(৪ আগস্ট ১৯৯৮, পার্টির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্মেলনে উদ্বোধনী ভাষণ)

এই শহর ও মহকুমার সাথে আমাদের পার্টির, আমাদের আন্দোলনের বহু স্মৃতি জড়িয়ে আছে। এটা আমাদের শ্রদ্ধেয় নেতা কমরেড চারু মজুমদারের কর্মভূমি। নকশালবাড়ির মহান আন্দোলনের এখান থেকেই সূত্রপাত, তাতে বহু কমরেড রক্ত ঝরিয়েছেন এই অঞ্চলগুলিতে। তবে আমরা শুধু অতীতের স্মৃতিচারণা করতে এখানে আসিনি। ভবিষ্যতের কর্মপন্থা নির্ধারণ করার জন্য, আরও একবার সিপিআই(এমএল)-কে, বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলনকে, পশ্চিমবাংলার মাটিতে শক্তিশালী করে তোলার জন্য এই শিলিগুড়ি শহরে আপনারা মিলিত হয়েছেন।

সাম্প্রতিককালে দেশের বহু কিছুই পাল্টে গেছে। বিজেপি বহু বছর অপেক্ষার পর কেন্দ্রের ক্ষমতা দখল করেছে। বিজেপির বিরুদ্ধে বামপন্থী প্রতিরোধ কীভাবে শক্তিশালী করা যায়, আমরা সেই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ৪ আগস্ট পার্শ্ববর্তী রাজ্য বিহারে সিপিআই(এমএল)-এর নেতৃত্বে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে পুরো বিহার জুড়ে বন্ধ ডাকা হয়েছে এবং সমস্ত বামপন্থী পার্টি, বিহারের সিপিআই(এম) থেকে শুরু করে আরএসপি, ফরওয়ার্ড ব্লক সবাই মিলে এই বন্ধে সমর্থন জানাচ্ছে। বামপন্থী সংগ্রামী ঐক্য গড়ে তোলার আমাদের এক প্রচেষ্টা চলছে এবং বিশেষ করে ভারতবর্ষের হিন্দি কেন্দ্রস্থলগুলিতে, যেখানে বিজেপি বা সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলির স্তম্ভ ও ঘাঁটি এলাকা, সেখানে আমরা উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে একটা শক্তিশালী বাম ঐক্য গড়ে তুলে তাকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছি। চিন্তাধারার জগতে হোক, অনুশীলনের জগতে হোক, সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলির এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা বামপন্থী শক্তিকে করতে হবে, বামপন্থী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে, বামপন্থার ঐক্য গড়ে তুলতে হবে এবং সেই ক্ষেত্রে সিপিআই(এমএল)-কে নেতৃত্বকারী ভূমিকা নিতে হবে। এই কর্তব্য জাতীয় রাজনৈতিক কর্তব্য হিসাবে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে।

