(ষষ্ঠ কংগ্রেসের রাজনৈতিক-সাংগঠনিক রিপোর্ট থেকে)
বিশেষ করে বিএসপি-র চকমপ্রদ উত্থানের সাথে সাথে দলিত প্রশ্ন অন্যতম একটি প্রধান প্রশ্ন হিসাবে দেখা দিয়েছে। পাঞ্জাবে এক ভালো সূচনা ঘটানোর পরে বিএসপি উত্তরপ্রদেশে অনেকখানি বৃদ্ধি ঘটায় এবং মধ্যপ্রদেশে ও অন্যান্য কিছু রাজ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। এক সময়ে মনে হয়েছিল যে সে অন্ধ্রকেও ভাসিয়ে নিয়ে যাবে এবং সেখানে সে বিভিন্ন নকশালপন্থী গোষ্ঠীর দিক থেকে সহানুভূতিপূর্ণ সাড়াও পেয়েছিল। ৠাডিক্যালরা তাদের প্রভাবাধীন এলাকায় নির্বাচনী প্রচার চালানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা থেকে বিএসপি-কে ছাড় দিয়েছিল। একটি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী গোষ্ঠী তো নির্বাচনে বিএসপি-কে খোলাখুলি সমর্থন করার কথা ঘোষণা করে দিয়েছিল। কিছু কিছু প্রাক্তন পিডব্ল্যুজি নেতা এমনকি বিএসপি-তে যোগ পর্যন্ত দিয়েছিলেন এবং একজন নামকরা তাত্ত্বিক কাঁসিরামকে ভারতের পরিস্থিতিতে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও মাও চিন্তাধারাকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করার কৃতিত্ব পর্যন্ত দিয়ে ফেলেছিলেন। এভাবে দলিত ধ্যানধারণা মার্কসবাদী-লেনিনবাদী আন্দোলনের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল এবং ঐ আন্দোলনের শ্রেণী মানদণ্ডকে পাল্টে দেওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়েছিল।
আমাদের পার্টি দৃঢ়ভাবে এইসব বিচ্যুতিগুলির বিরোধিতা করে এই মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ ঊর্ধ্বে তুলে ধরে যে, জাতপাতগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে ও দলিতদের সামাজিক সমতার জন্য লড়াই চালাতে গিয়ে শ্রেণীসংগ্রামের সীমানাকে সম্প্রসারিত করাই মার্কসবাদীদের কাছে একমাত্র প্রস্থানবিন্দু হতে পারে। কাঁসিরামরা এইসব ইস্যুগুলিকে ধরেন শ্রেণীসংগ্রামকে নাকচ করার অবস্থান থেকে এবং চূড়ান্ত বিচারে তারা শেষপর্যন্ত শ্রেণী-শান্তির কথা প্রচার করেন ও শাসক অভিজাতশ্রেণীর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে ওঠেন। বিহারের যেসব অঞ্চলে সামাজিক মর্যাদা ও সমতার দাবিতে দলিত আন্দোলন গ্রামীণ গরিবদের শ্রেণীসংগ্রামের অঙ্গ হয়ে উঠেছে সেখানে বিএসপি-র লোকজন তাদের আসল স্বরূপ উদ্ঘাটিত করেছেন। রণবীর সেনার সাথে তাদের ওঠাবসা করতে দেখা গেছে এবং পরবর্তীকালে বিএসপি নিজেই উত্তরপ্রদেশে সামন্ততান্ত্রিক-ব্রাহ্মণ্যবাদী পার্টি বিজেপির সাথে হাত মিলিয়েছে। বিহারে আমরা আমাদের সংগ্রামের এলাকাগুলিতে সফলভাবে বিএসপি-র অনুপ্রবেশ ঠেকিয়েছি এবং উত্তরপ্রদেশে সিপিআই-এর যেসব পুরোনো ভিত্তিগুলি বিএসপি ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সেগুলিকে আবার বামপন্থার পক্ষে ফিরিয়ে আনার চ্যালেঞ্জ আমরা নিয়েছি।
