(শ্রী টমাস ম্যাথুর প্রত্যুত্তরের জবাব, লিবারেশন, জানুয়ারি ১৯৯৫ থেকে)

শ্রী টমাস ম্যাথুর জাত ও শ্রেণীর গতিসূত্র – র্র্যাডিক্যাল আম্বেদকরপন্থী তত্ত্বানুশীলন বইটি ধরে শ্রেণী ও জাতের বৈপরীত্য সম্পর্কে আমার বিতর্কমূলক প্রবন্ধের (লিবারেশন, বিশেষ সংখ্যা, এপ্রিল ১৯৯৪) যে প্রত্যুত্তর শ্রী ম্যাথু দিয়েছেন (লিবারেশন, নভেম্বর ১৯৯৪), তাতে খুব কম করে বললে, ঐ বইতে প্রতিফলিত অদ্ভুত ধারণাগুলিই আরও প্রকট হয়ে উঠেছে মাত্র। বিস্তারিত ব্যাখ্যায় আসা যাক।

সংশ্লেষণ প্রসঙ্গে আরেকবার

১। শ্রী ম্যাথুর মতে তিনি মার্কসবাদ ও আম্বেদকরবাদের যে সংশ্লেষণের প্রস্তাব রেখেছেন, তা মর্মবস্তুতে মাওবাদী ভাববাদ ও বৌদ্ধ দ্বন্দ্ববাদের সমন্বয়। তাছাড়া, আগে তিনি এই সমন্বয়কে লক্ষ লক্ষ ভারতবাসীর একমাত্র আশা হিসাবে তুলে ধরেছিলেন, আর এখন তিনি মনে করেন তা সমগ্র মানবজাতির একমাত্র ভরসা। নিঃসন্দেহে বিরাট অগ্রগতি।

‘মাওবাদী ভাববাদ’ কথাটি ব্যবহারের জন্য শ্রী ম্যাথু আমার সমালোচনা করতেই পারেন, তিনি তো এই ভাষা আদৌ ব্যবহার করেননি। অপরাধ স্বীকার করেও আমি আবার বলব যে মাও চিন্তাধারার যে ব্যাখ্যা তিনি রেখেছেন, তা থেকে অন্য কোনো সূত্রায়নে উপনীত হওয়া সম্ভব নয়। আমরা জানি মৌলিক মার্কসবাদী নীতিসমূহকে নাকচ করার ক্ষেত্রে শ্রী ম্যাথু কে ভেনুর পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। আর এই পরিপ্রেক্ষিতে ‘মার্কসবাদের পশ্চিমী সংস্করণের যান্ত্রিক অনুশীলনের’ বিপরীতে মাও মতাদর্শকে যে ‘গৌরবের আসনে’ তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছেন, সে সম্পর্কে তাঁর উচ্ছ্বাস বস্তুবাদী মনে সত্যিই সন্দেহের উদ্রেক করে।

কাঠামো ও উপরিকাঠামোর দ্বান্দ্বিক আন্তঃসম্পর্ক মার্কসবাদী দর্শনের ভিত্তিস্বরূপ। তা সত্ত্বেও কাঠামোর ওপর উপরিকাঠামোর ক্রিয়াকে তুলে ধরার জন্য, অথবা ভাষান্তরে, মতাদর্শকে ‘গৌরবের আসনে’ বসানোর জন্য যদি একা মাও-এর বিশেষ গুণকীর্তন করা হয়, তাহলে গোটা ব্যাপারটি দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের কাঠামোর মধ্যে মাও চিন্তাধারার যথার্থ উপলব্ধির পরিবর্তে পেটিবুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীসুলভ নৈরাজ্যবাদী-ভাববাদী মানসিকতার সঙ্গেই সঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে হয়।

মাও নিজে চীনা পরিস্থিতিতে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সুনির্দিষ্ট প্রয়োগের ওপর জোর দিয়েছেন। আর সুনির্দিষ্টভাবে তিনি সোভিয়েত অধিবিদ্যার সর্বগ্রাসী প্রভাব থেকে মার্কসবাদী দর্শনের দ্বান্দ্বিক মর্মবস্তুকে পুনরুদ্ধার করেন।

সারা বিশ্বের মাওবাদের অত্যুৎসাহী প্রবক্তারা অবশ্য সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কথা বলে মাও-কে মৌলিক মার্কসবাদী নীতিসমূহের বিরুদ্ধে দাঁড় করান এবং তাঁকে এক বিষয়ীগত ভাববাদীর স্তরে নামিয়ে আনেন। শ্রী ম্যাথুও ঐ দলেরই অন্তর্ভুক্ত।

শ্রী ম্যাথু আমাদের আরও জানিয়েছেন যে, আম্বেদকর নাকি একসময়ে পশ্চিমী যান্ত্রিক বস্তুবাদের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন আর জীবনের পরবর্তী পর্যায়ে তাঁর বৌদ্ধ দ্বন্দ্ববাদে ‘উত্তরণ’ ঘটে।

পশ্চিমের সর্বাধুনিক চিন্তাধারার সঙ্গে সুপরিচিত আম্বেদকর দ্বন্দ্ববাদের সেদিনকার সর্বোচ্চ বিকাশ মার্কসীয় দ্বন্দ্ববাদের পরিবর্তে সুপ্রাচীন বৌদ্ধ দ্বন্দ্ববাদে ‘উত্তরণকে’ কেন বেছে নিয়েছিলেন? এই প্রশ্নকে গুরুত্বসহকারে ও গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে বোঝা যাবে যে মার্কসবাদ ও আম্বেদকরবাদ দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন দার্শনিক-মতাদর্শগত ব্যবস্থার প্রতিনিধিত্ব করে।

নিঃসন্দেহে ভারতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের আশু পরিপ্রেক্ষিতে একটি মার্কসবাদী কর্মসূচির বহু কিছু আম্বেদকরবাদের র্র্যাডিক্যাল দিকটির সঙ্গে মিলে যেতে পারে। কিন্তু একটি একক দার্শনিক-মতাদর্শগত ধারায় উভয়ের সম্মিলন কেবল অকল্পনীয় নয়, বহুক্ষেত্রে তা এমনকি এক প্রতিক্রিয়াশীল প্রচেষ্টাতেও অধঃপতিত হতে পারে।

সমাজতান্ত্রিক বনাম র্র্যাডিক্যাল বুর্জোয়া বীক্ষা

২। শ্রী ম্যাথু আমার লেখা থেকে প্রশংসাসহ উদ্ধৃতি দিয়ে দেখিয়েছেন যে আম্বেদকর সমাজতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। তবে সেইসঙ্গে তিনি যোগ করেছেন একটি অনুসিদ্ধান্ত – আম্বেদকর এটাও বিশ্বাস করতেন যে নিপীড়িত শ্রেণীগুলি (অস্পৃশ্য ও শুদ্ররা) সমাজতন্ত্র আনতে পারে কেবলমাত্র শাসকশ্রেণীতে পরিণত হওয়ার পরে।

