(লিবারেশন, ডিসেম্বর ১৯৭৯ থেকে)

অসমীয়া জাতি, ভাষা ও সংস্কৃতির স্বকীয়তা রক্ষার জন্য আপনাদের যে উৎকণ্ঠা, আমাদের পার্টি তার অংশীদার এবং এই উদ্দেশ্যে আপনারা যে সংগ্রাম চালাচ্ছেন আমরা তাকে সমর্থন করি। অসমীয়া যুবকদের ব্যাপক বেকারত্ব ও অসমীয়া জনগণ যেসব সমস্যার সম্মুখীন সেগুলির বিরুদ্ধে আপনাদের সংগ্রামকে আমরা সমর্থন করি।

এটা ঠিকই যে বাঙালী বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ ভ্রান্ত শ্রেষ্ঠত্বের ধারণায় ভোগে এবং অসমীয়া জাতিকে পশ্চাৎপদ ও বর্বর মনে করে তাচ্ছিল্য করে। এটা অতীতেরই ধারাবাহিকতা ও ব্রিটিশ শাসকদেরই সৃষ্টি।

ব্রিটিশ শাসকরা কয়েকটি জাতির স্বার্থের বিনিময়ে অন্য কয়েকটি জাতির বুদ্ধিজীবীদের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে নিয়োগ ও অন্যান্য ব্যবস্থাদি গ্রহণ করে কাছে টেনে নেওয়ার নীতি অনুসরণ করেছিল। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে তারা এই নীতি চালিয়েছে। এভাবে তারা একদিকে কয়েকটি জাতির বেশ কিছু অংশকে তাদের পক্ষে টেনে এনেছিল এবং অন্যদিকে অপর জাতিগুলির মধ্যে এই ধারণা সৃষ্টি করেছিল যে তাদের শত্রু সুবিধাপ্রাপ্ত জাতিগুলি তারা নিজেরা (ব্রিটিশ শাসকরা) নয়। এই পদ্ধতিতে ব্রিটিশ শাসকরা জনগণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছিল এবং এতবছর ধরে আমাদের দেশ শাসন করেছিল। ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম চালিয়েই বিভিন্ন জাতির ভারতীয় জনগণ তাদের ঐক্য গড়ে তুলেছেন।

সুতরাং অসমীয়া ও বাঙালীদের মধ্যে যেমন বিভেদের একটি ইতিহাস তেমনি রয়েছে তাদের উভয়ের সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামেরও এক ইতিহাস।

১৯৪৭ সালের পর জনগণের সংগ্রামী ঐক্য ধ্বংস করার জন্য ভারতের শাসকশ্রেণী হাজারো অপচেষ্টা চালিয়েছে এবং যেহেতু শত্রু বর্তমানে আরও ছদ্মবেশী তাই তাদের পক্ষে একাজ করা সহজ। ‘স্বাধীনতা’র সময় মাতৃভূমি দু-টুকরো হয়ে যায় এবং ‘স্বাধীনতা’র ৩২ বছর পরেও দেখা যায় জনগণের বিভিন্ন অংশের মধ্যে অসংখ্য বিভেদ। সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলি এযাবৎ আসামে অসমীয়া-বাঙালী বিভেদের উপর নির্ভর করেই টিকে থেকেছে। যেমন ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে তারা টিকে থেকেছে হিন্দু-মুসলমান বা জাতপাতগত প্রশ্নগুলির উপর নির্ভর করে।

আসাম থেকে বাঙালী ও নেপালীদের বিতাড়িত করে কি অসমীয়া জনগণের কোনো সমস্যার সমাধান সম্ভব? কখনোই নয়। একাজ কেবল জনগণের ঐক্য নষ্ট করবে, পারস্পরিক লড়াইয়ে জনগণেরই শক্তি ক্ষয় করবে এবং কেবলমাত্র সাম্রাজ্যবাদীরা ও দেশীয় প্রতিক্রিয়াশীলরাই এর থেকে ফয়দা তুলবে। এতে অসমীয়া জনগণের যতটা সমস্যার সমাধান হবে তার চেয়ে বেশি সমস্যা এর ফলে সৃষ্টি হবে।