কংগ্রেস ও বিজেপির সাথে বিএসপি-র দহরম মহরম এবং তার লাগাতার বাম বিরোধী মনোভাব দলিত বুদ্ধিজীবী সহ প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী মহলের মধ্যে তার সম্পর্কে মোহ দূর করতে সহায়তা করেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও উত্তরপ্রদেশের দলিত কৃষকশ্রেণী ও দলিত পেটিবুর্জোয়া অংশের মধ্যে বিএসপি যথেষ্ট সমর্থন ভোগ করে। মায়াবতীর কিছুদিন ক্ষমতায় থাকা এবং আম্বেদকর গ্রামীণ প্রকল্প, দলিত মুক্তির প্রবক্তাদের মূর্তি স্থাপন, জেলাগুলির নতুন নামকরণ ইত্যাদির মতো তাঁর প্রতীকী কাজগুলি তাঁকে অনেক সুবিধাজনক জায়গায় নিয়ে গেছে। পাঞ্জাবে বিএসপি কুলাকদের পার্টি আকালিদের সঙ্গে পুরোপুরি এক সুবিধাবাদী জোট গড়ে তুলেছে এবং লোকসভা নির্বাচনে ভালো ফসল তুলেছে। কিন্তু বিধানসভা নির্বাচনে যখন সে একাই লড়ে তখন তাকে শূন্য হাতে ফিরতে হয়।
উত্তরপ্রদেশেও তার বিধায়ক বাহিনীকে একত্রিত রাখতে সে সমস্যায় পড়েছে। তাদের অনেককেই অন্যান্য পার্টি থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল এবং মজার ব্যাপার, তাদের অনেকেই উঁচু জাতের লোক। নিছক বিএসপি-র দলিত ভোটব্যাঙ্কের ফায়দা তুলতেই তারা এসেছিল এবং কাঁসিরাম যথেচ্ছভাবে তা নিয়ে সওদা করেছেন। এই জন্যই মায়াবতীর হাত থেকে মুখ্যমন্ত্রীর লাগাম কল্যাণ সিং-এর হাতে চলে যাওয়ার সময়ে বিএসপি স্পীকারের পদে নিজের লোক বসানোর জন্য এত পীড়াপীড়ি করেছিল, যদিও শেষপর্যন্ত তাকে পিছিয়ে আসতে হয়। দক্ষিণ, পশ্চিম ও পূর্ব ভারতে তার উত্থানের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।
তৃণমূল স্তরে বিএসপি দলিত জাতগুলির মধ্যে মর্যাদা, সমতা ও রাজনৈতিক ক্ষমতায় অংশীদারিত্বের এক আকাঙ্খা গড়ে তুলেছে। কিন্তু সর্বোচ্চ স্তরে সে জন্ম দিয়েছে এক দলিত অভিজাতশ্রেণীর। এরা কদর্যভাবে বৈভব প্রদর্শন করে, অবক্ষয়ী বু্র্জোয়া জীবনযাপন করে। বিএসপি মূলগতভাবে উপরোক্ত দলিত অভিজাত ও পেটিবুর্জোয়াদের শ্রেণীস্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে এবং এই দলের চূড়ান্ত ভবিতব্য হচ্ছে বিজেপি বা কংগ্রেস(ই)-র মধ্যে মিশে যাওয়া। কিন্তু ব্যাপক দলিত জনগণের মধ্যে মজুরি, জমি, সামাজিক মর্যাদা ও রাজনৈতিক মুক্তির দাবিতে যে সচেতনতার বৃদ্ধি ঘটেছে, তাকে লাল পতাকার নীচে নিশ্চিতভাবেই সমাবেশিত করা সম্ভব।