আমি খুব স্পষ্টভাবেই দেখিয়েছি যে সমস্ত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আম্বেদকরের বীক্ষা ছিল এক ৠাডিক্যাল বুর্জোয়া বীক্ষা, গান্ধীর রক্ষণশীল বু্র্জোয়া বীক্ষার বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। সেই সময়ে সমাজতন্ত্র ছিল একটি বহুল প্রচলিত শব্দ। প্রগতিশীল বা তেমন প্রগতিশীল নয় এমন সমস্ত চিন্তাধারার প্রবক্তারা নিজেদের সমাজতন্ত্রী হিসাবেই পরিচয় দিতেন। নেহরুর ব্যাপারটিও এইরকম, আম্বেদকরের ব্যাপারটিও এইরকম। শ্রী ম্যাথুর জানা উচিত যে জমির জাতীয়করণ ও জাতিভেদের অবসানের দাবি র্র্যাডিক্যাল বুর্জোয়া গণতন্ত্রের অধীনে পড়ে। পুঁজিবাদের পূর্ণাঙ্গ বিকাশ জাতিভেদের অবসানের সামর্থ্য রাখে। এগুলি আবার গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কমিউনিস্ট কর্মসূচির মধ্যেও গুরুত্বপূর্ণ দাবি। কেননা সামন্ততান্ত্রিক শৃঙ্খল আমূল ছিন্ন না করে কোনও প্রকৃত পুঁজিবাদী বিকাশ সম্ভব নয়। একজন র্র্যাডিক্যাল বুর্জোয়ার কাছে কিন্তু এটিই চরম মোক্ষ। আর একজন কমিউনিস্টের সামনে এর মধ্যে দিয়ে খুলে যায় সেই পর্যায়ের দ্বার যখন সমাজতন্ত্রের জন্য এক মহান শ্রেণীযুদ্ধ নির্ধারকভাবে শুরু করা যাবে এবং বিজয়ী হওয়া যাবে।

জাতের অবসান কোনোভাবেই শ্রেণীর বিলোপ ঘটায় না। বিপরীতে তা বরং শ্রেণী গঠনে সহায়তা করে, শ্রেণী মেরুকরণকে তীব্রতর করে এবং শ্রেণী সংগ্রামকে করে তোলে আরও প্রকাশ্য, আরও ব্যাপক, আরও প্রত্যক্ষ। পশ্চিমী সমাজগুলির দিকে তাকালে এই ব্যাপারটি উপলব্ধি করা খুব কঠিন নয়। সেখানে জাতিভেদ দেখতে পাওয়া যায় না। এর ফলে শ্রেণীসংগ্রাম সেখানে অনেক বেশি বিশুদ্ধ রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে।

অস্পৃশ্য ও শুদ্র জাতগুলির শাসকশ্রেণীতে (শাসক জাতে) পরিণত হলেও তা কোনোভাবেই সমাজতন্ত্রের জন্ম দেবে না। ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে ঐ জাতগুলির কিছু কিছু অংশ ইতিমধ্যেই শাসকশ্রেণীতে পরিণত হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এদের মধ্যেকার প্রতিপত্তিশালী জাতগুলি নীচুতলার জাতগুলির প্রতি সেই একই ব্রাহ্মণ্যবাদী ধরনের আচরণ করে থাকে। অনগ্রসর জাতগুলির মধ্যে আবার শক্তিশালী কুলাক গোষ্ঠী আত্মপ্রকাশ করেছে, যারা কৃষিশ্রমিক ও গরিব কৃষকদের – যাঁদের অধিকাংশই দলিত – তাঁদের প্রতি তীব্র বিদ্বেষ পোষণ করে থাকে। তাঁর বইতে শ্রী ম্যাথু কেরলে কিছু কিছু শুদ্র জাতের এই ঊর্ধ্বগতি লক্ষ্য করেছিলেন। তার প্রত্যুত্তরেও তিনি দলিত-শুদ্র কৃষক জনতার মধ্যে শ্রেণী বিভাজনের কথা উল্লেখ করেছেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতির পরিবর্তিত পরিপ্রেক্ষিতে অনগ্রসর জাতের জাতীয় বুর্জোয়ারা বিপ্লবের স্থায়ী মিত্র নাও হতে পারে। এই উপলব্ধিকে স্বাগত জানিয়ে আমি আশা করব শ্রী ম্যাথু এটিও উপলব্ধি করবেন যে গ্রামাঞ্চলে এদেরই সমগোত্রীয়রা, অর্থাৎ গ্রামীণ বুর্জোয়া বা অনগ্রসর জাতের কুলাকরা গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ‘প্রধান শক্তি ও প্রধান মিত্র’ও হবে না।

আম্বেদকরবাদের শ্রেণী চরিত্র

৩। আম্বেদকরকে দলিতদের পেটিবুর্জোয়া স্তরের শ্রেণী প্রতিনিধি হিসাবে চরিত্রায়িত করার জন্য শ্রী ম্যাথু আমার ওপর খড়্গহস্ত। তিনি নিজে আম্বেদকরের শ্রেণী অবস্থান সম্পর্কে কী বলেছেন দেখা যাক। শুরুতেই তিনি ‘আম্বেদকরবাদের পেটিবুর্জোয়া সীমাবদ্ধতা’ স্বীকার করে নিয়েছেন। এরপর তিনি হাজির করেছেন একটি অপ্রমাণিত অনুমান – দলিত পেটিবুর্জোয়া শ্রেণীর মধ্যে নাকি ‘তাঁদের বুর্জোয়া হয়ে ওঠার আকাঙ্খা বারংবার ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ার পর সর্বহারা মূল্যবোধ অর্জন করার’ বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। এরসঙ্গে বৌদ্ধ-উত্তর ও তারপর দলিত প্যান্থার-উত্তর পর্যায়ে আম্বেদকরবাদের ‘উত্তরণ’ থেকে শ্রী ম্যাথু এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে ‘আম্বেদকরবাদ দলিত পেটিবুর্জোয়া ও দলিত সর্বহারার মধ্যে দ্বিধায় দীর্ণ’। শ্রী ম্যাথু আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে গেছেন উত্তরণ-পূর্ব, বৌদ্ধ-পূর্ব পর্যায়ের আম্বেদকরে, যিনি ‘দলিত বুর্জোয়ার বিপরীতে দলিত সর্বহারার প্রতিনিধিত্ব করেছেন’। শ্রী ম্যাথুর বক্তব্যের অস্পষ্টতা ও অপ্রতিষ্ঠিত অনুমানের ওপর নির্ভরশীলতা প্রমাণ করে যে আম্বেদকরকে সর্বহারার শ্রেণী-প্রতিনিধি হিসাবে নাকি বুর্জোয়াদের শ্রেণী-প্রতিনিধি হিসাবে চরিত্রায়ণ করবেন এই দ্বন্দ্বে তিনি নিজেই দীর্ণ।

