআই জনতা দলকে পুরোপুরি সমর্থন জানায়, এমনকি সুবিধাভোগী স্তর সংক্রান্ত রায় ও তথাকথিত অর্থনৈতিক মানদণ্ডেরও তারা প্রকাশ্যে বিরোধিতা করে। সিপিআই(এম) কখনই মণ্ডল সুপারিশের বিরোধিতা করেনি। অনগ্রসর জাতগুলির মধ্যে স্তরবিভাগের পরিপ্রেক্ষিতেই তারা অর্থনৈতিক মানদণ্ডের কথা বলেছে, আর তাই তারা সুবিধাভোগী স্তরের রায়কেও স্বাগত জানায়। ইন্ডিয়ান পিপলস ফ্রন্ট কখনই অর্থনৈতিক মানদণ্ডের দিকে ঝোঁকেনি। তারা বরং উচ্চবর্ণের অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর অংশের জন্য ১০ শতাংশ সংরক্ষণের ওকালতি করায় ভি পি সিং-এর সমালোচনা করে, এবং এই দৃঢ় অবস্থান নেয় যে সামাজিক ও শিক্ষাগত অনগ্রসরতাই সংরক্ষণের একমাত্র ভিত্তি হতে পারে।
আমাদের পার্টি অবশ্যই সুবিধাভোগী স্তরের রায়কে স্বাগত জানিয়েছিল কারণ শক্তিশালী অনগ্রসর সম্প্রদায়গুলির মধ্যে শ্রেণীবিভাজনকে ত্বরান্বিত করে এমন যে কোনো পদক্ষেপকেই মার্কসবাদীরা স্বাগত জানায়। আমরা জানতাম যে ক্ষমতার কাঠামোয় এক পুনর্বিন্যাসের পরিস্থিতি পেকে উঠেছিল, ভি পি সিং-এর ভূমিকা ছিল কেবল অনুঘটকের। তাই আমরা মণ্ডলকে কোনো সমাজবিপ্লবের অগ্রদূত হিসাবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করি, এক বুর্জোয়া-জমিদার গঠন হিসাবে জনতা দলের ভণ্ডামির স্বরূপ উন্মোচন করতে থাকি এবং আমাদের পার্টির মতাদর্শগত-রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক স্বাধীনতাকে সযত্নে রক্ষা করে চলি।
অনগ্রসরবাদের শক্তিশালী প্রত্যাঘাত সত্ত্বেও, বিহারে জনতা দল আমাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ কেন্দ্রীভূত করা সত্ত্বেও এবং কয়েকজন বিধায়কের দলত্যাগ করে জনতা দলে যোগ দেওয়ার মতো মূল্য দিয়েও, আমাদের পার্টি তার অবস্থানে দৃঢ় থাকে। মণ্ডল উচ্ছ্বাস থিতিয়ে আসার পর আমাদের পার্টি আবার বিহারে দ্রুত অগ্রগতির পথে ফিরে এসেছে। বিপরীতে, জনতা দলের ধামা ধরে সিপিআই-এর প্রথাগত গণভিত্তি আজ প্রায় নিঃশেষ হতে চলেছে, তারা এখন বিভাজনের ও সম্পূর্ণ দিশাহীনতার বিপদের সম্মুখীন।
লেখক জনযুদ্ধ গোষ্ঠীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ, কারণ “তারা এ প্রশ্নে বিচারবিভাগের ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে অন্ধ্র বনধ ডাকে। ... মণ্ডল ইস্যুর সমর্থনে জনযুদ্ধ গোষ্ঠীর সভায় জনতা দল নেতারা ভাষণ দেন”। অন্য যে নকশাল গোষ্ঠীটি লেখকের প্রশংসা অর্জন করেছে তা অবশ্যই এমসিসি, তারাই নাকি “বিহারে উচ্চবর্ণের অত্যাচারের বিরুদ্ধে দলিতদের প্রতিরোধে” নেতৃত্ব দিচ্ছে। আমরা সত্যশোধক কমিউনিস্ট পার্টিরও উল্লেখ দেখতে পাই, যারা নাকি মার্কস-ফুলে-আম্বেদকরের মতাদর্শ অনুসরণ করে “সংসদীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের সামনে এক মতাদর্শগত চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে”।
এইভাবে লেখক তাঁর সংশ্লেষণ প্রকল্পের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছেন, এবং এখানে এসে তিনি তাঁর ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। উদাহরণস্বরূপ তুলে ধরা যাক একটি অতুলনীয় রত্নকে : “দলিত বিদ্রোহের সঙ্গীত যখন আকাশে-বাতাসে অনুরণন তুলছে, (দলিত) প্যান্থার, নকশালপন্থী ও (খালিস্তানী ও কাশ্মীরী) জঙ্গীদের অগ্নিঝঞ্ঝা তখন এক তাত্ত্বিক রূপরেখার সন্ধান পেল। দলিত সেনা ও আম্বেদকর শতবার্ষিকী সমারোহের মধ্যে দিয়ে রামবিলাস পাসোয়ান তত্ত্ব ও অনুশীলনের এই উদীয়মান ঐক্যকেই ধরার চেষ্টা করেছেন”।
আম্বেদকর থেকে কাঁসিরাম হয়ে রামবিলাস পাসোয়ান! নিঃসন্দেহে এ এক অপূর্ব উত্তরণ!
