(লিবারেশন, আগস্ট ১৯৯৩ থেকে)

নারীমুক্তি আজও প্রায় সমগ্র দুনিয়ার নারী সমাজের স্লোগান। এর অর্থ সমগ্র মানবসমাজের অর্ধেক অংশ আজও পরাধীন। আমরা সর্বহারা মুক্তির কথা, কৃষক মুক্তির কথা, জাতীয় মুক্তির কথা বলে থাকি। জাতীয় মুক্তি বলতে আমরা মনে করি উপনিবেশবাদী শক্তিগুলির আর্থিক-রাজনৈতিক শৃঙ্খল থেকে মুক্তি। বিশ্বের অনেক দেশই মুক্তি অর্জন করেছে – অনেক দেশে মুক্তির সংগ্রাম চলছে। কৃষক মুক্তি হল সামন্ত-বন্ধন থেকে মুক্তি। অনেক দেশেই কৃষকরা মুক্তি অর্জন করেছেন এবং অন্য অনেক দেশে মুক্তির জন্য লড়ছেন। সর্বহারা মুক্তির অর্থ হল মজুরি-শ্রম থেকে মুক্তি। সর্বহারাও কয়েকটি দেশে এই লড়াই জিতেছেন এবং অন্যত্র তাঁরা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। মহিলারা জাতি, কৃষক, সর্বহারা প্রভৃতির অংশ হিসাবে এই সমস্ত লড়াইয়ে কম বেশি মাত্রায় অংশীদার। কিন্তু এসব সত্ত্বেও নারীমুক্তি সংগ্রামের নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, স্বকীয়তা আছে।

নারী মুক্তির কথা যখন উঠছে তখন স্পষ্টতই স্বীকার করে নেওয়া হচ্ছে যে নারী পরাধীন, সে হল অন্যের গোলাম। বর্তমান সামাজিক ব্যবস্থা পুরুষ দ্বারা, পুরুষের জন্য নির্মিত। পুরুষ কর্তৃক চাপিয়ে দেওয়া গোলামীর মুখ্য রূপ হল মহিলাদের ঘরের মধ্যে আটকে রাখা ও সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা। সর্বহারা, কৃষক ও জাতি যেখানে বিরোধী শক্তিকে ধ্বংস করেই নিজের মুক্তি অর্জন করতে পারেন, নারীমুক্তি সেখানে পুরুষদের বিনাশ নয় বরং নারী-পুরুষের সমানাধিকারের মানবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই অর্জিত হতে পারে।

অতীতে একসময় মহিলাদের গৃহস্থালীর কাজকে গুরুত্ব দেওয়া হত, তখন সমাজব্যবস্থা মাতৃতান্ত্রিক সমাজ হিসাবে পরিচিত ছিল। ঐ সমাজে শ্রেণী বিভাজন ছিল না। ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না। ক্রমে ক্রমে চাষবাসের কাজে লোহার যন্ত্রপাতির প্রচলন হল। উদ্বৃত্ত শ্রমকে আত্মসাৎ করতে মানবজাতির এক অংশ অন্য অংশকে দাস অর্থাৎ সর্বহারাতে পরিণত করল। সমাজ শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে গেল, ব্যক্তিগত সম্পত্তির জন্ম হল। এ থেকে পুরুষতান্ত্রিকতারও বিকাশ হল এবং গৃহকর্ত্রীর সামাজিক মর্যাদার অবনতি হতে থাকল। সর্বহারার গোলামী এবং নারীর গোলামী একই সময়ে এবং একই কারণে শুরু হয়েছিল। সেই কারণেই এই দুই অত্যাচারিতের আন্দোলনের মধ্যে বোধহয় এক স্বাভাবিক মিল রয়েছে। তাই দেখা যায় সর্বাহারা পরিবারেই মহিলারা সবচেয়ে বেশি স্বাধীনতা ভোগ করে থাকেন।