শ্রী ম্যাথুর এই কষ্টসাধ্য কসরৎ কিন্তু আম্বেদকরের শ্রেণীচরিত্র সম্পর্কে আমার বক্তব্যকেই সঠিক প্রমাণ করেছে। কেননা আম্বেদকরের বিভিন্ন অবস্থানের মধ্যে যে দোদুল্যমানতা তিনি দেখিয়েছেন, তা পেটিবুর্জোয়া শ্রেণীর এক মৌলিক বৈশিষ্ট্য। এছাড়াও তাঁকে একথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া উচিত যে, দলিত হোন আর নাই হোন, পেটিবুর্জোয়াদের বু্র্জোয়া হয়ে ওঠার আকাঙ্খা বারংবার ব্যর্থ হলেই তা নিশ্চিতভাবে তাঁদের সর্বহারা মূল্যবোধে পৌঁছে দেয় না। প্রায়শই তা কেবল হতাশা ও নৈজরাজ্যবাদের জন্ম দেয়। আম্বেদকরবাদের দলিত প্যান্থার-উত্তর পর্যায় সম্পর্কে এত আশাবাদী শ্রী ম্যাথু একটি প্রশ্নের জবাব দেবেন কি : সেদিনের সেই দলিত প্যান্থাররা আজ গেল কোথায়?

আমি বলেছি যে আম্বেদকরের বীক্ষা ছিল এক র্র্যাডিক্যাল বুর্জোয়া বীক্ষা এবং এটা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে বিশেষ করে গান্ধীর রক্ষণশীল বু্র্জোয়া বীক্ষার সঙ্গে তাঁর বিতর্কের মধ্যে দিয়ে। ‘বুর্জোয়া’ শব্দটি আমাদের দেশে এতই কুখ্যাতি অর্জন করেছে যে মানুষ র্র্যাডিক্যাল আর রক্ষণশীল বুর্জোয়া বীক্ষার মধ্যে ফারাক করতে পারেন না এবং তাঁরা এটিও খেয়াল করতে পারেন না যে আমাদের গণতান্ত্রিক বিপ্লবের আশু পরিপ্রেক্ষিতে র্র্যাডিক্যাল বুর্জোয়া বীক্ষা এক বিপ্লবী বীক্ষাই বটে। আম্বেদকরের অন্ধ অনুরাগীদের কাছ থেকে আমি সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছি তাঁকে ‘বুর্জোয়া’ হিসাবে চরিত্রায়িত করার জন্য। অথচ তাঁকে একজন র্র্যাডিক্যাল বুর্জোয়া হিসাবে চিহ্নিত করার মধ্য দিয়ে আমি বরং তাঁর এক ইতিবাচক পুনর্মূল্যায়ন করেছি, তাঁর সমসাময়িক অনেকের থেকেই অনেক ঊর্ধ্বে তাঁকে স্থান দিয়েছি এবং কমিউনিস্ট ও র্র্যাডিক্যাল আম্বেদকরপন্থীদের মধ্যে রণনৈতিক ঐক্যের পথ প্রশস্ত করতে চেয়েছি। এই ব্যাপারটি শ্রী মাথু একেবারেই ধরতে পারেননি।

এখানে মূল যে ব্যাপারটির দিকে মনোযোগ দেওয়া দরকার তা হল আম্বেদকরের এক সমালোচনামূলক মূল্যায়ন করা, যা তাঁর বিপ্লবী গণতান্ত্রিক আদর্শকেও তুলে ধরবে, আবার একই সঙ্গে তাঁর র্র্যাডিক্যাল বুর্জোয়া বীক্ষার অসঙ্গতিগুলিকেও স্বীকার করবে। কেননা, শেষবিচারে চীনের সান ইয়াৎ সেনও ছিলেন একজন র্র্যাডিক্যাল বুর্জোয়া, যদিও তিনি ছিলেন আম্বেদকরের থেকে অনেক বেশি একনিষ্ঠ।

বিএসপি বনাম জনতা দল

৪। শ্রী ম্যাথু এখনও মনে করেন যে বিএসপি-র দলিত মহা-ঐক্যের ধারণা রিপাবলিকান (আম্বেদকরপন্থী) অনুশীলনের তুলনায় এক বিশেষ তাত্ত্বিক অগ্রগতি এবং মণ্ডল মঞ্চকে তুলে ধরে জনতা দল বিএসপি-র এই দলিত মহা-ঐক্যের কাঠামোকে ইতিবাচক ও কার্যকরীভাবে গ্রহণ করেছে। বইটি প্রকাশের পরবর্তী পরিস্থিতি শ্রী ম্যাথুকে সাধারণভাবে জনতা দল এবং বিশেষভাবে রামবিলাস পাসোয়ান সম্পর্কে তাঁর উচ্ছ্বাসকে যথেষ্ট সংযত করতে বাধ্য করেছে এবং তিনি শুধুমাত্র ‘তথ্যের উল্লেখের’ মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছেন। তথ্যও কিন্তু উল্টো কথাই বলছে। পরবর্তীকালে বিএসপি জনতা দলের পালের হাওয়া কেড়ে নিয়েছে আর কাঁসিরাম রামবিলাস পাসোয়ানকে নিছক এক পার্শ্বচরিত্রে পরিণত করেছে। পাশার দান এভাবে উল্টে গেল কেন, তার কোনো ব্যাখ্যা শ্রী ম্যাথুর কাছে নেই।

ব্যর্থ হলেন যে দেবতা

৫। শ্রী ম্যাথুর কাছে মণ্ডল হল তাঁর প্রিয় দলিত বিপ্লবের পূর্বসূরী। কিন্তু হায়! সে বিপ্লব মাঝপথে পথভ্রষ্ট হয়ে গেল। তাঁর হতাশা খুবই স্পষ্ট। আগে তিনি মণ্ডলের বিরোধিতা করার জন্য মূলধারার বামদের – উচ্চবর্ণের শিল্পীয় শ্রমিক বাহিনীর তথাকথিত প্রতিনিধিদের অভিযুক্ত করেছিলেন; আর এখন তিনি মণ্ডল সম্পর্কে সিপিআই-এর অবস্থানের প্রশংসা করছেন আর সুবিধাভোগী স্তর সম্পর্কিত রায়কে সমর্থন করার জন্য আমাদের ও সিপিআই(এম)-এর বিরুদ্ধে তাঁর ক্রোধ কেন্দ্রীভূত করছেন।