বাংলাদেশ ও নেপাল থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষের ভারতে আসা এবং ভারতের এক রাজ্যের মানুষের অন্য রাজ্যে যাওয়ার পিছনে নিজ নিজ ঐতিহাসিক ও সামাজিক কারণ আছে, যেমন কারণ রয়েছে লক্ষ লক্ষ ভারতবাসীর পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যাওয়ার পেছনেও। আসামেই লক্ষ লক্ষ আদিবাসী শ্রমিক রয়েছেন যারা এসেছেন বিহার, উড়িষ্যা ও মধ্যপ্রদেশ থেকে। আপনারা তাদের সকলকে বিতাড়িত করতে পারেন না।

বেঁচে থাকার মতো জরুরি প্রশ্নের সম্মুখীন না হওয়া পর্যন্ত ব্যাপক মানুষ তাদের দেশ বা জন্মভূমি পরিত্যাগ করে না। জীবিকার সন্ধানেই তারা স্থানান্তরে যেতে বাধ্য হয়। আপনারা ইতিহাসকে অবহেলা করতে পারেন না, পারেন না সামাজিক কারণগুলিকে অস্বীকার করতে। পৃথিবীতে এমন অনেক ঘটনাই ঘটে থাকে যা কারুর পছন্দ বা অপছন্দের অপেক্ষা রাখে না। উগ্র স্থানীয় জাতীয়তাবাদের তাত্ত্বিকেরা হয় অজ্ঞ যারা ইতিহাস বা সামাজিক নিয়মগুলি সম্পর্কে কিছুই বোঝে না অথবা তারা ভণ্ড। তাদের অভিপ্রায় যাই হোক না কেন, জ্ঞাতসারে অথবা অজ্ঞাতসারে তারা অসমীয়া জনগণেরই স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং অসমীয়া জনগণের সামনে থেকে প্রকৃত শত্রুকে ও প্রকৃত সংগ্রামী কর্মসূচিকে আড়াল করছে।

আমাদের পার্টি স্বকীয় বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন কঠোর পরিশ্রমী অসমীয়া জনগণ, তাদের অপূর্ব ভাষা আর সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ অসমীয়া সংস্কৃতি সম্পর্কে উঁচু ধারণা পোষণ করে। অসমীয়া জনগণকে হীন চোখে দেখে এমন সমস্ত উগ্র জাতীয়তাবাদের আমরা ঘোর বিরোধী এবং আমরা নয়া-গণতান্ত্রিক দিশায় অসমীয়া সাংস্কৃতিক বিকাশের পক্ষে। আমরা সরল, বুদ্ধিমান ও সাহসী অসমীয়া যুবকদের উপর দৃঢ় আস্থা রাখি ও আন্তরিকভাবে আশা করি যে, তারা গুরুত্ব সহকারে চিন্তা করবেন, সমস্যাগুলি তলিয়ে দেখবেন, শত্রু ও মিত্রের মধ্যে পার্থক্য করতে শিখবেন এবং শাসকশ্রেণীর ফাঁদে পড়ার বিপদ থেকে মুক্ত হবেন।

অসমীয়া ছাত্র ও যুবকদের একাংশ ইতিমধ্যেই প্রকৃত প্রগতির পথ গ্রহণ করেছেন। শেষ পর্যন্ত বাকিরাও সেই পথই অনুসরণ করবেন। বর্তমান ঘটনাবলী খুবই বেদনাদায়ক, কিন্তু আশা রাখি, যে জাতির যুবকবৃন্দ দীর্ঘ অসন্তোষে ভুগছেন এবং মাথা তুলতে চাইছেন সেই জাতির কাছে এগুলি হবে শিক্ষাপর্বকালের একটি পদক্ষেপ।

২৫ নভেম্বর ১৯৭৯

কেন্দ্রীয় কমিটি
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)