নারীকে দাসত্ব স্বীকার করানোর জন্য পুরুষেরা কতরকম ধার্মিক রীতি-রেওয়াজ, সামাজিক সংহিতা তৈরি করেছে। হিন্দু সমাজে তো পতিকেই পরমেশ্বর করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি এই সমাজ পতির মৃত্যুর পর পত্নীকে সতী হওয়ার জন্য বাধ্য পর্যন্ত করেছে। আজ দুনিয়া অনেক পাল্টে গেছে। কারিগরী বিকাশ এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে যে নারী-পুরুষের শারীরিক ক্ষমতার পার্থক্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অর্থহীন হয়ে গেছে। বেশি সংখ্যায় মহিলা ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসেছেন। নারীমুক্তি আন্দোলনেও মহিলারা অনেক সফলতা অর্জন করেছেন। আমাদের দেশেও অনেক আইন তৈরি হয়েছে, সংস্কার হয়েছে যা নারীমুক্তি আন্দোলনে নতুন গতি এনেছে।

সমানাধিকারের জন্য মহিলাদের সংগ্রাম আসলে এমন এক সমাজব্যবস্থার জন্য সংগ্রাম যেখানে সমানাধিকার অর্জনের আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি রয়েছে। একমাত্র সমাজতান্ত্রিক সমাজই সেই সমাজ, যা ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও শ্রেণী বিভাজন ধ্বংস করবে; যেখানে নারীর প্রাথমিক পরিচয় সাংসারিক ভূমিকা নয়, সামাজিক ভূমিকার দ্বারা নির্ধারিত হবে; যেখানে সন্তান উৎপাদনের ওপর নারীর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকবে। তাই কমিউনিস্ট চিন্তাধারার পথ ধরেই নারীমুক্তি আন্দোলন তার অন্তিম লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে। পশ্চিমী নারীবাদী আন্দোলন যখন বুঝতে পারল যে ইউরোপে সমাজবাদের পতন তাদের আন্দোলনকেও দুর্বল করেছে তখন সমাজবাদ ও নারীমুক্তির মধ্যকার অভিন্ন সম্পর্ককে তারা সামনে নিয়ে এল।

কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক তার কর্মসূচিতে আইনের চোখে ও বাস্তব জীবনে পুরুষ ও নারীর মধ্যে সামাজিক সমানাধিকার; পতি-পত্নীর সম্পর্ক ও পারিবারিক আচরণ সম্পর্কিত নিয়মাবলীতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন; মাতৃত্বকে সামাজিক কাজের মর্যাদা; শিশু ও কিশোর-কিশোরীর দেখাশোনা ও শিক্ষার দায়িত্ব সমাজের ওপর অর্পণ এবং নারীকে গোলাম বানিয়ে রাখে এরকম যাবতীয় চিন্তাভাবনা ও প্রথার বিরুদ্ধে লাগাতার সংগ্রাম চালানোর কথা ঘোষণা করেছিল।

নারীমুক্তি আন্দোলনে উপরোক্ত কর্মসূচি আজও আপনাদের সামনে মৌলিক দিশা হিসাবে রয়েছে।

১। মহিলাদের গোলাম বানিয়ে রাখে এরকম চিন্তাভাবনা ও প্রথার বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট নারী সংগঠনকে পত্রিকা ও অন্যান্য প্রচারের মাধ্যমে সর্বপ্রথম জেহাদ ঘোষণা করতে হবে। আজকের ভারতীয় পরিস্থিতিতে এটা আরও জরুরি হয়ে পড়েছে কারণ সমজের সব থেকে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ধর্মের আড়ালে নারীকে ঘরের মধ্যে বন্দী করে রাখতে চাইছে, পুরোনো সামাজিক-পারিবারিক মূল্যবোধকে ফিরিয়ে আনতে চাইছে। পিছন দিকে চলতে গিয়ে এমনকি সতীপ্রথার গুণগানও শুরু করেছে। আপনাদের মনে রাখতে হবে যে, সমস্ত ভগবানই পুরুষের তৈরি যাদের বিশালকায় মূর্তির সামনে নারীকে ভীত ও ধর্মভীরু করে তোলা হয়। এমনকি দেবীদের আবিষ্কারও পুরুষেরাই করেছে। সবথেকে অকর্মণ্য পতিও নারীর কাছে পরমেশ্বর। কিন্তু নারীরূপে সম্মান পেতে হলে একজন মহিলাকে দেবী রূপ নিতে হবে। সমস্ত আচারসংহিতা পুরুষেরাই তৈরি করেছে এবং তাকে দৈবিক রূপ দিয়ে মহিলাদের তা মানতে বাধ্য করেছে।