তথাকথিত শ্রমিক অভিজাততন্ত্র বা শ্রী ম্যাথুর ভাষায় ‘উচ্চবর্ণের শিল্পীয় শ্রমিকদের’ মধ্যে যে সিপিআই-এর শিকড় আমাদের এমনকি সিপিআই(এম)-এর চেয়েও গভীরে প্রোথিত, মণ্ডলের সাপেক্ষে সেই সিপিআই-এর অবস্থান বা বিহারের মণ্ডল রাজত্বে সিপিআই ও সিপিআই(এম)-এর ধারাবাহিকভাবে জনতা দলের ‘স্বাভাবিক মিত্র’ হয়ে চলার বিষয়টি তিনি কীভাবে ব্যাখ্যা করছেন, তা আমি জানি না।

আমরা যে সুবিধাভোগী স্তর সংক্রান্ত রায়কে সমর্থন করছি, শ্রী ম্যাথুর মতে তা হল অর্থনৈতিক মানদণ্ডের ভিত্তিতে সংরক্ষণকে সমর্থন করার সামিল। অর্থাৎ তা হল অর্থনৈতিক অগ্রগতির উপায় হিসাবে সংরক্ষণকে দেখা এবং এইভাবে তা আম্বেদকরের ‘অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র ও প্রশাসন যন্ত্রের গণতান্ত্রিকীকরণের’ দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে উন্নয়নের গান্ধীবাদী দৃষ্টিভঙ্গির পৃষ্ঠপোষকতা করে। কী অসাধারণ যুক্তি পরম্পরা!

মণ্ডলের বিশ্লেষণে আমি যা বলেছি এবং যার থেকে শ্রী ম্যাথু উদ্ধৃতি দিয়েছেন তা হল ‘ক্ষমতার কাঠামোয় নতুন ভারসাম্য আনা’। অন্য কথায়, শাসক শ্রেণীগুলির পরিধির মধ্যে অনগ্রসরদের কিছু অংশকে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র ও প্রশাসনযন্ত্রের গণতান্ত্রিকীকরণ। বর্তমান আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় কোনো সংস্কারমূলক পদক্ষেপ এছাড়া আর কী ঘটাতে পারে? যে সুবিধাভোগী স্তর অবাধ প্রতিযোগিতায় সক্ষম হয়ে উঠেছে এবং অন্যথায় যারা অনগ্রসরদের জন্য নির্ধারিত সমগ্র কোটাকেই আত্মসাৎ করে নেবে, সেই সুবিধাভোগী স্তর সংক্রান্ত রায়কে সমর্থন করে আমরা কি অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র ও প্রশাসনযন্ত্রের গণতান্ত্রিকীকরণের পরিধিকেই বিস্তৃত করার চেষ্টা করছি না?

এইভাবে সংস্কারের প্রক্রিয়ার মধ্যে এ র্র্যাডিক্যাল উপাদানকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আমরা কি চাপ সৃষ্টি করছি না? দলিত সর্বহারার এক স্বঘোষিত প্রতিনিধির পক্ষে সুবিধাভোগী স্তরের স্বার্থের জন্য এই একনিষ্ঠ ওকালতি সত্যিই বিস্ময়কর। তবে তাঁর কল্পনার জগতে শ্রী ম্যাথু অবশ্য বিশ্বাস করেন যে তফশিলি জাতিগুলি মণ্ডলের সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদান করেছিল আর মণ্ডল-বিরোধী প্রত্যাঘাতের মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাদেরই। মণ্ডলকে কেন্দ্র করে দলিত ও অনগ্রসরদের ঐক্যবদ্ধ করার মহান সুযোগকে কাজে না লাগানোর জন্য এবং তার পরিবর্তে গ্রামীণ সর্বহারা ও অনগ্রসর জাতের কুলাকদের মধ্যে শ্রেণীসংঘাতকে তীব্রতর করে তুলতে সচেষ্ট থাকার জন্য বামদের অদূরদর্শিতায় তিনি অনুশোচনা প্রকাশ করেছেন।

প্রথমত, আমি বলব যে, এই অভিযোগ সিপিআই ও সিপিআই(এম)-এর বিরুদ্ধে খাটে না। গ্রামীণ সর্বহারা ও অনগ্রসর জাতের কুলাকদের মধ্যে শ্রেণীসংঘাত তীব্রতর করে তুলছে – তাদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগের সুযোগ কারও নেই। তাই যদি হত তবে জনতা দলের সঙ্গে তাদের মিতালি এত দীর্ঘস্থায়ী হত না। আমাদের ক্ষেত্রে এই অভিযোগ আমি স্বীকার করি এবং শ্রী ম্যাথু শুনে আশ্চর্য হবেন যে বিহারে আমাদের বামপন্থী বন্ধু সিপিআই এবং সিপিআই(এম) প্রতিনিয়তই আমাদের এই একই অভিযোগে অভিযুক্ত করে থাকে।

দ্বিতীয়ত, দলিত ও অনগ্রসরদের মধ্যে ঐক্যের যে রূপ শ্রী ম্যাথু কল্পনা করেছেন আশ্চর্যজনকভাবে তার মূল কথা হল কুলাকদের সাপেক্ষে দলিতদের তাদের শ্রেণীস্বার্থকে বিসর্জন দিতে ও সুবিধাভোগী স্তরগুলির স্বার্থে লড়াই করতে, ত্যাগ স্বীকার করতে এবং এমনকি নেতৃত্ব দিতে আহ্বান জানানো।

শ্রী ম্যাথুর জানা উচিত যে নিজেদের লড়াই-এ নেতৃত্ব দেওয়ার যথেষ্ট ক্ষমতা কুলাকদের আছে, আর রামবিলাস পাসোয়ানের মতো কুলাককূলের দালালরা ছাড়া অন্যান্য দলিতরাও তাঁর পরামর্শে কান দেবে না। বস্তুত, কার শ্রেণীস্বার্থের কথা শ্রী ম্যাথু সর্বাগ্রে ভাবেন, সেটুকুই তিনি তাঁর পরামর্শের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করে ফেলেছেন।

তিনি অবশ্য একটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন তুলে ধরেছেন। শক্তিশালী অনগ্রসরদের অন্তর্ভুক্ত করে শাসকশ্রেণীর ভিত্তিকে প্রসারিত করা যদি মণ্ডল কর্মসূচির লক্ষ্য হয়ে থাকে, তবে সুবিধাভোগী স্তরকে বাদ দিয়ে সেই উদ্দেশ্য কি সিদ্ধ হতে পারে?

