(দেশব্রতী, বিশেষ সংখ্যা, অক্টোবর ১৯৯৪ থেকে)

১৯৭২-এর ২০ মে-র সকালে আমাদের সামনে যখন বহরমপুর সেন্ট্রাল জেলের সদর দরজা খুলে গেল তখনও বিশ্বাস হয়নি যে সত্যিই আমরা ছাড়া পাচ্ছি। পিডি এ্যাক্টে বিনা বিচারে এক বৎসর আটক রাখার মেয়াদ সেদিনই শেষ হচ্ছিল বটে তবে পশ্চিমবাংলায় তখন চলছে জঙ্গলের রাজত্ব। জেল গেট থেকে ধরে পুনরায় জেলে ঢুকিয়ে দেওয়ার ঘটনা অহরহ ঘটছে। গেটের সামনে দাঁড়ানো কালো ভ্যান দেখে সেই আশঙ্কাই ঘনীভূত হল। গেট থেকে বেরিয়ে পাঁচিলের গা ঘেঁষে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। পেছনে ফিরে তাকালাম – ওরা আসছে না। আমরা হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলাম।

এই বিরাট উঁচু পাঁচিলকে ওপার থেকে ডিঙ্গোনোর পরিকল্পনা করতে গিয়ে কয়েক মাস আগেই কত তাজা প্রাণ রক্ত ঝরিয়েছে এবং আমরা গোটা সময়টাই ফাঁসির আসামীদের জন্য নির্ধারিত ২৫ নম্বর সেলে ২৪ ঘণ্টা আটক থেকেছি।

জেলে ছেড়ে আসা সাথীদের জন্য মন খারাপ হয়ে গেল। সেলে আটক অবস্থাতে যদিও একে অপরের মুখ দেখতে পেতাম না, কিন্তু জোরে স্লোগান, গান ও রাজনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে এবং সর্বোপরি রাত্রে চা-গাড়ির মাধ্যমে – দড়ি দিয়ে বাঁধা বাটিতে চায়ের গ্লাস এক সেল থেকে অপর সেলে পাঠিয়ে – আমরা জীবন্ত সম্পর্কে আবদ্ধ থাকতাম। সে যুগে এ গ্রুপ সে গ্রুপ ছিল না, আমরা সকলেই ছিলাম একই পার্টির কমরেড, নকশালপন্থী বন্দী।

স্বাধীনোত্তর ভারবর্ষের জেলে এমন রাজনৈতিক বন্দীরা বোধ হয় প্রথম এবং অদ্বিতীয়। পশ্চিমবাংলার জেলে হাজারে হাজারে তাঁরা বন্দী থেকেছেন, চরম নির্যাতন সহ্য করেছেন, জেলকে পরিণত করেছেন বিদ্রোহের কেন্দ্রে এবং একের পর এক জেল ভাঙ্গার অভিনব নজির প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁদের বীরত্ব ও আত্মদানের গাথা নিয়ে ভবিষ্যতের কবি এক মহাকাব্যই লিখতে পারেন।

কয়েক ঘণ্টা বহরমপুরে কাটিয়ে আমরা সেই রাত্রেই পাড়ি দিলাম দুর্গাপুরের দিকে। এখানে আমরা বলতে আমি আর কালী। কালীকে এই নামেই আমি জানতাম এবং এই নামেই ও পুরো জেল জীবনটা কাটিয়ে দিল। শত চেষ্টা করেও পুলিশ ওর আসল নাম, ঠিকানা উদ্ধার করতে পারেনি। কালীর সাথে আমার পরিচয় ১৯৭০-এর ডিসেম্বরে – যে দিন আমরা ধরা পড়লাম। ও বর্ধমান জেলার গ্রামাঞ্চলে কাজ করত এবং আমার মতো ওকেও জেলা কমিটিতে নেওয়া হয়েছিল এবং সে দিনই জেলা কমিটির প্রথম বৈঠক হতে যাচ্ছিল। অন্য যাঁরা আমাদের সঙ্গে ধরা পড়েছিলেন তাঁরা এদিক ওদিক ছড়িয়ে গিয়েছিলেন। আমি আর কালী পুলিশের মারে ভাঙ্গা হাত-পা নিয়ে আসানসোলের হাসপাতালে পাশাপাশি বিছানায় শুয়ে থেকেছি, একই হাতকড়ায় আটক অবস্থায় দুর্গাপুরের কোর্টে যাওয়া-আসা করেছি, স্লোগান দিয়েছি, পাশাপাশি সেলেই জেল জীবনটা কাটিয়েছি এবং আজ একই সঙ্গে ছাড়া পেয়ে একই লক্ষ্যের অভিমুখে যাত্রা করছি।

