(ইনকিলাবী মুসলিম কনফারেন্স আয়োজিত “ভারতীয় মুসলিমরা কোন পথে” শীর্ষক জাতীয় কনভেনশনে উদ্বোধনী ভাষণ। লিবারেশন, ডিসেম্বর ১৯৯৩ থেকে)
সভাপতিমণ্ডলী ও বন্ধুগণ,
ইতিহাসে অহরহ ছোটো বড় অনেক ঘটনা ঘটে চলে। কিন্তু সমাজের ওপর কিছু কিছু ঘটনার দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব থাকে, কেননা এগুলি বহু সক্রিয় প্রক্রিয়াকে আমাদের সামনে উন্মোচিত করে। প্রায় একবছর আগে বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে দেওয়া ছিল এমনই এক ঘটনা। এটা বলা হয় যে, মসজিদ ভেঙ্গে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে বিজেপি বিচার ব্যবস্থা, সংসদ, প্রশাসন – এক কথায় রাষ্ট্রের সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলিকেই অগ্রাহ্য করেছে। হ্যাঁ, এটি সত্য কথা। কিন্তু যে সত্য আরও বেশি জাজ্জ্বল্যমান ও আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হল আগ্রাসী হিন্দুত্বের সামনে রাষ্ট্রের সমস্ত প্রতিষ্ঠাগুলির মিলিত শক্তি পঙ্গু হয়ে পড়ল। প্রধানমন্ত্রী যে নিষ্ক্রিয়তা ও দ্বিধা দেখিয়েছেন তা – প্রায়শই যেমন বোঝানো হয়ে থাকে – নিছক একজন ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য ছিল না, বরং তা ছিল রাষ্ট্রের পঙ্গুত্বেরই এক প্রতীক, এক প্রতিচ্ছবি।
দেশ বিভাগের নির্মম ধাক্কা কাটিয়ে উঠে ভারতীয় মুসলিমরা ভারতীয় সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ধীরে ধীরে নিজেদের মানিয়ে নিচ্ছিলেন। পরপর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, এমনকি বড় আকারের দাঙ্গা সত্ত্বেও তাঁরা ভারতীয় রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের ওপর আস্থা রাখতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার ঘটনা তাদের বিশ্বাসের ভিত্তিমূলকে কাঁপিয়ে দিয়েছে, তাদের সামনে উঠে এসেছে লাখ টাকার প্রশ্ন – ভারতীয় রাষ্ট্র প্রকৃতই কতটুকু ধর্মনিরপেক্ষ? এর সাথে সাথে যে সমস্ত প্রশ্নের সমাধান হয়ে গেছে বলে এতদিন মনে করা হত, সেই সমস্ত প্রশ্নও আবার মুসলিম মনে উঠতে শুরু করেছে।
এটি মাথায় রাখতে হবে যে জিন্নার মুসলিম জাতীয়তাবাদ সাভারকার বা গোলওয়ালকরের হিন্দু জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসাবে গড়ে ওঠেনি, কেননা সেই সময়কালে এই ধরনের হিন্দু জাতীয়তাবাদের শক্তি খুবই দুর্বল ছিল। বরং তা গড়ে ওঠে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে গান্ধীবাদী বীক্ষার বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়া হিসাবেই। গান্ধীর যুগের উদার হিন্দুত্ব ক্রমে ক্রমে নিজেকে উগ্র হিন্দু ধারায় রূপান্তরিত করে। বস্তুতপক্ষে নেহরুর মহিমময় ব্যক্তিত্ব ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বৈশিষ্ট্যময় উদারনীতিবাদী হিন্দু ভাবধারাকে আড়াল করে রাখে এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের কল্পকথাকে স্থায়ী করে। পরবর্তীকালে ইন্দিরা গান্ধীর পৃষ্ঠপোষকতায় উগ্র ভারতীয় জাতীয়তাবাদ নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে যে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও হিন্দু জাতীয়তাবাদের মধ্যকার সীমারেখা প্রকৃত অর্থে খুবই সূক্ষ্ম। মূলত এর উপর ভর করে পরবর্তীকালে খোলাখুলিভাবে হিন্দু জাতীয়তাবাদের ওকালতির পথ প্রশস্ত হয়। এই উর্বর জমিতে বিজেপির বাড়বাড়ন্ত অতএব এক দীর্ঘ প্রক্রিয়ার যৌক্তিক পরিণতি।