পশ্চিমবাংলাতেও পরিস্থিতি অবশ্যই জটিল, এখানে এই কর্তব্যকে কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় এই প্রশ্নটাও আমাদের কাছে বিচার্য বিষয়। পশ্চিমবাংলায় ২১ বছর ধরে একটা বাম সরকার চলছে। আর কোনো বিষয়ে ভারত বিশ্ব রেকর্ড করতে পারেনি, অলিম্পিকে আমরা কোনো গোল্ড মেডেল পাই না, কোনো বিশেষ রেকর্ড করতে পারিনি। কিন্তু বলা হয় যে, সংসদীয় পথে একটা কমিউনিস্ট সরকার, একটা বাম সরকার চালানোর বিশ্বরেকর্ড অবশ্যই ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এটা কতটা গর্বের বিষয়, সেটা নিশ্চয়ই ভেবে দেখার আছে। কিন্তু যাই হোক, এটা তো ঘটনাই এ ব্যাপারে সিপিআই(এম) একটা বিশ্বরেকর্ড করেছে। কারণ এর আগে এরকম ঘটতে দেখা যায়নি। চিলি হোক, অন্যান্য দেশে হোক, ইন্দোনেশিয়ায় হোক, আমরা দেখেছি কমিউনিস্টদের এরকম যে কোনো প্রচেষ্টার রক্তাক্ত পরিণতি হয়েছে। কিন্তু এখানে ২১ বছর ধরে শান্তিপূর্ণভাবে বেশ দিব্যি একটা বাম পার্টি, একটা বাম সংগঠন ক্ষমতা চালিয়ে যাচ্ছে। হয়তো ভারতবর্ষের শাসকশ্রেণী অনেক উদার হয়েছে, অনেক নরমপন্থী হয়ে গেছে। কিংবা হয়তো যে কমিউনিস্টরা শাসনে আছেন তারা কোথাও না কোথাও কমিউনিস্ট মৌলিক চরিত্র পরিত্যাগ করেছেন, কোথাও না কোথাও তারা স্যোশাল ডেমোক্রাসি রাজনীতির শিকার হয়েছেন, এই প্রশ্ন অবশ্যই বিচারের আছে। সিপিআই(এম) যখন ক্ষমতায় আসীন হয় তার আগে ওঁদের নিজেদের ভাষায়, পশ্চিমবাংলার বুকে কংগ্রেসের আধা ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস চলেছিল এবং তাতে বহু বামপন্থী কর্মীকে হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু এই সরকার ক্ষমতায় এলো, ২১ বছর ক্ষমতায় থাকল, সেই আধা ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসের জন্য দায়ী একজন পুলিশ অফিসারেরও শাস্তি হল না, একজনও কংগ্রেসী গুণ্ডা গ্রেপ্তারই হল না। কমরেড চারু মজুমদার, কমরেড সরোজ দত্ত যাঁদের রহস্যজনকভাবে হত্যা করা হল, তা নিয়ে আমাদের পার্টি এবং পশ্চিমবাংলার বিশিষ্ট বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরা ও জনগণ বারবার দাবি জানানো সত্ত্বেও তারা কিন্তু তদন্ত বসালেন না। এমনকি পুলিশ রেকর্ডে কমরেড সরোজ দত্ত এখনও পর্যন্ত ফেরার, এই পশ্চিমবাংলায় তার হত্যার কথা স্বীকারই করে না। সিপিআই(এম) নেতৃত্ব এ সমস্ত তথ্য জানে এবং নির্বাচনে এগুলিকে কাজে লাগায়। কিন্তু তারা আজ পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। কোনো তদন্ত তারা করেনি। কাজেই প্রশ্নটা ওঠে। তাদের মুখে সীমিত ক্ষমতার কথা শুনেছিলাম, কিন্তু ক্ষমতা যে এতটাই সীমিত এটা আমাদের জানা ছিল না। তাই প্রশ্ন ওঠে, আপনাদের ক্ষমতার এই সীমা সংবিধান ঠিক করে দিয়েছে নাকি সেই সীমা আপনারা নিজেদের জন্য ঠিক করে নিয়েছেন।

পশ্চিমবাংলায় ২১ বছরের শাসনে এক সর্বাত্মক অধঃপতন ঘটেছে। সেটা ওদের নেতারাই মাঝে মাঝে স্বীকার করেন। এবং এই নিয়ে ওদের মধ্যে কিছু বিবাদও আছে। এর আগেও সিপিআই(এম)-এর ভেতরে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন এবং কিছু বিক্ষুব্ধ সিপিআই(এম) গোষ্ঠী আমরা গত ১০ বছরে বারবার গড়ে উঠতে দেখেছি। কিন্তু ঐ বিক্ষুব্ধ গ্রুপগুলির ভবিষ্যৎ আমরা ভালো দেখিনি, তাদের বেশিরভাগই হয় নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে, নয়তো কংগ্রেসের সাথে হাত মিলিয়েছে। তবে এমনও খবর আছে, পশ্চিমবাংলায় বা গোটা ভারতবর্ষে সিপিআই(এম)-এর মধ্যে একটা অংশ আছে, তাতে কিছু নেতারাও আছেন, যাঁরা পার্টির এই সর্বাত্মক অধঃপতন নিয়ে চিন্তিত এবং পার্টির মধ্যে থেকে তাঁরা এই অধঃপতনের বিরুদ্ধে আন্তঃপার্টি সংগ্রাম চালাচ্ছেন বলে তাঁরা মনে করেন এবং তাঁরা আশা করেন আন্তঃপার্টি লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে সিপিআই(এম)-এর যে সমাজগণতান্ত্রিক অধঃপতন হচ্ছে তার থেকে তাকে বিপ্লবী দিশায় ফিরিয়ে আনতে পারবেন। যদিও আমাদের এই আশা নেই।

পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই(এমএল)-এর অন্যান্য কিছু গ্রুপ আছে। এখানে অসীম চ্যাটার্জী এখন সিপিআই(এম)-এর চেয়েও বড় সিপিআই(এম)। তিনি বলছেন কংগ্রেসের সাথে হাত মেলাতে হবে, মোর্চা বানাতে হবে। এখানে কানুবাবু আছেন, নকশালবাড়ির সম্মানীয় নেতা, নকশালবাড়ির প্রতীক হিসাবে জাতীয় ক্ষেত্রে তাঁর মর্যাদা আছে। আমাদের পার্টি তাঁকে বলেছিল, আপনি এক বিশিষ্ট ব্যক্তি, আমাদের আন্দোলনের সাথে আপনি একটা প্রতীক হিসাবে আছেন, আপনার পক্ষে কোনো সংকীর্ণতাবাদী রাজনীতি অথবা স্থানীয় দু-চারটে গ্রাম নিয়ে রাজনীতি করাও শোভা পায় না। তখন ইন্ডিয়ান পিপলস ফ্রন্ট ছিল, আমরা আহ্বান করেছিলাম, আপনি আসুন এবং জাতীয় স্তরে একজন জাতীয় নেতা হিসাবে সারা দেশে এই আন্দোলনের বীজ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য আপনার ব্যক্তিত্ব, আপনার প্রভাবকে কাজে লাগান। আপনাকে আমরা জাতীয় মঞ্চ তৈরি করে দেব। কিন্তু জানি না কেন তিনি তা স্বীকার করেননি। বরং উল্টে নিজের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে, কমরেড চারু মজুমদারের বিরুদ্ধে, নকশালবাড়ির আন্দোলনের বিরুদ্ধে এবং অতীতের সেই যা কিছু গৌরবময়, যার জন্যই কানু সান্যালকে কানু সান্যাল হিসাবে সারা দেশ জানত, তিনি সেই সব কিছুরই বিরোধিতা করতে শুরু করলেন। এবং আপনারা জানেন তিনি আজ কী অবস্থায় আছেন।

সুতরাং আমরা দেখছি, এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ এসে উপস্থিত হয়েছে বামপন্থী আন্দোলনে, কমিউনিস্ট আন্দোলনে। সমাজগণতান্ত্রিক পার্টিগুলো নিজেদের অভ্যন্তরীণ সংকটের শিকার, নৈরাজ্যবাদী শক্তিগুলো দক্ষিণপন্থার সাথে হাত মেলাচ্ছে, এমন এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে আমাদের উপর এক বিশেষ দায়িত্ব হল সিপিআই(এমএল)-এর আন্দোলনকে সারা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া এবং সেই সাথে পশ্চিমবাংলার বুকে তার পুনর্জাগরণ ঘটানো। তবে সেটার জন্য বহু কঠোর-কঠিন প্রচেষ্টা দরকার। যে সক্রিয়তা দিয়ে আজ আপনারা কাজ করছেন আমি মনে করি তার দশগুণ বেশি সক্রিয়তার প্রয়োজন আছে। বিশেষ করে প্রয়োজন ছাত্র-যুবদের যে শক্তি কিছু ফ্যাসিবাদী শক্তির পেছনে, ‘লাল হঠাও’ শ্লোগানের পেছনে ছুটছে, সেখান থেকে তাদের ফিরিয়ে আনা। কারণ তারাই দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। আমার মনে হয়, কৃষক ফ্রন্টে কাজ করার পরে আপনাদের অন্যতম দায়িত্ব ছাত্র-যুবদের মধ্যে নতুন করে বিপ্লবী রাজনীতিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। আর এই সফলতা আমরা পাব না যদি নতুন করে আত্মবলিদান ও আত্মত্যাগ করতে না পারি। বীরত্বের যে ঐতিহ্য আমাদের রয়েছে সেই ইতিহাসকে সামনে রেখে আমাদের ভবিষ্যতের রাস্তা ঠিক করতে হবে। আমার এটা দৃঢ় বিশ্বাস, সমাজগণতন্ত্রীদের সংকটের জন্য পশ্চিমবাংলায় আমাদের এগিয়ে যাওয়ার এবং নতুন এক জনজোয়ারের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি এই সম্মেলন থেকে আপনারা সেই দিশা ও আস্থা নিয়ে যাবেন এবং নতুন করে সমস্ত শক্তিকে কেন্দ্রীভূত করবেন এক নতুন বিপ্লবী জোয়ার সৃষ্টি করার জন্য।

ইনক্লাব জিন্দাবাদ!