বাইরের পরিস্থিতি ততদিনে অনেক পাল্টে গেছে। সেই ছাত্র আন্দোলনের জোয়ারের উদ্দীপনা জাগানো দিনগুলি যেন হঠাৎই মিলিয়ে গেছে, ‘গেরিলাযুদ্ধের বিস্তৃতি’র ও ‘শ্রেণীশত্রু খতম অভিযানের’ খবরও বিশেষ আর শোনা যায় না। নেতারা একের পর এক ধরা পড়ছেন, শহীদ হচ্ছেন। পার্টিতে বেড়ে চলেছে বিভ্রান্তি ও হতাশার পরিবেশ, দলত্যাগ ও বিশ্বাসঘাতকতা।

দুর্গাপুরে আমার পরিচিত পুরোনো শ্রমিক কমরেড ও তাঁদের পরিবারগুলির কাছ থেকে পেলাম সেই একই আন্তরিক ভালোবাসা। তবে আমার সহকর্মীরা, যাঁরা তখন বর্ধমান আঞ্চলিক কমিটির নেতা হয়েছেন, তাঁরা কেউই দেখা করতেও এলেন না। বর্ধমান আঞ্চলিক কমিটির সীমানা ছিল বিহারের ধানবাদ জেলা পর্যন্ত বিস্তৃত এবং সেই ধাক্কার পর্যায়েও প্রায় শ’খানেক সর্বক্ষণের কর্মী সেখানে কর্মরত ছিলেন।

ইতিমধ্যে একদিন বজ্রাঘাতের মতো কমরেড চারু মজুমদারের গ্রেপ্তার হওয়া ও মৃত্যুর সংবাদ এল। আমরা স্তব্ধ হয়ে গেলাম।

কালী গেল বাঁকুড়ার দিকে কাজ করতে এবং আমি আঞ্চলিক কমিটির নির্দেশে একটা টিনের বাক্সে আমার টুকিটাকি জিনিস গুছিয়ে রওয়ানা হলাম নবদ্বীপের দিকে, আর সেখান থেকে অগ্রদ্বীপের একটি গ্রামে। আমার বিপ্লবী জীবনের নব পর্যায় এখান থেকেই শুরু হল।

আমাদের এলাকার ভারপ্রাপ্ত আঞ্চলিক কমিটির সদস্য ছিলেন অশোক মল্লিক, বর্তমানে ইনি সিওআই(এমএল) করেন। খোকা নামেই তার খ্যাতি। নবদ্বীপ শহরে মধ্যবিত্ত সমর্থকদের একটি বৈঠকে তিনি আসছেন শুনে দেখা করতে গেলাম। তিনি ব্যস্ত তাই দেখা করতে পারবেন না বলে বাড়ির দরজা থেকেই ফিরে আসতে হল। অবশ্য কয়েকদিন পরে ভদ্রলোক দেখা করলেন, অনেক উপদেশও দিলেন।

বীরভূমের পাশাপাশি বর্ধমান জেলার ভাতার অঞ্চলে ১৯৭১ সালে কৃষক সংগ্রাম একটি স্তর পর্যন্ত এগিয়েছিল। তারপর ধাক্কার মুখে পুলিশের তাড়া খেয়ে কয়েকজন কমরেড এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়েছিলেন। তারই একজন কার্তিক, পূর্বস্থলী এলাকায় নতুন করে সংগঠন গড়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এখানেই তার সাথে পরিচয়, যা অচিরেই ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বে পরিণত হল।