মহারাষ্ট্রে দলিত আন্দোলন এক পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। আম্বেদকরের মূর্তির অবমাননার পর সেখানে যে দলিত জনরোষ দেখা গেছে তার হাত থেকে এমনকি অধঃপতিত পুরোনো দলিত নেতারাও রেহাই পায়নি। সাম্প্রতিককালে আম্বেদকরকে হেয় প্রতিপন্ন করা ও তাঁকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধী বলে তুলে ধরার এক পরিকল্পিত প্রচেষ্টা চলছে। খুব সম্প্রতি মুলায়ম সিং-এর সমাজবাদী পার্টিও আম্বেদকরকে আক্রমণ করতে শুরু করেছে। বিজেপি তার সাম্প্রদায়িক স্বার্থসিদ্ধির জন্য আম্বেদকরকে ব্যবহার করতে চাইছে। আমাদের অবশ্যই এইসব প্রচেষ্টার বিরোধিতা করতে হবে। সামাজিক-অর্থনৈতিক দিক থেকে গান্ধী ও এমনকি নেহরুর চাইতেও আম্বেদকর অনেক বেশি বিপ্লবী ছিলেন। রাজনৈতিক দিক থেকেও ভারতে জাতিগঠনের জটিলতা সম্পর্কে তিনি বেশি সচেতন ছিলেন। তিনি অন্যান্য সবকিছুর ঊর্ধ্বে একজন জাতীয় নেতা হিসাবে নিজেকে তুলে ধরার ভণিতা কখনও দেখাননি এবং দলিত মুক্তির প্রশ্নকে স্বাধীনতা আন্দোলনের এক অঙ্গাঙ্গী বিষয় করে তোলার জন্য জোরালো সওয়াল করেছিলেন। আর এটি এমন এক প্রশ্ন যা নিয়ে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরেও ভারতকে লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে।
বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে দলিত প্রশ্নকে নিছক দলিত বনাম ব্রাহ্মণ্যবাদী উঁচু জাতগুলির মধ্যে সীমাবদ্ধ এক বিষয় হিসাবে দেখলে চলবে না। উপরের স্তরে উঠে আসা মধ্যবর্তী জাতগুলির মধ্যেকার বর্ধিষ্ণু কুলাকরাও কৃষিশ্রমিক ও গরিব কৃষকদের মজুরি ও জমির দাবিকে নাকচ করার জন্য দলিতদের ওপর আক্রমণ চালায়।
এই বিষয়টির স্পষ্ট প্রতিফলন দেখা যায় তামিলনাড়ুর দক্ষিণের জেলাগুলিতে দলিত ও থেবরদের (পশ্চাদপদ জাত) মধ্যেকার ব্যাপক সংঘর্ষ ও রাষ্ট্রযন্ত্রের খোলাখুলি থেবরদের পক্ষ নেওয়ার মধ্যে। উত্তরপ্রদেশ ও বিহারেও এই ঘটনা প্রকট হয়ে উঠেছে। দলিতদের ওপর দমনপীড়ন প্রতিরোধকারী কেন্দ্রীয় আইন বাতিল করার জন্য মুলায়মের দাবিও একই অবস্থান থেকে উঠে আসছে।
বিএসপি-র বিপরীতে দলিত প্রশ্নে সক্রিয়ভাবে হস্তক্ষেপ করার জন্য আমরা উত্তরপ্রদেশে দলিত মহাসভা সংগঠিত করতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু এটি ঠিকমতো শুরুই করা যায়নি এবং পরবর্তীকালে আমরা এই প্রকল্প পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিই। সঠিক কর্মনীতি হওয়া উচিত বিপ্লবী দলিত সংগঠনগুলির সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়া ও দলিত সাহিত্যের প্রবক্তাদের মতো প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী মহলের সাথে আন্তঃক্রিয়া ঘটানো। তামিলনাড়ুতে সম্প্রতি তিরুনেলভেলীতে আমরা দলিতদের ওপর দমনপীড়ন নিয়ে একটি কনভেনশন করেছি এবং জঙ্গী দলিত সংগঠনগুলির সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছি। কিন্তু আমাদের সংগঠনের ভিতর দলিতবাদী ভাবধারার অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে আমাদের অবশ্যই সজাগ থাকতে হবে।