কংগ্রেস সরকার রামজন্মভূমির তালা খুলে দিয়ে সাম্প্রদায়িকতার দৈত্যকে বোতল থেকে ছেড়ে দেয়, আর এখন হাজার চেষ্টা করেও সেই দৈত্যকে আর বোতলবন্দী করা যাচ্ছে না। ভারতের নিয়তি আজ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। যেখানে একটি রাস্তা সোজা গেছে ফ্যাসিবাদী হিন্দুরাষ্ট্রের দিকে এবং অপরটি, আঁকাবাঁকা হলেও, এক আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের দিকে। আমাদের অবশ্যই এক আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের দিকে এগোতে হবে এবং আমি মনে করি এই সংগ্রামে ভারতীয় মুসলিমদের অংশগ্রহণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং তা অবশ্যই প্রয়োজনীয়।
এই প্রসঙ্গে আমি একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই। জিন্নার জাতীয়তাবাদ পাকিস্তানে মুসিলম রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে, এবং তার ফলশ্রুতিতে ভারতীয় রাষ্ট্রও গুরুতর বিকৃতিকে এড়িয়ে যেতে পারেনি এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী এটি কখনও উদার আবার কখনও উগ্র হিন্দুত্বের মধ্যে ঘোরাফেরা করেছে। হিন্দুত্বের সর্বাত্মক আক্রমণের মুখে রাষ্ট্রের সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলি যে নিজেদের হাতিয়ারগুলি নামিয়ে রাখল, তার মূল কারণ রয়েছে এখানে। সুতরাং আজকের সংগ্রাম হল ভারতবর্ষে এক প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, এক প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ গড়ে তোলার সংগ্রাম। এই কারণে ভারতীয় রাষ্ট্রের বিকৃতিকে দূর করা দরকার, যে বিকৃতি ভারতীয় জাতীয়তাবাদী রাজনীতির পাক-বিরোধিতাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠার কারণে উদ্ভূত হয়েছে। এই কারণে আমাদের পার্টি ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে সমতার ভিত্তিতে এক কনফেডারেশন গড়ে তোলার কথা বলে। এইভাবে এক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গড়ে তোলার সংগ্রাম এই কনফেডারেশন গড়ে তোলার সংগ্রামও বটে। কেননা সম্ভবত একমাত্র এই কনফেডারেশনই ভারতীয় রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বিকৃতির সঞ্চারকে রুখে দিতে পারে। সামগ্রিক দৃষ্টিতে দেখলে এক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ে তোলার সংগ্রামে এটি এক গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
নীচু স্তরে, মুসলিমদের স্বকীয় পরিচিতি বজায় রাখার প্রশ্নটি ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য সংগ্রামের এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বিজেপির হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণা মুসলিমদের স্বকীয় পরিচিতিকে বশীভূত করার দাবি জানায় এবং হিন্দুদের মধ্যকার একটি সম্প্রদায় হিসাবে মুসলিমদের রূপান্তরিত করতে চায়। নিজেদের স্বকীয় পরিচিতি বজায় রাখার জন্য এক সম্প্রদায় হিসাবে মুসলিমদের প্রতিক্রিয়া জানানো তাই এক স্বাভাবিক ব্যাপার। অভিজ্ঞতা তাদের শিখিয়েছে যে একমাত্র বামপন্থীরাই দৃঢ়তা ও সততার সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে বিপ্লবী বামপন্থীরাই হিন্দুত্বের বাহিনীর সামনে জোরালো প্রতিবাদ খাড়া করেছে। তাই ভারতীয় মুসলিম ও বামপন্থীদের ঐক্যকে শক্তিশালী করা ও এই বিকাশমান সম্পর্ককে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া প্রয়োজন। বামপন্থীদের সম্পর্কে আপনাদের কিছু আশঙ্কা আছে। এই প্রশ্নে মুসলিমদের সম্পর্কে আমাদের অবস্থান স্পষ্ট করতে আমি কয়েকটি বিষয়ে আলোচনা করব।