ভাতার থেকে কালনা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আমরা ভাঙ্গাচোরা সংগঠনকে জোড়া লাগানো ও কৃষক আন্দোলনকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা শুরু করলাম। দুর্গাপুর থেকে পরেশ, তাপস এসে যোগ দিল, বিকাশ তো ছিলই। কয়েকটি গ্রামে কিছু নতুন উদ্যোগ গড়ে উঠলেও চরম কংগ্রেসী সন্ত্রাসের জমানায় বিশেষ সাফল্য আমাদের হাতে আসেনি। তবে গোটা জেলায় আমাদের এলাকাতেই বোধ হয় নব উদ্যমে এক কঠোর প্রচেষ্টা চলেছিল।

আঞ্চলিক কমিটির নেতৃত্ব বিমূর্ত সব তাত্ত্বিক কচকচানিতে লিপ্ত ছিলেন। একটা অদ্ভুত বিতর্ক ছিল – সি এম (চারু মজুমদার)-কে শুধু শ্রদ্ধেয় নেতা বলা উচিত নাকি শ্রদ্ধেয় ও প্রিয় নেতা কমরেড চারু মজুমদার বলা উচিত। এ নিয়ে নাকি আঞ্চলিক কমিটিতে দু’লাইন ছিল। এসবের মাথামুণ্ডু আমি বুঝতাম না এবং একটি মিটিং-এ শুধু সি এম বলার অপরাধে খোকাবাবু আমার ওপর ভীষণ ক্ষেপে গেলেন। কমিটি সম্পাদক দীর্ঘক্ষণ বোঝালেন কেন শ্রদ্ধেয় ও প্রিয় নেতা কমরেড চারু মজুমদার বলা উচিত। বুঝতে আমি পারিনি এবং ঈশ্বরদ্রোহিতার অপরাধে মহাপাতক হয়ে থাকলাম। যা বুঝলাম তা হল সংগঠন-আন্দোলনকে পুনর্গঠনের কঠিন কঠোর প্রচেষ্টা থেকে সরে থাকার যুক্তি হিসাবেই ওরা এসব বাম বুলিসর্বস্বতার আশ্রয় নিয়েছে। বুঝলাম ‘আজকের পর্যায়ে দুই লাইনের সংগ্রামই শ্রেণী সংগ্রাম’ জাতীয় তাঁদের সূত্রায়নের আসল মর্মবস্তু।

ক্রমেই আঞ্চলিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কর্মীবাহিনীর বিক্ষোভ ধূমায়িত হতে থাকে এবং অপরদিকে আমাদের আন্তরিক প্রচেষ্টা সকলেরই নজর কাড়ে। এমন সময়েই কলকাতার দু’জন নেতৃস্থানীয় কমরেড অগ্নি ও কমলের পার্টির ভেতর থেকেই হত্যার চক্রান্তে সামিল থাকার সন্দেহে আঞ্চলিক কমিটির দুজন সদস্য – গৌতম সেন ও কৌশিক ব্যানার্জীকে কমিটি থেকে বহিষ্কার করা হয়। ওঁরা এই সিদ্ধান্ত মানতে পারেননি এবং ‘সত্য প্রায়শই অল্প লোকের মধ্যে নিহিত থাকে’ মাও-এ এই উক্তির দোহাই দিয়ে এক সমান্তরাল কেন্দ্র গঠন করেন। এই প্রথম গৌতম – যে আমার সহপাঠী ছিল – আমার সাথে দেখা করতে আসে। নিজের প্রতি সমর্থন জোগাড়ের প্রত্যাশায় অবশ্য। আমি বলি ঘটনা সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না তবে তোমাদের উচিত কমিটির সিদ্ধান্ত মেনেই নিজেদের বক্তব্য রাখা। এভাবে বিদ্রোহ করা পার্টির সাংগঠনিক নিয়মনীতির পরিপন্থী। ও আমাকে বোঝায় ‘সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরুর অধীনে’ এসব রীতিনীতি সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পরে অচল। সাংস্কৃতিক বিপ্লব প্রতিষ্ঠা করেছে ‘সত্য প্রায়শই অল্প লোকের মধ্যে নিহিত থাকে’ এবং ‘বিদ্রোহ করা ন্যায়সঙ্গত’। আমি বলি যে রেড বুক হাতে নিয়ে সাংস্কৃতিক বিপ্লব হল তাতে মাও-এর এইসব রীতিনীতির উল্লেখ আছে এবং সবচেয়ে বড় কথা এসব নিয়মনীতি বাদ দিলে কোনো সংগঠন চলবে কী করে। গৌতমকে বলি তুমি নিজে যে সংগঠন গড়ছ তাতেও আজ হোক কাল হোক মতপার্থক্য দেখা দেবে এবং সেখানে লোকে একই যুক্তিতে বিদ্রোহ করলে তুমি ঠেকাবে কী দিয়ে। ওর কাছে আমার কথাগুলি পুরাতনপন্থীদের মতোই শোনাল। আমি দুঃখ পেলাম, কিন্তু গৌতম অনেক যোগ্যতা-দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও কোনো সংগঠনই কোনোদিন গড়ে তুলতে পারল না।