শ্রী ম্যাথু আশ্বস্ত থাকতে পারেন, সামাজিক বাস্তবতা কখনই আদালতের রায়ের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে না। রায়কে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাতে ও তাকে প্রতীকসর্বস্বতায় পর্যবসিত করে তুলতে সামাজিক বাস্তবতা অবশ্যই উপায় বার করে নেবে। তামিলনাড়ু ইতিমধ্যেই সংরক্ষণকে ৫০ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার রায়কে পাশ কাটিয়ে গেছে এবং অন্য কয়েকটি রাজ্যও শীঘ্রই তাকে অনুসরণ করবে। বিহার ও উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলিতে স্তর নির্ধারণের মান এমনভাবে সূত্রায়িত হয়েছে যে নথিভুক্ত করার মতো কোনো সুবিধাভোগী স্তর আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সুবিধাভোগী স্তর সংক্রান্ত রায় বামদের কাছে জাত-সম্প্রদায়গুলির মধ্যে শ্রেণী সচেতনতা বৃদ্ধির সুযোগ এনে দিয়েছে আর সে সুযোগ আমরা হাতছাড়া করিনি।

শ্রেণী ও জাত

শ্রেণীই হল বুনিয়াদী বর্গ আর উৎপাদনের ধরনের মধ্যেই তার উৎস – আমার এই সূত্রায়নের সঙ্গে শ্রী ম্যাথু পুরোপুরি একমত। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাঁর তাত্ত্বিক কাঠামোর মধ্যে এক দ্বৈততা আমদানি করে বলেছেন জাতের উৎসও রয়েছে উৎপাদনের ধরনের মধ্যেই।

মার্কস ও এঙ্গেলস যখন ঘোষণা করেন যে, এতকালের সমস্ত সমাজের (আদিম সাম্যবাদী সমাজ ছাড়া) ইতিহাস হল শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস, তখন তাঁরা সামাজিক বিকাশের একটি বুনিদায়ী সূত্রকেই আবিষ্কার করেন। অবশ্য কেবলমাত্র একটি পরিপক্ক পুঁজিবাদী সমাজেই শ্রেণীগুলি ও তাদের মধ্যকার সংগ্রাম বিশুদ্ধতর রূপে দেখা দেয়। অন্য সমস্ত সমাজে শ্রেণী সংগ্রাম অত্যন্ত জটিল রূপ পরিগ্রহ করে। মার্কস নিজে বেশ কিছু অধ্যয়নে দেখিয়েছেন, কীভাবে ধর্মযুদ্ধ, ঔপনিবেশিক অভিযান, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, সামাজিক সম্প্রদায়গুলির মধ্যকার দ্বন্দ্ব ইত্যাদি বাহ্যিক রূপের অন্তরালে বিভিন্ন শ্রেণীস্বার্থগুলি পরস্পরের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। এই মার্কসবাদী পরিপ্রেক্ষিতের ওপর ভিত্তি করে ভারতীয় কমিউনিস্টদেরও জাতপাতের লড়াইয়ের বাহ্যিক রূপ ভেদ করে তার আড়ালে আমাদের সমাজের শ্রেণী-গতিসূত্রের মর্মবস্তুকে উদ্ঘাটিত করতে হবে। কিন্তু শ্রেণী ও জাতের দ্বৈততার তত্ত্ব এই অধ্যয়নে প্রথম থেকেই বাধা দিয়ে চলেছে।

জাতিভেদ প্রথাকে আমি উৎপাদনের একটি নির্দিষ্ট ধরন ও তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ উৎপাদন সম্পর্কের ফসল হিসাবেই দেখিয়েছি। এখানে শ্রেণীসম্পর্কগুলি জাতের রূপ পরিগ্রহ করে, যেগুলির ওপর আবার পুরোহিত সম্প্রদায় দৈব মহিমা আরোপ করে। কিন্তু তাদের ‘স্থায়িত্ব’ মূলত কোনো দৈবমহিমার দ্বারা নির্ধারিত হয় না। উৎপাদিকা শক্তির একটি সুনির্দিষ্ট স্তর থেকে জন্ম নেওয়া গ্রামসমাজের স্থিতিশীল সামাজিক সংগঠন তা নির্ধারণ করে থাকে। এখানে জাত ও শ্রেণীগুলিকে একে অপরের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়। শ্রেণী ও জাতের এই সংহতি, কাঠামো ও উপরিকাঠামোর মধ্যে এই সাযুজ্য নিতান্তই বাহ্যিক, কেননা এ দুটি হল সুনির্দিষ্টভাবে দুটি ভিন্ন বর্গ, যাদের উৎস রয়েছে যথাক্রমে কাঠামো ও উপরিকাঠামোয়, উৎপাদনের ধরন ও বণ্টনের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে।

উৎপাদিকা শক্তিগুলির বিকাশ এবং উৎপাদনের ধরনে ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসার সাথে সাথে এই সংহতি ভেঙে যায়, শ্রেণী এবং জাত, কাঠামো এবং উপরিকাঠামোর মধ্যে সংঘাত দেখা দেয়, একে অপরকে নির্ধারণের চেষ্টা করে। আর দীর্ঘ এক উত্তরণশীল পর্যায় ধরে শ্রেণীগত আত্মঘোষণা স্পষ্টতরভাবে আত্মপ্রকাশ করে এবং অদ্ভুত মনে হলেও প্রায়শই তা জাতগত গতিময়তার এক ঘূর্ণাবর্তের মধ্য দিয়ে অভিব্যক্ত হয়। বিভিন্ন জাতের মধ্যে উৎপাদনের উপকরণগুলির বিভাজনের তথাকথিত স্থায়িত্বে চিড় ধরে। তবে, নতুন আধুনিক অর্থনৈতিক শ্রেণীগুলি অবশ্য রাজনৈতিক তথা প্রশাসনিক ক্ষমতার ভাগের জন্য নিজেদের মধ্যে সংগ্রামে জাতের প্রাতিষ্ঠানিক পতাকাকে কাজে লাগিয়ে থাকে। সেই পুরোনো হাতিয়ার, কিন্তু অন্তর্বস্তুর মধ্যে আমূল পরিবর্তন ঘটে যায়। এই পর্যায়ে প্রথম পর্যায়ের সংহতির নেতিকরণ ঘটে এবং শ্রেণী ও জাতগুলি পরস্পরকে ছেদ করে, আবার পরস্পরের মধ্যে ঢুকে যায়। এই পর্যায়ে আবার শ্রেণী ও জাতগত সত্তার মধ্যে দ্বন্দ্বও তীব্রতর হয়ে ওঠে। শেষপর্যন্ত ঐতিহাসিক আন্দোলন এই পর্যায়েরও নেতিকরণ ঘটাবে এবং কাঠামো ও উপরিকাঠামোর মধ্যকার সংহতি ও সাযুজ্যকে ফিরিয়ে আনবে, অবশ্য উন্নততর রূপে। আর তখন জাতপ্রথার বিলোপ ঘটবে এবং শ্রেণীগুলির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ও শ্রেণীসংগ্রাম বিশুদ্ধতর রূপে আবির্ভূত হবে। শুধুমাত্র আত্মগত বাসনা এই সাযুজ্যকে ফিরিয়ে আনতে পারে না। আমি আগেই উল্লেখ করেছি, উৎপাদনের সুনির্দিষ্ট ধরন ও তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ উৎপাদন সম্পর্ক থেকে সৃষ্টি হয়েছে জাতপাত ব্যবস্থার। তার বিলোপও ঘটবে উৎপাদিকা শক্তি ও উৎপাদনের ধরনের উন্নততর স্তরে। আমি আরও বলেছি, পুঁজিবাদের অবাধ বিকাশ অর্থনীতি-বহির্ভূত রূপের নিপীড়নের অবসান ঘটায়, শ্রেণীকেই বণ্টনের ধরনের প্রত্যক্ষ নির্ধারক করে তোলে এবং এইভাবে জাতিপ্রথাকে ধ্বংস করার সুমহান সম্ভাবনা তার মধ্যে নিহিত রয়েছে।