জাত সম্বন্ধে লেখক কিছু অভিনব ধারণা উপস্থিত করেছেন। “মার্কস যেখানে জাতপ্রথাকে ভারতের শক্তি ও প্রগতির পথে নির্ধারক বাধা হিসাবে দেখেছেন, সেখানে তাঁরা (ভারতীয় মার্কসবাদীরা) জাতকে উপরিকাঠামোর ব্যাপার বলেই গণ্য করেছেন। ... ... জাত হল একটি উৎপাদন সম্পর্ক, সুতরাং তা উপরিকাঠামোর ব্যাপার নয়, বরং আর্থ-সামাজিক কাঠামোরই অন্তর্ভুক্ত। ভারতীয় মার্কসবাদীদের সবচেয়ে বড় তাত্ত্বিক ব্যর্থতা হল জাতকে সমাজের মূল কাঠামোর বিষয় হিসাবে গণ্য করতে অস্বীকার করা”। তা মার্কসবাদী আলোচনায় আমরা অর্থনৈতিক ভিত্তি আর তার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা উপরিকাঠামোর কথা অবশ্যই শুনেছি, কিন্তু আর্থ-সামাজিক ভিত্তি বলে কিছু তো কখনও শুনিনি। জাতকে সামাজিক তথা অর্থনৈতিক ভিত্তির সঙ্গে যুক্ত করতে গিয়ে লেখক নিজেই বিভ্রান্ত বলে মনে হয়। এই দ্বৈতচরিত্রকে এইভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে :
“এক্ষেত্রে, একদিকে উৎপাদনের উপকরণ ও পেশার স্থায়ী বিভাজনের প্রতিষ্ঠান হিসাবে জাতপ্রথা ও অন্যদিকে অস্পৃশ্যতা ও বৈষম্যের মানসিকতা হিসাবে জাতপ্রথা, এই দুইয়ের মধ্যে আমাদের পার্থক্য করতে হবে। জাতপ্রথার মধ্যে এই উভয় দিকই বর্তমান। প্রথমটি ভিত্তি এবং দ্বিতীয়টি উপরিকাঠামোর অন্তর্ভুক্ত”।
বস্তুত, অর্থনৈতিক উদ্বৃত্তের উদ্ভবের সঙ্গে সঙ্গে সাম্যভিত্তিক সমাজগুলি শ্রেণীসমাজে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং পরবর্তী সমস্ত সমাজের ইতিহাসই হল শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাস। প্রাক-পুঁজিবাদী সমাজে অবশ্য উদ্বৃত্ত থেকে সৃষ্ট এই বৈষম্যের সামঞ্জস্য বিধান হত এক সামাজিক স্তরবিন্যাসের মাধ্যমে, যা সামাজিক সম্প্রদায় (সোশ্যাল এস্টেট) নামে পরিচিত। জনগোষ্ঠীগুলির অভ্যন্তরীণ সংহতি চিরায়ত অর্থে শ্রেণী গঠনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। উপরন্তু, অর্থনীতি-বহির্ভূত বলপ্রয়োগের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক গঠন এই সামাজিক সম্প্রদায়গুলিকে দীর্ঘস্থায়ী করেছে। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে জাতপ্রথায় দৈবমহিমা আরোপ ও বিশেষত স্বৈরাচারী কেন্দ্রীয় শাসন ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামসমাজগুলির সহাবস্থান এই স্তরবিন্যাসকে আরও বেশি স্থায়িত্ব দিয়েছে।
উৎপাদনের ধরনের মধ্যেই শ্রেণীর উৎস। বিভিন্ন শ্রেণীর অস্তিত্বের অর্থনৈতিক শর্তাবলীই তাদের পরস্পর বৈরী সম্পর্কে আবদ্ধ করে এবং এই প্রক্রিয়ায় সমাজে শ্রেণীবিভাজনকে ত্বরান্বিত করে। বিপরীতে, সামাজিক সম্প্রদায় বা জাতগুলি বণ্টনের ধরনকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং ফলে ‘বিশুদ্ধ’ বর্গ হিসাবে শ্রেণী গঠনে বাধা দেয়। সমস্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্যেই শ্রেণীসংগ্রাম নিহিত থাকে এবং এইভাবে তা বহু জটিল রূপ নেয়।
আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজ শ্রেণীবিভাজনের এই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। এই প্রথম শ্রেণীগুলির আত্মোপলব্ধির এবং প্রকাশ্য শ্রেণীযুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। ভারতবর্ষেও পুঁজিবাদের উদ্ভব ও বৃহদায়তন শিল্প উৎপাদন এই প্রথম জাত-পেশায় ভাঙন ধরায় এবং এক নতুন শ্রেণী আত্মপ্রকাশ করে, সে হল শিল্পীয় সর্বহারা। বাগিচা, খনি, বস্ত্র ও পাটশিল্পে নিযুক্ত প্রথম প্রজন্মের সর্বহারাদের অধিকাংশই এসেছিলেন অস্পৃ্শ্য ও শূদ্র জাতগুলি থেকে। পরবর্তীকালে উচ্চতর জাতের মানুষেরাও তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন।
এইভাবে কারখানাগুলি হয়ে ওঠে জাতপ্রথার বিলোপের সম্ভবনাময় এক সামাজিক কারখানাও। রক্ষণশীল পথে ভারতীয় পুঁজিবাদের বিকাশ শ্রেণীবিভাজনের এই প্রক্রিয়াকে কিছুটা মন্থর করে তোলে। নতুন প্রতিপত্তিশালী সামাজিক শ্রেণীগুলি রাজনৈতিক ক্ষমতায় তাদের বখরার জন্য লড়াইয়ে জাতপাতের সমীকরণকে কাজে লাগানোর ফলে সংসদীয় গণতন্ত্রের অধীনে জাতপ্রথা আরও স্থায়িত্ব অর্জন করে। সুবিধাবাদী বামপন্থীদের অর্থনীতিবাদ ও সংসদসর্বস্বতা শ্রমিকশ্রেণীর আত্মসচেতনতাকে কলুষিত করে। তা সত্ত্বেও, উচ্চবর্ণপ্রধান বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের বিপরীতে শ্রমিকশ্রেণী আজও জাতগত সত্তার বিলোপের এক প্রধান আধার। বিশ্বায়ন ও উদারনীতিকরণের নতুন যুগ শ্রমিকশ্রেণীর সংগঠিত অংশটিকেও অসংগঠিত করে তুলতে শুরু করেছে। সুপ্তোত্থিত শ্রমিকশ্রেণীও তার ঐতিহাসিক ব্রতে আবার ব্রতী হয়ে উঠছে।
অতএব, শ্রেণীই হল বুনিয়াদী বর্গ। কোনো বিশেষ ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে জাত রূপেই তা অভিব্যক্ত হতে পারে, আবার অন্য কোনো পরিস্থিতিতে এই দুই বর্গ এমনভাবে জড়িয়ে থাকে যে তারা পরস্পরের মধ্যে ঢুকে যায় আবার পরস্পরকে ছেদও করে। আবার সম্পূর্ণ পৃথক কোনো পরিস্থিতিতে, জাতগুলি ভেঙে গিয়ে শ্রেণী হিসাবে দানা বাঁধতে পারে। এইভাবে উভয়ের মধ্যে বৈপরীত্য চলতেই থাকে, যতদিন না বিনিময়ের ধরনের নিয়ন্ত্রক হিসাবে জাতের অবসান ঘটে।
আমাদের লেখকপ্রবর অবশ্য ভিন্ন মত পোষণ করেন। ভারতীয় পরিস্থিতিতে ইউরোপীয় বর্গগুলিকে যান্ত্রিকভাবে প্রয়োগ করার জন্য তিনি ভারতীয় কমিউনিস্টদের নিন্দা করেছেন এবং ভারতে শিল্পীয় সর্বহারা খোঁজাটা আদৌ সঠিক কিনা সেই প্রশ্ন তুলেছেন। “তাঁরা (মার্কসবাদীরা) যাঁদের সর্বহারা বলে ধরে নিয়েছেন, ভারতের সেই শিল্প-শ্রমিকশ্রেণী আদতে সর্বহারাই নন। রূপোর চামচ মুখে নিয়েই