দেখা করতে এলেন কৌশিকবাবুও। বললেন আঞ্চলিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে আপনাদেরও তো অনেক বিক্ষোভ। তাছাড়া আপনি নিজে তো ব্যক্তিগতভাবে উপেক্ষিত হয়েছেন, অপমানিত হয়েছেন। আপনি বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিন, গোটা কর্মীবাহিনী আপনার পাশে দাঁড়াবে, আমরাও আপনার সাথে আছি। বললাম ক্ষমা করবেন, আপনাদের মতো বিদ্রোহী আমি নই। পার্টি শিক্ষা এতদিন যা পেয়েছি তাতে সংগঠনের অভ্যন্তরেই নীতিনিষ্ঠ সংগ্রাম চালানোতেই আমার বিশ্বাস।

এই ঘটনার উল্লেখ করলাম কারণ মনে হয় সাংস্কৃতিক বিপ্লবের নাম করে এ জাতীয় বহু ধ্যানধারণা আমাদের পার্টিতেও ছড়িয়ে পড়েছিল এবং তা পার্টি ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে তছনছ করে দিয়েছিল। পরবর্তীকালে অজস্র গ্রুপের অস্তিত্ব ও ছোটোখাটো মতপার্থক্য ও একের পর এক বিভাজনের পেছনেও এসব ধারণার অনেক অবদান আছে বলে মনে হয়।

এদিকে সি এম-এর মৃত্যুর পর শর্ম-মহাদেবের কেন্দ্র গড়ে ওঠে। কিছুদিন পরেই তা দু-টুকরো হয়। নিজেকে চারু মজুমদারের উত্তরাধিকারী দাবি করে মহাদেববাবু অদ্ভুত অদ্ভুত সব ভাববাদী ধ্যানধারণা ছড়াতে শুরু করেন। আমাদের আঞ্চলিক নেতৃত্ব কোনো মতাদর্শগত-রাজনৈতিক সংগ্রাম চালাতে নিতান্তই অক্ষম ছিল। আমরা এলাকা কমিটি থেকে মহাদেব লাইনের বিরুদ্ধে দলিল তৈরি করে আঞ্চলিক নেতৃত্বকে পাঠাই। তাঁরা তা বিলিও করলেন না। তবে মনে হয় পার্টি পুনর্গঠনের সংগ্রামে সেটাই বোধহয় প্রথম রাজনৈতিক দলিল।

নদীয়ার কমরেডরা, যাঁরা আমাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখতেন, এই সংগ্রামে তাঁরা আমাদের সঙ্গে একমত হতে পারেননি। এমনকি নবদ্বীপে যে কালীদার বাড়িতে আমার আশ্রয় হত এবং পাড়ার টুকটাক সেলাইয়ের কাজ করে যে দু-চার চাকা তিনি রোজগার করতেন তাতেই আমাদের দুজনের খাওয়া-দাওয়া হত – সেই কালীদাও সর্বক্ষণের কর্মী হয়ে নদীয়ায় কাজ করতে গিয়ে মহাদেব লাইনের প্রভাবে পড়েন এবং শহীদ হন।

ইতিমধ্যে আঞ্চলিক কমিটিতে আমাকে ও কার্তিককে অন্তর্ভুক্ত করে সম্পাদক নিজের প্রতি ‘আস্থার সংকট’ সমাধান করতে চান। আঞ্চলিক কমিটিতে গেলাম এবং কিছু সময় পরেই সম্পাদকের দায়িত্ব নিতে হল। কারণ পুরাতন সম্পাদক সকলের আস্থা হারিয়েছিলেন এবং ততদিনে নিজেও ‘শ্রদ্ধেয় ও প্রিয় নেতা কমরেড চারু মজুমদারের’ প্রতি আস্থা হারিয়েছেন।