শ্রী ম্যাথুর মতে জাতপাত ব্যবস্থাই উৎপাদন সম্পর্ককে প্রাথমিকভাবে নির্ধারণ করে এবং উৎপাদনের উপকরণগুলিকে বিভিন্ন জাতের মধ্যে স্থায়ীভাবে বিভাজিত করে। সুতরাং তাঁর বিবেচনায় জাতপাত ও তার স্থায়িত্ব পুরোহিততন্ত্রের চক্রান্তের ফসল। এই ব্যবস্থা উপরিকাঠামোর প্রধান ভূমিকা, অর্থাৎ বণ্টন ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে – একথা স্বীকার করে নিয়েও উৎপাদন সম্পর্কের ক্ষেত্রে জাতপাত যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে – ভাষান্তরে যা হল কাঠামোর ওপর উপরিকাঠামোর ক্রিয়া, তার অর্থ করা হয়েছে যে, জাতও কাঠামোর অন্তর্গত। কিন্তু তাতে সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্টি হয় একটি ধাঁধার – তাই যদি হয়, তাহলে অপর বুনিয়াদী বর্গ অর্থাৎ শ্রেণীর তখন কী অবস্থা হয় এবং জাতের সঙ্গে তার সম্পর্ক এগোয় কীভাবে? আমাদের সমাজের সীমিত শিল্প বিকাশের মধ্যে শ্রেণী গঠনের প্রক্রিয়াকে – তা যতই প্রারম্ভিক পর্যায়ের হোক না কেন – শ্রী ম্যাথু দেখতে পান না। বিপরীতে তা জাতপাতের গঠনকেই শক্তিশালী করে বলে তাঁর মনে হয়েছে। প্রাক-পুঁজিবাদী গঠনের ক্ষেত্রে আমার সূত্রায়ন ছিল, ঐ পর্যায়ে শ্রেণী জাতরূপে অভিব্যক্ত হতে পারে। এর বিপরীতে শ্রী ম্যাথু যে তত্ত্ব হাজির করেছেন তা হল ঐ পর্যায়ে জাত অর্থনৈতিক ও অর্থনীতি-বহির্ভূত শোষণকে সমন্বিত করে অর্থনৈতিক শ্রেণীরূপে আবির্ভূত হয়। তিনি আরও বলেছেন, অন্যান্য ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে শ্রেণী ও জাত নয় বরং শ্রেণীর অর্থনীতিগত ও অর্থনীতি-বহির্ভূত দিকগুলি পরস্পরের মধ্যে মিশে যায়। অন্যভাবে বলতে গেলে, শ্রেণী এবং জাত উভয়ের অর্থনৈতিক ও অর্থনীতি-বহির্ভূত দিক আছে, উভয়ের উৎস উৎপাদনের ধরনের মধ্যে, উভয়েই বুনিয়াদী বর্গ এবং এইভাবে তাদের মধ্যে কোনো বৈপরীত্য নেই। শ্রীযুক্ত ম্যাথু, এতেও কিন্তু ধাঁধাটির মীমাংসা হল না। তাদের নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যের বিচারে দুটি বর্গই বুনিয়াদী হয় কীভাবে? তাদের পরস্পরের মধ্যে পার্থক্যই বা কোথায়? এই দ্বৈততা আমাদের কোথাও পৌঁছে দেয় না। আর এর একমাত্র যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত হতে পারে যে, জাতই হল বুনিয়াদী বর্গ যা শ্রেণীকে নির্ধারিত করে। এইভাবে শ্রেণীকে ঊর্ধ্বে তুলে স্থান দেওয়া হয়েছে উপরিকাঠামোয়, যে উপরিকাঠামো উদ্ভাবন করেছে আধুনিক পুরোহিততন্ত্র, অর্থাৎ কমিউনিস্টরা। জাতপ্রথার প্রতি-সিদ্ধান্ত (অ্যান্টি-থিসিস) হল জাতপ্রথাই এবং জাতগুলির মধ্যকার আসন্ন সংগ্রামে শ্রেণী অবলুপ্ত হয়ে যাবে! শ্রী ম্যাথুর তথাকথিত দলিত গণতান্ত্রিক বিপ্লবের এটিই হল প্রকৃত বিষয়বস্তু।

শ্রেণীর নির্মূলীকরণ

দলিত গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্যে সর্বহারাকে আমরা সংঘবদ্ধ শ্রেণী হিসাবে দেখতে পাই না, সেখানে আমরা দলিত সর্বহারা ও উচ্চ জাতের সর্বহারাদের সন্ধান পাই। একইভাবে কৃষক ও বুর্জোয়াদের বিভিন্ন শ্রেণীগুলিও জাতের আনুগত্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন অংশে খণ্ডিত এবং পরস্পরের বিরোধিতায় রত। জাতের মতো শ্রেণী যে খণ্ডিত সত্তা নয় এবং হতে পারে না, একথা শ্রী ম্যাথু বিস্মৃত হয়েছেন। কারখানা ব্যবস্থা এবং পুঁজিবাদ সর্বহারার শ্রেণীসত্তা নির্মাণের শর্ত সৃষ্টি করেছে, আর সেই উদ্দেশ্যে যৌথ কার্যকলাপে তাদের সংগঠিত করা ছাড়াও একটি কমিউনিস্ট পার্টিকে সংগঠিত ও অসংগঠিত শ্রমিকশ্রেণীর বিভিন্ন অংশের মধ্যকার জাতপাত, সাম্প্রদায়িক ও উগ্র জাতিদম্ভের ঝোঁকের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে হবে।

পুঁজিবাদ ও শিল্পীয় শ্রমিকশ্রেণীর উদ্ভবকে জাতপাতের বৈপরীত্য হিসাবে ও তার মধ্যে জাতপাতের বিলোপের সম্ভাবনাকে শ্রী ম্যাথু দেখতে পান না। তিনি এটাও ভুলে যান যে, জাতপাতকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে আম্বেদকরবাদ সহ অন্যান্য র্র্যাডিক্যাল চিন্তাধারার আবির্ভাব ঘটে কেবলমাত্র পুঁজিবাদের উন্মেষের সাথে সাথে এবং পশ্চিম থেকে উদ্ভূত র্র্যাডিক্যাল বুর্জোয়া ও সর্বহারা চিন্তাধারার সঙ্গে আন্তঃক্রিয়ার প্রক্রিয়াতেই। তিনি মনে করেন, আত্মগত পরিকল্পনা থেকে যে জাতপাতের উদ্ভব, সাংস্কৃতিক বিপ্লব ধরনের সেরকম কোনো এক বিষয়ীগত প্রচেষ্টার মাধ্যমে তার বিলোপ ঘটানো যাবে। জাতপাতের বিরুদ্ধে আম্বেদকরের জেহাদ এবং তাঁর ৠাডিক্যাল অর্থনৈতিক কর্মসূচির মধ্যে তিনি কোনো যোগসূত্র দেখতে পান না এবং এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, জাতপাতের ধ্বংস ব্যতীত পুঁজিবাদ বা শিল্পায়ন কোনোটাই সম্ভব নয়।