২। কমিউনিস্ট নারী সংগঠনকে পুরুষ ও নারীর মধ্যে সামাজিক সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে প্রগতিশীল আইন তৈরি করার জন্য যেমন আন্দোলন করতে হবে, তার থেকেও বেশি লড়াই করতে হবে এ ধরনের আইন কার্যকরী করার জন্য।

আইন যত প্রগতিশীলই হোক না কেন, আমলাতান্ত্রিকতা ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলির সামন্ততান্ত্রিক চরিত্রের জন্য তা নিজে থেকেই কার্যকরী হয়ে যাবে না। আমলাতান্ত্রিকতা ও সামন্ততান্ত্রিক চরিত্রের এই সমস্যা এমনকি বিচার বিভাগের ক্ষেত্রেও দেখা যায়।

৩। ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে থাকার বিরুদ্ধে সংগ্রামে মহিলাদের প্রেরণা যোগাবে কমিউনিস্ট নারী সংগঠন। নিজ নিজ ক্ষেত্রে নারী নির্যাতনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলির বিরুদ্ধে তাকে মহিলাদের সংগঠিত করতে হবে। গণআন্দোলন দমনের জন্য স্বৈরতান্ত্রিক শক্তি বিশেষ করে মহিলাদের ওপর অত্যাচার নামাবে। ফলে ধাপে ধাপে মহিলাদের চেতনা ও লড়াকু মানসিকতার বিকাশ হবে এবং নারী আন্দোলন তখন রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে পরিচালিত হবে।

৪। কমিউনিস্ট নারী সংগঠনকে শ্রমিক-কৃষকের গণআন্দোলনে এবং রাজনৈতিক আন্দোলনে মহিলাদের বেশি বেশি অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। বড় সংখ্যায় মহিলাদের অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো আন্দোলন প্রকৃত গণআন্দোলন হয়ে উঠতে পারে না। এই অংশগ্রহণ নারীমুক্তি আন্দোলনে বাধা দেয় না বরং মহিলাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের জন্ম দেয়, নিজেদের শক্তি সম্পর্কে আস্থা বাড়িয়ে তোলে, পুরুষদের সাথে সহজ স্বাভাবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার দিকে নিয়ে যায়। নিজেদের পারিবারিক সম্পর্কে অজান্তেই এক পরিবর্তন নিয়ে আসে এবং এইভাবে নারীমুক্তি আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।

৫। মহিলাদের ছোটো-বড় সমস্ত ধরনের প্রতিবাদ, তা সে যে কোনো সংগঠনের পতাকাতলেই সংগঠিত হোক না কেন, কমিউনিস্ট নারী সংগঠন অবশ্যই সমর্থন করবে। আমাদের দেশে বুর্জোয়া নারীবাদী আন্দোলনেরও বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। কেননা সামন্ততান্ত্রিক শৃঙ্খলের বিরুদ্ধে তাদের লড়তে হয় এবং এখানে বামপন্থী সংগঠনগুলি তাদের স্বাভাবিক মিত্র হয়ে উঠতে পারে। সামন্ততান্ত্রিক-সাম্প্রদায়িক আক্রমণের মুখে এই ধরনের আন্দোলনের সঙ্গে বামপন্থী নারী সংগঠনের মোর্চা তৈরি করা অবশ্যই সম্ভব এবং একান্ত জরুরি।