সে যাই হোক। পার্টি পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া এগোতে থাকল। দ্রুতই বর্ধমান, বাঁকুড়া, নদীয়া, বীরভূম, কলকাতা ও উত্তরবাংলার সংগঠনগুলিকে নিয়ে তৈরি হল রাজ্য লিডিং টিম। কেন্দ্রের সন্ধানে এবার আমরা বেরোলাম শর্মার সাথে যোগাযোগ করতে। উত্তরপ্রদেশের গাজীপুর জেলার একটি গ্রামে দেখা-সাক্ষাতের ব্যবস্থা হল। নির্ধারিত সময়ে কোট-প্যান্ট-টাই পরিহিত শর্মাজী এলেন। তাঁর হয়ে যাবতীয় কথাবার্তা চালালেন রামনাথ, যিনি পরে সিএলআই গ্রুপের নেতা হন। সি এম-এর নামে যা নয় তাই বলতে লাগলেন। আমরা প্রতিবাদ করলাম। শেষমেষ মিটিং ভেঙ্গে গেল এবং আমরাও মাঝরাত্রে বেরিয়ে এসে ট্রেন ধরলাম। ফিরে এসে শর্মা লাইনের বিরুদ্ধে তৈরি হল আমাদের দ্বিতীয় রাজনৈতিক দলিল।

এই দলিলে আমরা গণসংগঠন গণআন্দোলনের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করি। আমাদের রাজ্য লিডিং টিম-এর শান্ত (সৌমেন গুহ) যখন অর্চনাদের দিয়ে ‘সাহসী বোন’ সংগঠন বানাবার পরিকল্পনা করে, আমি তাকে স্বাগত জানাই। এই চিন্তন প্রক্রিয়া অবশ্য কয়েক বৎসরের মধ্যে ব্যহত হয় মূলত গেরিলা সংগ্রামকে চলমান যুদ্ধের স্তরে উন্নীত করার আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে। বিহারের উদীয়মান সংগ্রামের এই পর্যায়ে নতুন সম্ভাবনাকে খতিয়ে দেখারও বোধ হয় প্রয়োজন ছিল।

শর্মার লাইনের বিরুদ্ধে নামতে গিয়ে এটা পরিষ্কার হল যে তৈরি কোনো কেন্দ্রের সন্ধান বৃথা। কেন্দ্রও গড়ে তুলতে হবে নতুন করে। এই প্রক্রিয়াতেই সি এম-এর মৃত্যুর দুবছর পরে ১৯৭৪-এর ২৮ জুলাই গড়ে ওঠে পার্টির নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি কমরেড জহরের নেতৃত্বে। পেছনে ফিরে তাকালে সেদিন আমাদের দৃঢ় সিদ্ধান্ত এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপই মনে হয়। কমরেড জহর ছিলেন খুবই দৃঢ় প্রকৃতির অথচ অত্যন্ত বিনম্র একজন সাচ্চা কমিউনিস্ট। তিনি পশ্চিমবাংলায় আমাদের কাজের এলাকাগুলি কয়েকবারই পরিদর্শন করেন। তিনি আমাদের উৎসাহিত করেন এই বলে যে বিহারের সংগ্রাম এখনও প্রথম পর্যায়ে আছে, পশ্চিমবাংলায় আপনারা সেই পর্যায় পেরিয়েছেন এবং এখন সার্বিক বিপর্যয়ের পরে পুনর্গঠনের কাজে হাত লাগিয়েছেন। এহেন পরিস্থিতিতে সীমিত হলেও নতুন করে যে কৃষক আন্দোলন আপনারা গড়ে তুলেছেন তার গুরুত্ব অপরিসীম। তাঁর ছিল অসাধারণ বিশ্লেষণ ক্ষমতা এবং আমাদের কাছে তিনি প্রেরণার নতুন স্রোত হিসাবেই উপস্থিত হন।