যখন আপনারা আপনাদের স্বকীয় পরিচিতির প্রতীক হিসাবে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়কে দেখেন এবং এর সংখ্যালঘু মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করার জন্য সমস্ত ধরনের প্রচেষ্টার বিরোধিতা করেন, যখন আপনারা ভারতবর্ষে উর্দু ভাষার উপযুক্ত মর্যাদা দাবি করেন, যখন আপনারা মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের উপর বাইরের কোনো হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানান, আমাদের পার্টি তখন আপনাদের অনুভূতিকে মর্যাদা দেয় এবং দাবিগুলিকে সমর্থন করে। তথাপি আমি বলব মুসলিম যুবকদের এক বড় অংশ আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রেও হিন্দু ছাত্রদের সঙ্গে এক সাথে শিক্ষা লাভ করছেন। বহু মুসলিম ছাত্র হিন্দী ও ইংরাজি ভাষা শিখছেন। বহু মুসলিম যুবক হিন্দী পত্রিকার সাংবাদিক হিসাবে কাজ করছেন। অনেক প্রকাশনা সংস্থা যারা আগে কেবলমাত্র উর্দু পত্রিকা প্রকাশ করত, এখন হিন্দী বা ইংরাজি সংস্করণও প্রকাশ করছে। সমাজের মূল ধারার সঙ্গে মুসলিম যুবকদের এই মেলামেশার বিরোধিতা করেন, এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের ব্যাপারে আমার যতটুকু জানা আছে মুসলিম সমাজের ভেতরেই এ সম্পর্কে, বিশেষ করে মহিলাদের অধিকারের প্রশ্নে বিতর্ক আছে। আমি আশা করি সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এক প্রগতিশীল অভিমুখে এই বিতর্কের মীমাংসা হবে। আমাদের সমাজে এ এক অদ্ভুত বৈপরীত্য যে, যেখানে উগ্র হিন্দুত্ব মাথাচাড়া দেওয়ার ফলে মহিলাদের অবস্থার আরও অবনতি ঘটছে – বধূ হত্যার ঘটনা বেড়ে চলেছে, সতীপ্রথাকে আবার চালু করার চেষ্টা চলছে, সেখানে মুসলিম সমাজে মহিলাদের অধিকার বাড়ানোর প্রশ্নে গভীরভাবে আলোচনা চলছে।
যাকে প্রধান ধারার মুসলিম দেশ হিসাবে ধরা হয় না সেই ইন্দোনেশিয়াকে বাদ দিলে বিশ্বে মুসলিম জনসংখ্যা ভারতেই সবচেয়ে বেশি। যে ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে আপনারা বসবাস করেছেন এবং যে সামাজিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আপনারা আজ চলেছেন, তাতে ভারতীয় মুসলিমদের পক্ষে বিশ্বের সবচেয়ে প্রগতিশীল ও গতিময় মুসলিম হিসাবে এগিয়ে আসা সম্পূর্ণরূপে সম্ভব।
যদিও দেশের জনসংখ্যায় মুসলিমরা হলেন ১২ থেকে ১৫ শতাংশ, তথাপি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ভারত যেভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে, যেভাবে তার সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তাতে আপনাদের অবদান অর্ধেক। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আগামীদিনের আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ ভারত গড়ে তোলার কাজে আপনারা অর্ধেক দায়িত্বও কাঁধে নেবেন।