সর্বহারা নেতৃত্ব

নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাওবাদী ধারণা সম্পর্কে শ্রী ম্যাথু কিছু অদ্ভুত মতামত পোষণ করেন। পশ্চিমী দেশগুলির পুরোনো গণতান্ত্রিক বিপ্লব এবং পূবের দেশের নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মৌলিক পার্থক্য এই যে দ্বিতীয়টি পুঁজিবাদে থেমে যায় না, নিরবচ্ছিন্নভাবে সমাজতন্ত্রে উত্তীর্ণ হয় – আমার এই বক্তব্য শ্রী ম্যাথুর মতে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী ধারণার সঙ্গে মেলে না। তাঁর মতে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী ধারণা হল নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের নেতৃত্ব দেয় শ্রমিকশ্রেণী। ভালো কথা, কিন্তু নতুন সমাজব্যবস্থার ক্ষেত্রে এই সর্বহারা নেতৃত্বের অর্থ কী দাঁড়ায়? নয়া বা পুরোনো, গণতান্ত্রিক বিপ্লবের অর্থনৈতিক অন্তর্বস্তু অবশ্যই বুর্জোয়া। এই বিপ্লব সামন্ত অবশেষের বিলোপ ঘটিয়ে অবাধ পুঁজিবাদী বিকাশের পথ প্রশস্ত করে। কিন্তু আধা-ঔপনিবেশিক দেশে, যেখানে ঐতিহাসিকভাবে এই বিপ্লবের নেতৃত্ব বর্তায় শ্রমিকশ্রেণীর ওপর, সেখানে এর পাশাপাশি এক শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক ক্ষেত্রও আত্মপ্রকাশ করে এবং সর্বহারার নেতৃত্ব সমাজতন্ত্রে উত্তরণ সুনিশ্চিত করে। মাও-এর চীনে ঠিক এইরকমই ঘটেছিল আর মাও-এর “নয়া গণতন্ত্র সম্পর্কে” প্রবন্ধে এমনকি একনজর চোখ বোলালেও এই সবেরই যথার্থতা প্রমাণ হয়।

কিন্তু শ্রী ম্যাথুর সমস্যা হল, তাঁর সর্বহারারা দলিত সর্বহারা – গ্রামীণ সর্বহারা এবং অপ্রধান অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক, যারা নাকি উচ্চ জাতগুলি থেকে আগত শিল্পীয় সর্বহারাদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ। তাছাড়া, অনগ্রসর জাতের কুলাক ও বুর্জোয়ারা এই দলিত সর্বহারার প্রধান মিত্র ও প্রধান শক্তি। শ্রী ম্যাথু ভালোভাবেই জানেন, এইরকম ‘শ্রেণী-বিন্যাস’ নিয়ে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ সম্ভব নয়, কাম্যও নয়। তিনি এটাও ভালোভাবে জানেন যে, সমাজতন্ত্র গঠন করতে হলে একটি শক্তিশালী সর্বহারা রাষ্ট্রের আবশ্যক। এর বিপরীতে তাঁর নৈরাজ্যবাদী মনোভঙ্গি রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক ভূমিকাকে অস্বীকার করে। কাজেই তিনি সমাজতন্ত্রের প্রশ্নে দায়সারা থেকে যান এবং কখনও গর্বাচভের রাশিয়া বা দেং-এর চীনের দোহাই দিয়ে আবার কখনও বা আম্বেদকরের রাষ্ট্রবাদী নির্দেশাবলীর সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার অছিলায় নতুন সমাজব্যবস্থার প্রশ্ন এড়িয়ে চলেন। শ্রী ম্যাথু নিশ্চয়ই জানেন, সমভিত্তিতে জনগণের মধ্যে রাষ্ট্রের মালিকানাধীন শেয়ারগুলির তথাকথিত বণ্টন বেসরকারিকরণ ছাড়া অন্য কিছু নয়।

শ্রী ম্যাথুর এটাও জানা উচিত যে নকশালবাড়ি আন্দোলনে গ্রামীণ সর্বহারা এবং দরিদ্র কৃষকরা যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন, তা সর্বহারা বিশ্ববীক্ষার দ্বারাই পরিচালিত হয়েছিল এবং কমিউনিস্ট পার্টির মাধ্যমেই তা তাঁদের কাছে পৌঁছেছিল। এই পথনির্দেশ ও নেতৃত্ব থেকে তাঁদের বঞ্চিত করার অর্থ হল বুর্জোয়াদের কবলে তাঁদের ঠেলে দেওয়া। এ দুয়ের মধ্যবর্তী কোনো পথ হতে পারে না। সর্বহারার বিশ্ববীক্ষা হল মূলত শিল্পীয় সর্বহারারই বিশ্ববীক্ষা। সমাজতন্ত্র এবং সাম্যবাদের পথে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যাওয়ার ঐতিহাসিক ব্রত ঐ শ্রেণীর ওপর বস্তুগতভাবে ন্যস্ত হয়েছে – তবে শুধুমাত্র বস্তুগতভাবেই। বিষয়ীগত দিক থেকে বলতে গেলে ঐ ঐতিহাসিক ব্রতের উপযোগী করে ঐ শ্রেণীকে গড়ে তুলতে হবে কমিউনিস্ট পার্টিকেই, যার মধ্যে এই বাস্তব ভবিতব্যের ঘনীভূত প্রকাশ ঘটেছে।

শ্রী ম্যাথুর প্রিয় বিষয় হল সুবিধাভোগী স্তর অর্থাৎ অনগ্রসর জাতগুলির কুলাকদের স্বার্থে লড়াই করার জন্য দলিতদের উপদেশ বর্ষণ করা। ধনী কৃষকরাও বিপ্লবের প্রধান মিত্র – এই অজুহাতে তিনি এর যথার্থতা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেন। শ্রীযুক্ত ম্যাথু, আবার ভুল হচ্ছে। শ্রেণী হিসাবে ধনী কৃষকদের খুব বেশি হলে ঐক্য ও সংগ্রামের নীতির মাধ্যমে নিরপেক্ষ করা যাবে। তাদের মধ্যে একটি ক্ষুদ্র অংশ বিপ্লবের পক্ষে দাঁড়াতে পারে, অন্যরা এর তীব্র বিরোধিতাই করবে। ভারতবর্ষের পরিস্থিতিতে খামার ক্ষেত্রে অধিকতর বিকাশের দরুন কুলাকদের দিক থেকে আরও বেশি প্রতিরোধের মুখোমুখি হওয়ার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।