এই শ্রেণীর জন্ম। জাত পরম্পরার ওপরের দিকেই এর অবস্থান। গ্রামে ও শহরে এদের শুধু ভূসম্পত্তিই ছিল না, এমনকি সাধারণ মানুষ যা থেকে বঞ্চিত সেই মেধাসম্পদেরও এরা ছিল উত্তরাধিকারী। শৃঙ্খল ছাড়া যাদের হারাবার কিছুই নেই, সেই অধিকারচ্যুত সর্বহারাশ্রেণী এটি ছিল না। এটি ছিল এমন এক শ্রেণী যার জঙ্গী মানসিকতা ও চরমপন্থার মূলে ছিল ধনী কৃষক চেতনা, আর গ্রামীণ ভারতে কুলাক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে সেই জঙ্গীপনার অবসান হয়”।
লেখক ভারতীয় ও পশ্চিমী বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এক অদ্ভুত পার্থক্যরেখা টেনেছেন। “মানসিক শ্রমশক্তি ছাড়া পশ্চিমী বুদ্ধিজীবীদের আর কিছুই নেই। ভারতবর্ষে জ্ঞান ধর্ম ও দর্শনের সীমা ছাড়িয়ে যায় এবং বস্তুগত উৎপাদন ও সমাজের জগতে প্রবেশ করে। বিজ্ঞান, জ্ঞান ও দক্ষতা কায়িকশ্রম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ায় প্রাধান্য অর্জন করে। ... তাই ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের পক্ষে শ্রেণীচ্যুত হওয়া অত্যন্ত কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে”। এইসব অর্থহীন কথাবার্তার মাথামুণ্ডু উদ্ধার করা দুষ্কর। পশ্চিমী বুদ্ধিজীবীদের এই নির্লজ্জ প্রশস্তি অবশ্য শ্রী লেখকের ‘শ্রেণীচ্যুত’ হয়ে পড়ারই পরিচায়ক। তথাকথিত মানসিক শ্রমশক্তির (!) অধিকারী পশ্চিমী বুদ্ধিজীবীরা মূলত বু্র্জোয়া সমাজের সেবায় নিযুক্ত বুর্জোয়া ও পেটিবুর্জোয়া বুদ্ধিজীবী ছাড়া কিছুই নন। শ্রমিকশ্রেণীর প্রকাশ্য শ্রেণীযুদ্ধ তাঁদের মধ্যে বিভাজনের সৃষ্টি করে এবং তাঁদের একাংশ শ্রমিকশ্রেণীর পক্ষে যোগ দেন। মার্কস, লেনিন ও অন্যান্য অসংখ্য বুদ্ধিজীবী এই অংশেরই প্রতিনিধি। সর্বহারা বিপ্লব কিন্তু বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের কাছ থেকে তীব্র প্রতিরোধেরই সম্মুখীন হয়ে এসেছে, এবং এখনও হচ্ছে।
বিপরীতে, ভারতীয় পেটিবুর্জোয়া সম্প্রদায় তাদের দোদুল্যমানতা ও উচ্চবর্ণের প্রতি পক্ষপাত সত্ত্বেও অনেক বেশি সংখ্যায় প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ও বাম আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। বিশেষ করে নকশাল আন্দোলন এক বিরাট সংখ্যক পেটিবু্র্জোয়া যুবককে দলিত ভূমিহীন কৃষকদের সঙ্গে একাত্ম করে তুলেছে।
শিক্ষিত দলিতরা ব্রাহ্মণ্যবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ার ও রাষ্ট্রের উৎকোচ এবং সুযোগসুবিধায় লালিত হয়ে দলিত অভিজাততন্ত্রে পরিণত হওয়ার বিপদ সম্বন্ধে লেখক অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি তুলনা টেনেছেন ভারতীয় দলিত ও পশ্চিমী সর্বহারার মধ্যে! “সাম্প্রতিক অতীতেও যন্ত্র ও শ্রমজাত পণ্যের ওপর তাঁদের