(লিবারেশন, জুলাই ১৯৮৪ থেকে)
দেশবাসীগণ,
ভারতীয় সেনাবাহিনী কর্তৃক স্বর্ণমন্দিরের ওপর জঘন্য আক্রমণ এবং শিখদের গণহত্যা যত না সমস্যার সমাধন করতে পেরেছে সৃষ্টি করেছে তার চেয়ে আরও অনেক বেশি সমস্যা। আগে যেখানে শিখদের কেবল এক ক্ষুদ্র অংশই ‘খালিস্তানে’র দাবি করতেন, আজ সেখানে সমগ্র শিখ সম্প্রদায় এই দাবির পেছনে সামিল হয়েছেন। দেশের ভেতরে-বাইরে সর্বত্র শিখরা ভারত সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জানাচ্ছেন, প্রতিটি ক্যান্টমেন্টে শিখ সৈন্যরা বিদ্রোহে জেগে উঠছেন এবং খোদ পাঞ্জাবে শিখ কৃষকরা ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কঠিন যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। নিহতের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে আর প্রতিটি মৃত্যুর সাথে সাথে কঠোরতর হয়ে উঠছে তাঁদের মনোভাব।
যে শিখদের সর্বদাই ‘নতুন ভারতের স্থপতি’ হিসাবে, ‘জাতীয় সংহতির দৃঢ় সৈনিক’ হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে, তাঁরাই হঠাৎ আজ সরকারি প্রচারে ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা পাচ্ছেন। কী করে এমনটা হল? এ সমস্ত দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার পেছনে প্রকৃত অপরাধী কে? প্রতিটি চিন্তাশীল এবং দেশপ্রেমিক ভারতবাসীর মনেই আজ এই কয়েকটি প্রশ্ন তোলপাড় করছে।
প্রিয় দেশবাসী,
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস পার্টির ভুল নীতিগুলিই ১৯৪৭ সালে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে দু-টুকরো করেছিল। আর আজ শ্রীমতী গান্ধীর নীতিগুলি দেশকে নিয়ে যাচ্ছে আরও টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়ার দিকে। ৩৭ বছরের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা সত্ত্বেও এবং কেন্দ্রে একের পর এক ‘লৌহদৃঢ় ব্যক্তিত্বের’ অধীনে কার্যত একচেটিয়া কংগ্রেসী শাসন সত্ত্বেও; সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ, জাতপাতের লড়াই, আঞ্চলিকতাবাদ, ধর্মীয় উন্মত্ততা ও বিচ্ছিন্নতাবাদ ক্রমশ বেড়েই চলেছে। আমরা যারা এখানে বাস করি তাদের সকলেরই পবিত্র মাতৃভূমি ভারতবর্ষকে আজ পরিণত করা হয়েছে হিন্দু ভারতবর্ষে; বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, একচেটিয়া পুঁজিপতি, জমিদারদের নিজস্ব সেনাবাহিনী, লম্পট রাজনীতিবিদ আর সমাজের যত আবর্জনার মৃগয়াক্ষেত্রে এবং যে সমস্ত শ্রমিক, কৃষক ও যুবকরা তাঁদের অধিকার অর্জনের জন্য সংগ্রামের হিম্মত দেখান তাঁদের সকলের কবরখানায়; ধর্মীয় সংখ্যালঘু, পশ্চাদপদ জাতিসত্তা ও জাতীয় সংখ্যালঘুদের কারাগারে।
ইন্দিরা গান্ধীই তাঁর নিজের রাজনৈতিক স্বার্থে আকালীদের সঙ্গে গুরুত্ব সহকারে কোনো অর্থবহ আলোচনায় বসতে অস্বীকার করেছিলেন, সচেতনভাবে পাঞ্জাব ও হরিয়ানার মধ্যে তথা পাঞ্জাবের অভ্যন্তরে হিন্দু ও শিখদের মধ্যে সংঘাতকে স্থায়ী রূপ দিয়েছিলেন। আকালী দলকে মোকাবিলা করার জন্য তিনিই প্রথমে ভিন্দ্রানওয়ালাকে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হিসাবে গড়ে তুলেছিলেন ও শক্তিশালী গণআন্দোলনের উত্থান রোখার জন্য সন্ত্রাসবাদকে উস্কানি দিয়েছিলেন, আর শেষপর্যন্ত তিনিই ভিন্দ্রানওয়ালাকে এক শহীদে পরিণত করলেন।
ইন্দিরা গান্ধী যতদিন দেশের কর্ণধার থাকবেন, জাতীয় ঐক্যের ওপর থেকে সংকটের কালো মেঘ ততদিন দূর হবে না। সংসদীয় বিরোধীপক্ষও নিজেদের চরম অপদার্থতার ভুরিভুরি প্রমাণ দিয়েছে। তাদের কাজ হল ‘সাধারণ’ সময়ে ইন্দিরা গান্ধীর নিন্দা করে চলা আর ‘সংকটের’ সময়ে দৃঢ়ভাবে তাঁর পাশে দাঁড়ানো। কোনো স্বাধীন বস্তুগত ফল দিতে পারে এমন কোনো নিজস্ব কার্যক্রম তাঁদের নেই।
সাম্প্রদায়িক সংহতি বজায় রাখা ও জাতীয় ঐক্য রক্ষা করার দায়িত্বভার আজ এসে পড়েছে বিপ্লবী কমিউনিস্ট, সমস্ত প্রগতিশীল জনগণ ও প্রকৃত দেশপ্রেমিকদের কাঁধে। আর এই কর্তব্য অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত হয়ে আছে এক নতুন ভারত, জনগণের ভারত, গণতান্ত্রিক ভারত গড়ার সংগ্রামের সাথে।
প্রিয় দেশবাসীগণ,
স্বর্ণমন্দিরের ওপর পাশবিক আক্রমণের নিন্দা করুন, বেদনাহত শিখ ভাইদের পাশে দাঁড়ান। দাবি তুলুন, পাঞ্জাব সমস্যার দ্রুত নিষ্পত্তি চাই। সরকার এবং বিরোধী দলগুলি যে ভূয়ো দেশপ্রেমের প্রচার চালাচ্ছে তাতে বিভ্রান্ত হবেন না, কারণ তা ‘খালিস্তানের’ জন্মকেই ত্বরান্বিত করবে মাত্র।
অতীতে আমরা কংগ্রেসী ও ‘কমিউনিস্ট’ নেতাদের ‘উদ্দীপনাময়’ কথাগুলিকে বিশ্বাস করেছিলাম, তাঁদের হাতেই সব উদ্যোগ সঁপে দিয়েছিলাম। পরিণতি দাঁড়িয়েছিল এই যে আমরা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির দু-টুকরো হয়ে যাওয়া রুখতে পারিনি।
এ ভুলের পুনরাবৃত্তি আর করব না।
বন্দুক আর কামান দিয়ে ভারতবর্ষকে ঐক্যবদ্ধ রাখা যাবে না। ভারতবর্ষকে এক রাখতে পারে কেবল যৌথ সংগ্রামের ময়দানে সমস্ত সম্প্রদায়ের জনগণের ঐক্য ও সংহতি।
অভিনন্দন সহ, ১১ জুন, ১৯৮৫