তাঁর কাঙ্খিত আঁতাতের নেতৃত্ব ‘জাতীয় বুর্জোয়াদের’ এবং গ্রামীণ দরিদ্রদের ওপর আধিপত্যকারী অনগ্রসর জাতগুলির কুলাকদের হাতে চলে যাওয়ার বিপদ সম্পর্কে শ্রী ম্যাথু একমত। তিনি এটিকে অবশ্য মাওবাদী মডেলের সাধারণ বিপদ হিসাবেই বর্ণনা করেছেন এবং এমনকি এও বলেছেন যে এই বিপদ ইতিমধ্যেই আমাদের পার্টি পরিচালিত আন্দোলনকেও গ্রাস করেছে। শ্রী ম্যাথুকে আমি শুধু পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে আমাদের আন্দোলনের মধ্যে তা যদি ঘটত তবে সিপিআই ও সিপিআই(এম)-এর মতো আমাদের পার্টিও বিহারে জনতা দলের ‘স্বাভাবিক মিত্র’ হয়ে যেত। বিহারে একমাত্র মণ্ডলপন্থী জনতা দল সরকারের বিরুদ্ধে লাল পতাকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা গ্রামীণ দরিদ্রদের চূড়ান্ত শ্রেণীগত ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার পতাকাকে তুলে ধরা ছাড়া অন্য কিছু নয়।

আমার লেখাতে আমি দেখিয়েছিলাম যে, শ্রী ম্যাথুর সংশ্লেষণ মার্কসবাদ এবং আম্বেদকরবাদ থেকে তাদের র্র্যাডিক্যাল আত্মাকে মুছে দিয়েছে। আর তিনি যা হাজির করেছেন তা হল এই দুই ধারার দুই স্বনামধন্য দলত্যাগী কে ভেনু ও রামবিলাস পাসোয়ানের এক অভূতপূর্ব সংমিশ্রণ। বোঝা যাচ্ছে, এ বিষয়ে শ্রী ম্যাথু বিন্দুমাত্র বিচলিত নন এবং তিনি গর্বিত যে তাঁর তাত্ত্বিক প্রয়াস বহুল মাত্রায় বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করেছে।

এই বাস্তবতার স্বরূপ কী? জনযুদ্ধ গোষ্ঠীর পূর্বতন সম্পাদক কে টি সত্যমূর্তির বিএসপি-তে যোগদান এবং কেরলে কে আর গৌরীর গণতান্ত্রিক সুরক্ষা কমিটিতে সিআরসি-র পূর্বতন সম্পাদক কে ভেনুর যোগদান – এই দুটি ঘটনাকেই শ্রী ম্যাথু তাঁর তাত্ত্বিক প্রয়াসের সমর্থনে সাক্ষ্য হিসাবে উল্লেখ করেছেন – যে দুটি ঘটনা হল মার্কসবাদের মতাদর্শ ও নকশালবাদের ব্রতের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার দৃষ্টান্ত।

তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে তিনি ১৯৯৩-এর ১৪ এপ্রিল রামবিলাস পাসোয়ানের সঙ্গে ‘আম্বেদকর জয়ন্তী’ মঞ্চে আমাদের যোগদানেরও উল্লেখ করেছেন। প্রথমেই বলা দরকার, এটি ছিল সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী প্রচার সমিতির কর্মসূচি। ঐ কর্মসূচির দিন নির্ধারণ এবং তা নিয়ে পাসোয়ানের জেদ তাঁর অভিপ্রায় সম্পর্কে আমাদের সন্দিগ্ধ করে তোলে। এ নিয়ে কমিটিতে আমরা বারবার আমাদের আশঙ্কা ব্যক্ত করি এবং আমাদের সুস্পষ্টভাবেই আশ্বস্ত করা হয়। এর পরেও সমস্ত গণতান্ত্রিক রীতিনীতি লঙ্ঘন করে শ্রী পাসোয়ান গোটা কর্মসূচিকেই আম্বেদকর জয়ন্তী উদযাপনে পর্যবসিত করেন এবং সভাপতি সুরজিত আমাদের প্রতিবাদকে কোনো আমল দেন না। এইভাবে পরিস্থিতি চরমে পৌঁছায় এবং আমরা জাতীয় প্রচার সমিতির সঙ্গে সম্পর্ক ছেদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।

দ্বিতীয়ত, আমি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বলতে চাই, র্র্যাডিক্যাল আম্বেদকরপন্থী শক্তিগুলির সঙ্গে একই মঞ্চে অংশগ্রহণ বা আম্বেদকর জয়ন্তী উদযাপনে আমাদের কর্মীদের যোগদান কোনোমতেই আমাদের পার্টির নীতির বিরোধী নয়। আম্বেদকরকে আমরা র্র্যাডিক্যাল গণতন্ত্রী হিসাবে শ্রদ্ধা করি এবং আমাদের সাধারণ গণতান্ত্রিক উদ্যোগে র্র্যাডিক্যাল আম্বেদকরপন্থীদের সঙ্গে হাত মেলাতে আমরা একান্ত আগ্রহী। একে মার্কসবাদ ও আম্বেদকরবাদের সমন্বয়ের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা এবং সত্যমূর্তি এবং কে ভেনুর দলত্যাগের সঙ্গে একাকার করে ফেলা তাত্ত্বিক দেউলিয়াপনার চূড়ান্ত নিদর্শন।

আশা করব, আমার কিছু শব্দচয়নের ফলে বিতর্কে যে তিক্ততার সৃষ্টি হতে পারে সে ব্যাপারে শ্রী ম্যাথু বিশেষ গুরুত্ব দেবেন না।

আমার বিশ্বাস, গ্রামীণ দরিদ্রদের ওপর কুলাকদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার যে বিপদ তাঁর মডেলের মধ্যে নিহিত রয়েছে, শ্রী ম্যাথুকে তা স্বীকার করতে বাধ্য করাতে পেরেছি। ‘মাও-এর মডেলকে প্রতিটি সমাজ ও যুগের নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য ও গতিশীলতার সঙ্গে উপযোগী করে নিয়ে’ তিনি এই বিপদের মোকাবিলা করতে চান। আমার বিভ্রান্তি কিন্তু এখনও দূর হল না। আর আমি আশা রাখি আমাদের নিজ নিজ চিন্তাধারার ‘সমন্বয়’ সাধনের লক্ষ্যে তিনি এই বিষয় নিয়ে গুরুত্ব সহকারে চিন্তাভাবনা করবেন।