যে কর্তৃত্ব ছিল তা পুনরুদ্ধার করতেই সর্বহারা সংগ্রামে নামে। দলিতরা কিন্তু বহু প্রজন্ম ধরেই অধিকারচ্যুত। অতীতের গৌরব, মহিমা ও আত্মসম্মান বিপ্লবী সর্বহারার স্মৃতিতে সমুজ্জ্বল। কিন্তু প্রজন্ম পরম্পরায় দাসত্ব, অস্পৃশ্যতা ও গোলামীর আবর্তে হারিয়ে যাওয়া মানবিক পরিচয় পুনরুদ্ধারের জন্যই দলিতদের সংগ্রাম। তাঁদের আদর্শচ্যুত করতে ও দলে টানতে শাসকশ্রেণীর যে চক্রান্ত, তার শিকার হয়ে পড়ার মতো দুর্বলতা এই শ্রেণীর ছিল”। অদ্ভুত যুক্তি! পশ্চিমের সবকিছুই ভালো, ভারতের সবকিছুই খারাপ। সমাজগণতন্ত্রের সামাজিক ভিত্তি হিসাবে শ্রমিক অভিজাততন্ত্রের একটা স্তর পশ্চিমেই তাহলে আত্মপ্রকাশ করেছিল কী করে? ভারতে বিপ্লবী সংগ্রামে দলিতরাই বা কী করে ধারাবাহিকভাবে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন? শ্রমজীবী জনগণের একটা অংশ সবসময়েই প্রচলিত ব্যবস্থার অঙ্গীভূত হয়ে পড়েন, এর মধ্যে পূর্ব-পশ্চিম বলে কিছু নেই। লেখকের বিশ্লেষণে, সমগ্র দলিত শ্রেণীই “শাসকশ্রেণীর চক্রান্তের শিকার হয়ে পড়ার মতো দুর্বল” বলে নিন্দিত। আশ্চর্যজনকভাবে লেখক এই শ্রেণীর ওপরেই তাঁর ভাষায় “দলিত গণতান্ত্রিক বিপ্লবের” নেতৃত্ব অর্পণ করেছেন।
ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকশ্রেণীগুলির বঞ্চনার শিকার সমস্ত জাত ও স্তরের সমগ্রটিকেই লেখক ‘দলিত’ হিসাবে চিহ্নিত করেন! আর তাই তিনি এক দলিত গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ওপর জোর দেন। উচ্চবর্ণ থেকে আসা সংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীরা এর কেবলমাত্র দোদুল্যমান ও অনির্ভরশীল মিত্রই হতে পারেন।
অনগ্রসর জাত ও নিপীড়িত সংখ্যালঘু জাতিসত্তাগুলির উদীয়মান বু্র্জোয়াদের নিয়ে গঠিত জাতীয় বুর্জোয়াশ্রেণী অবশ্য নিঃসন্দেহে এর দৃঢ় মিত্র হতে পারে। বিশেষত ক্রমবর্ধমান বিশ্বায়ন ও কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রব্যবস্থার ওপর ব্রাহ্মণ্য শ্রেণীগুলির ক্রমবর্ধমান কব্জার পরিপ্রেক্ষিতে এটা আরও বেশি সত্য।
দলিত জাতগুলি থেকে আসা গ্রামীণ সর্বহারা তথা অসংগঠিত ও অনিয়মিত (ইনফর্মাল) ক্ষেত্রের শ্রমিকশ্রেণী হবেন এই বিপ্লবের নেতা। আর গরিব কৃষক, আধা-সর্বহারা এবং দলিত ও শূদ্র জাতগুলি থেকে আসা ব্যাপক কৃষক জনতা হবেন এর সবচেয়ে একনিষ্ঠ মিত্র।
এইভাবে সমগ্র বিপ্লবটিকেই ওলটপালট করে দেওয়া হয়েছে। শ্রমিকশ্রেণী অনির্ভরশীল মিত্র, আর জাতীয় বুর্জোয়া দৃঢ় মিত্র! লেখকের দাবি, এই বিপ্লব ব্রাহ্মণ্য সমাজব্যবস্থাকে ধ্বংস করবে ও প্রকৃত গণতন্ত্রের পথ তৈরি করবে। কিন্তু লেখক যে ব্যাপারটা স্পষ্টতই এড়িয়ে গেছেন তা হল এই বিপ্লব কোন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে – পুঁজিবাদী না সমাজতান্ত্রিক?
