(১৯৯২-এ অনুষ্ঠিত পঞ্চম পার্টি কংগ্রেসের রাজনৈতিক-সাংগঠনিক রিপোর্ট থেকে)

যে দেশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছে এবং যাকে এখনও সাম্রাজ্যবাদের দিক থেকে নয়া-ঔপনিবেশিক হুমকির মুখোমুখি হতে হচ্ছে সেই দেশের কমিউনিস্ট হিসাবে আমরা অবশ্যই জাতীয় ঐক্য চাই। জন্মলগ্ন থেকেই সিপিআই(এমএল) তার নীতিগত লক্ষ্য হিসাবে ভারতবর্ষকে ঐক্যবদ্ধ করার কথা বলে এসেছে। আমরা এমনকি আমাদের মহান দেশের বিভাজনের প্রতিকার করতে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে এক মহাজোটের স্বপ্নও দেখি। আমরা কখনই খালিস্তানের দাবিকে বা স্বাধীন আসামের দাবিকে সমর্থন করিনি।

শাসক কংগ্রেস হোক, বিজেপি হোক, সুবিধাবাদী বাম হোক বা বিপ্লবী কমিউনিস্ট হোক সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ধারার কাছে জাতীয় ঐক্য অবশ্যই এক উদ্বেগের বিষয়। প্রশ্ন হল বিভিন্ন অবস্থানের মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্যরেখা কীভাবে টানা যায়।

আমাদের প্রায় সমস্ত ছোটো প্রতিবেশীই ভারতবর্ষকে এক আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী শক্তি হিসাবে ও এক বিপদ হিসাবেই দেখে থাকে এবং এর কিছু ভিত্তিও আছে। সমস্ত সরকারি প্রচারমাধ্যমে প্রতিবেশী দেশগুলিকে বিশেষ করে পাকিস্তানকে এইভাবে তুলে ধরে যে তারা সর্বদাই ভারতবর্ষের বিরুদ্ধে চক্রান্ত চালাচ্ছে। সিপিআই ও সিপিআই(এম) একই ধারায় প্রচার চালায়। আমাদের এটি বুঝতে হবে যে প্রতিবেশী দেশগুলির মধ্যে ভারতবর্ষকে এক বিপদ হিসাবে দেখার এই অনুভূতি বা প্রবণতা থাকলে কেবলমাত্র তার মধ্য দিয়েই ভারতবর্ষের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত কাজ করতে পারে।

সর্বহারা আন্তর্জাতিকতাবাদে বিশ্বাস করার অর্থই হল কমিউনিস্টদের অবশ্যই নিজ দেশের বুর্জোয়াদের উগ্র জাতিদম্ভের বিরোধিতা করার সাহস রাখতে হবে। এই নীতিগত অবস্থান ছাড়া দেশের স্থায়িত্বের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী হুমকি সম্পর্কে উদ্বেগ অবশ্যম্ভাবীরূপ কমিউনিস্টদের বুর্জোয়া মতাদর্শ ও বুর্জোয়া স্বার্থের প্রভাবাধীনে নিয়ে যাবে।

আবার, বিশেষ ক্ষেত্রগুলিতে যেখানে বিচ্ছিন্নতার আন্দোলনের পিছনে জনপ্রিয় সমর্থন রয়েছে ও এক সমগ্র ইতিহাস রয়েছে সেখানে বিচক্ষণ পরিচালনা ও বিশেষ সমাধান দরকার।

উপর থেকে জাতীয় ঐক্য রক্ষা করার অজুহাতে ভারতীয় রাষ্ট্র কেবলমাত্র তার প্রতিক্রিয়াশীল হাতিয়ারগুলিই শাণিয়ে চলেছে – একের পর এক দানবীয় আইন চালু করা হচ্ছে এবং মিথ্যা সংঘর্ষ ও গণহত্যা ক্রমেই আইনসম্মত হয়ে উঠছে। উপর থেকে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার এই বিসমার্কীয় কায়দার আমরা দৃঢ়ভাবে বিরোধিতা করি। আমরা নীচ থেকে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার পক্ষে যেখানে সমস্ত জাতিসত্তার জন্য ও জাতীয় সংখ্যালঘুদের জন্য সম্ভাব্য সর্বোচ্চ স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা থাকবে। গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে ভারতবর্ষের জাতীয় ঐক্যসাধন আমাদের গণতান্ত্রিক বিপ্লবের এক অন্যতম দায়িত্ব।