৬। কমিউনিস্ট নারী সংগঠন পতি-পত্নী সম্পর্ক ও পারিবারিক নিয়মের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জন্য আওয়াজও তুলবে। রুশ বিপ্লবের পর ১৯২৪ সালে কমিন্টার্ন নিজের ঘোষণায় বলেছিল – “যতক্ষণ পর্যন্ত পরিবার ও পারিবারিক সম্পর্কের বিধানে পরিবর্তন না হবে ততদিন বিপ্লব হয়ে থাকবে ক্লীব ও শক্তিহীন।” মুসলিম মহিলারা আজ পর্দার বাইরে এসে তালাকের প্রচলিত পদ্ধতি পরিবর্তনের দাবিতে সোচ্চার হচ্ছেন। আপনাদের অবশ্যই ওঁদের সমর্থন করা উচিত। বিহারে গণতান্ত্রিক বিবাহের কথা আমার কানে এসেছে, যেখানে পুরোহিত থাকছে না, জাঁকজমক থাকছে না, খুব সাদাসিধেভাবে বিয়ে হচ্ছে। এটা নিশ্চয়ই ভালো কথা। কিন্তু গণতান্ত্রিক বিবাহের অর্থ হল মহিলারা তাদের জীবনসাথী বেছে নিতে পারবেন এবং বিয়ের পরে পারিবারিক দায়িত্বে তাঁরা হবেন অংশীদার। কিন্তু এই ধরনের গণতান্ত্রিক বিবাহে তো দূরের কথা পার্টির মধ্যে তথাকথিত বিপ্লবী বিবাহের অধিকাংশতেও এই সমস্ত নীতিগুলি খুব কমই কার্যকরী হতে দেখা যায়।

৭। আজ পর্যন্ত মহিলাদের প্রগতির জন্য, বিভিন্ন সংস্কারের জন্য, মহিলাদের আন্দোলনের তুলনায় প্রগতিশীল পুরুষদের ভূমিকাই বেশি থেকেছে। কমিউনিস্ট নারী সংগঠনের বিশেষ দায়িত্ব হল এ বিষয়ে নারীদের ভূমিকা বাড়িয়ে তোলা, কারণ নারীর মুক্তি তাঁদের নিজেদেরই অর্জন করতে হবে। এমনকি আমাদের পার্টিতেও মহিলা ক্যাডারের মর্যাদাহানির ঘটনা ঘটে থাকে। কিছু কিছু পুরুষ ক্যাডার দ্বারা সাধারণ মহিলাদের প্রতি অন্যায় আচরণের অনেক রিপোর্ট আসে। পার্টি সংস্থাগুলি এসব বিষয়ে পদক্ষেপও নিয়ে থাকে। তবুও আমার মনে হয় কমিউনিস্ট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে এই ধরনের বিষয়ে পার্টির ওপর নজর রাখা ও চাপ সৃষ্টি করার ভূমিকা পালন করতে হবে।

নারী-পুরুষের মধ্যে প্রাকৃতিক পার্থক্য ছাড়া অন্য সব পার্থক্যই কৃত্রিম। ঐতিহাসিক বিকাশের একটি পর্যায় এই কৃত্রিম পার্থক্যগুলিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে, ঐতিহাসিক বিকাশের অন্য এক পর্যায় এই সমস্ত পার্থক্যগুলি শেষ করে দেবে। এই পর্যায়টি আসলে শুরুই হয়ে গেছে। মানব জাতির দুই রূপের মধ্যকার সম্পর্ক যখন সহজ, স্বাভাবিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে তখনই মানবজাতি তার হারিয়ে ফেলা অখণ্ড সত্তাকে আবার ফিরে পাবে। এই লক্ষ্যের দিকে যাত্রাপথ এমন এক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যাবে যার পতাকায় লেখা থাকবে ‘সমাজতন্ত্র ও নারীমুক্তি’।