লেখক এইভাবে “শ্রেণীসরলীকরণ” ও “শ্রমিকশ্রেণী কেন্দ্রিকতার” বিপরীতে সমস্ত অনগ্রসর জাত ও সম্প্রদায়ের যুক্তমোর্চার ধারণায় এসে পৌঁছেছেন। একে তিনি ঘোষণা করেছেন মার্কসীয় শাস্ত্রে বৃহত্তম অগ্রগতি হিসাবে। তা এটা মার্কসবাদের বৃহত্তম দুর্গতি বটে।
দলিত গণতান্ত্রিক বিপ্লবের নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক কর্মসূচিতে এসে লেখক আম্বেদকরের কর্মসূচিকে, অর্থাৎ জমির জাতীয়করণ ও বিশেষ রাষ্ট্রীয় সহায়তাসহ তা ভূমিহীন দলিত তথা ব্যাপক কৃষকের মধ্যে বণ্টনের ধারণাকে নাকচ করেছেন। লেখকের বক্তব্য, “দলিতরা উপলব্ধি করেছেন যে তাঁদের মুক্তি রয়েছে জমির মালিকানার মধ্যে, গ্রামীণ ভারতে এরই অর্থ ‘ক্ষমতা’।” আবার, “রাষ্ট্র কর্তৃক জাতীয়করণ করা জমি বণ্টনের যে পরামর্শ আম্বেদকর দিয়েছেন, তা একটি মূল বিষয়কেই ধরতে পারেনি। সেটা হল জনগণের চেতনা, যা জমির জন্য দলিতদের প্রত্যক্ষ সংগ্রামের মাধ্যমে এক গতিময় বস্তুগত শক্তিতে পরিণত হয়”। লেখকের পরামর্শ অনুযায়ী যা করণীয়, তা হল “ভূমিহীন ও স্বল্প জমিসম্পন্নদের কথামতো (!) জমি বণ্টনের মাধ্যমে কৃষি বিপ্লব। বিভিন্ন কৃষিজীবী সম্প্রদায়ের মধ্যে জমি বণ্টন করা উচিত জনসংখ্যায় তাঁদের সংখ্যাগত অনুপাতের ভিত্তিতে। উৎপাদন কীভাবে সংগঠিত হবে সে ব্যাপারটা সম্প্রদায়গুলির নিজ নিজ গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে”।
বুনিয়াদী শিল্প জাতীয়করণের যে কর্মসূচি আম্বেদকর রেখেছিলেন, লেখক তারও বিরোধিতা করেছেন। এক্ষেত্রে তাঁর যুক্তি হল, রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্র সবসময়ে শাসকশ্রেণীগুলির স্বার্থেই ব্যবহৃত হয়। বরং তিনি জনগণের মধ্যে সমহারে শেয়ার বণ্টনের মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বেসরকারিকরণের কথা বলেছেন।
লেখক এটা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন যে বৃহৎ শিল্পগুলিকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে একমাত্র শিল্প-শ্রমিকশ্রেণীই কৃষিতে বিপ্লবী রূপান্তর ঘটাতে পারে, জাতীয় বুর্জোয়াদের নিয়ন্ত্রণ ও পরিবর্তন করতে পারে এবং এইভাবে গণতান্ত্রিক থেকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে উত্তরণ সম্পন্ন করতে পারে। তাই শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্ব নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। একে নয়া বলা হয় একমাত্র এই কারণে যে এই বিপ্লব পুঁজিবাদে থেমে না গিয়ে সমাজতন্ত্র পর্যন্ত এগিয়ে যাবে। উৎপাদনের ধরনের নিম্নতর স্তরের সঙ্গে যুক্ত থাকার দরুণ গ্রামীণ ও অসংগঠিত সর্বহারার পক্ষে নিজে থেকে এই রূপান্তর ঘটানো সম্ভব নয়। ভূমিহীনদের কথামতো জমি বণ্টনের কথা বলে ও উৎপাদন-সংগঠনের পুরো ব্যাপারটা কৃষিজীবী সম্প্রদায়গুলির নিজ নিজ গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে লেখকও তাঁদের সীমাবদ্ধতাকেই স্বীকার করে নিয়েছেন। তাঁর কর্মসূচি অনগ্রসর জাতের কৃষকদের, যাঁরা নাকি দলিত গণতান্ত্রিক বিপ্লবের একনিষ্ঠ মিত্র, উচ্চতর স্তরকে সন্তুষ্ট রাখতে যথাস্থিতিবাদের এক কর্মসূচি মাত্র।
রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্র নিঃসন্দেহে সবসময়ে শাসকশ্রেণীরই সেবা করে। কিন্তু, একই সঙ্গে তা জাতীয় স্তরে শ্রমিক সংহতিকেও দৃঢ়তর করে এবং তাঁদের এই সমাজতান্ত্রিক চেতনায় শিক্ষিত করে তোলে যে পুঁজিবাদী মালিক অপরিহার্য নয়, শ্রমিকশ্রেণীর নিয়ন্ত্রণাধীনে বেতনভোগী একদল ম্যানেজার শিল্পগুলিকে পরিচালনা করার পক্ষে যথেষ্ট। এই জন্যই লেনিন বলেছেন, রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের থেকে মাত্র একধাপ এগোলেই সমাজতন্ত্র।
লেখকের প্রস্তাব মতো একটি ব্যাপকতম যুক্তমোর্চা যদি আদৌ বাস্তবে রূপ নেয়, তবে তার নেতৃত্ব অনিবার্যভাবেই চলে যাবে জাতীয় বুর্জোয়াদের হাতে এবং গ্রামীণ দরিদ্র জনতার ওপর অনগ্রসর জাতের কুলাকদের প্রাধান্যই সুনিশ্চিত করবে। দলিত গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্মসূচি বস্তুত জনতা দলের গণ্ডির মধ্যে সর্বাপেক্ষা চরমপন্থীদেরও সর্বোচ্চ সীমা। লেখকও সেই সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারেননি।
আম্বেদকরের পথ ধরে লেখক “জাতভিত্তিক সমাজের ব্যাকরণের ভিত্তিতে শ্রেণীসংগ্রামের গতিসূত্র মেনে”, বিপ্লবের একটি মডেল গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি যা হাজির করতে পেরেছেন তা হল শ্রেণীসংগ্রামে পূর্ণচ্ছেদ টেনে জাতভিত্তিক সমাজের স্থিতিবিদ্যাকে সম্বল করে সংস্কারের একটি মডেল মাত্র।
এই উচ্চাকাঙ্খী সংশ্লেষণ-প্রকল্পের ভিত্তি ছিল একদিকে অর্থনীতিবাদ, সংসদবাদ এবং মার্কসবাদী তত্ত্ব ও অনুশীলনে শিল্পীয় শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বের ধারণা বর্জন, আর অন্যদিকে এক পেটিবুর্জোয়া কৃষক রাজনীতি থেকে মুক্তির চেতনায় আম্বেদকরবাদের উত্তরণ। এই প্রক্রিয়ায় প্রথমে অপমৃত্যু হয় মার্কসবাদের। তারপর মারা পড়ে আম্বেদকরবাদের ৠাডিক্যাল অর্থনৈতিক দিশা, প্রধানত যার ওপরে ভিত্তি করেই আম্বেদকর তাঁর দলিত মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন।
১৪০ পৃষ্ঠা জুড়ে ১৫০ টাকা মূল্যে লেখকের মানসিক শ্রমশক্তির এই কষ্টসাধ্য প্রয়োগের চূড়ান্ত ফসল হল তত্ত্বের স্তরে কে ভেনু আর রামবিলাস পাসোয়ান এবং ব্যবহারিক রাজনীতির স্তরে জনতা দল ও জনযুদ্ধ-এমসিসি-র এক অভূতপূর্ব সংমিশ্রণ। এই অশুভ আঁতাতের ইঙ্গিত আমরা বহুদিন থেকেই দিয়ে আসছি। একে প্রকাশ্যে উন্মোচিত করে দেওয়ার জন্য লেখককে অসংখ্য ধন্যবাদ।