ক্রমেই আমাদের কাজের ভরকেন্দ্র দক্ষিণবাংলা থেকে সরে যায় উত্তরবাংলায়। নকশালবাড়িতে কর্মরত শান্তি পালের গ্রুপ – আগে যার নেতা ছিল দীপক বিশ্বাস, যে সি এম-কে ধরিয়ে দেয় – পুলিশের চাপে পূর্ণিয়াতে সরে পড়ায় আমরা সেখানে অনুপ্রবেশ করি। নকশালবাড়িকে পুনরুজ্জীবিত করার চ্যালেঞ্জ নিয়েই আমাদের সর্বশক্তি সেখানে আমরা ঢেলে দিই। ধাক্কার পর থেকেই সেখানে গোয়েন্দাবাহিনী গ্রামে গ্রামে দালালদের ভালো জাল বিস্তার করেছিল। ফলে পদে পদেই আমরা ধাক্কা খেলাম, মূল্যও দিলাম অনেক। তবে এই প্রক্রিয়ায় আমরা এক বিস্তীর্ণ এলাকায় গরিব কৃষক সাধারণ ও চা মজুরদের সাথে যোগাযোগ গড়ে তুলি, গড়ে ওঠে গেরিলা যোদ্ধাদের নতুন নতুন দল, এমনকি আদিবাসী রাজবংশী মেয়েদের সশস্ত্র গেরিলা বাহিনীও। পুলিশের ক্যাম্প থেকে রাইফেল দখল সহ সাহসিক অ্যাকশনও ঘটে। নকশালবাড়ির কথা ভাবতে গেলে দুটি বিশিষ্ট চরিত্রের কথা মনে পড়ে। একজন ১৮/১৯ বছরের যুবক পটল, যে এক দুর্দান্ত গেরিলা যোদ্ধা এবং পুলিশের কাছে রীতিমতো আতঙ্ক ছিল। বহু চেষ্টার পর বিস্তৃত এক ফাঁদ পেতে পুলিশ তাকে হত্যা করে এবং সেই সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কনস্টেবল পায় রাষ্ট্রপতি পুরস্কার। অন্যজন ছিলেন বৃদ্ধ কমরেড বুধুয়া ওরাঁও, যাঁকে আমরা সকলেই শ্রদ্ধায় পিতাজী বলেই ডাকতাম। আদিবাসী মানুষের সাথে তাঁর গভীর যোগাযোগ ছাড়া আমাদের পক্ষে সেইসব এলাকায় টিকে থাকা ছিল একান্তই অসম্ভব।

বড়পথুজোতের ঘটনার পর উত্তরবাংলায় আমাদের কেন্দ্রীকরণের যবনিকাপাত হল এবং ক্রমেই কাজের ভরকেন্দ্র আবার সরে এসেছে দক্ষিণবাংলার দিকে। তবে নকশালবাড়ি আজও অপেক্ষা করছে তার পুনর্জাগরণের জন্য।

সংক্ষেপে পশ্চিমবাংলায় ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭-এর পর্যায়ে এই ছিল পার্টি ও আন্দোলনকে পুনর্গঠনের প্রচেষ্টার ইতিহাস। এই পর্যায়ের অভিজ্ঞতার সারসংকলনের ভিত্তিতেই ১৯৭৭ পরবর্তী শুদ্ধিকরণ আন্দোলন চলে।

এমন এক সময় যখন যতদূর দেখা যায় শুধু অন্ধকারই চোখে পড়ত। একদল বলতেন আগে পথটা ঠিক করে নেওয়া হোক তারপরেই নামা ভালো। ইতিহাসচক্রে তাঁদের পথও হারিয়ে গেছে, তাঁরাও হারিয়ে গেছেন। অন্য দল বললেন পথে নেমেই পথ চেনা হবে এবং দৃঢ় প্রত্যয়ে হাঁটতে থাকলেন। উন্নততর সমাজ গড়ার স্বপ্ন ও শহীদ সাথীদের রক্তঋণ শোধ করার দায়িত্ববোধই ছিল তাঁদের প্রেরণা এবং ঐক্যবদ্ধ ও শৃঙ্খলাবদ্ধ পার্টি সংগঠনই ছিল তাঁদের হাতিয়ার। তাঁরাই শেষ বিচারে পথের সন্ধানও পেয়েছেন, আন্দোলনকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন এবং পার্টির পুনর্গঠন সম্পন্ন করেছেন। নতুন নতুন কমরেডরা এই সব অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেবেন এই আশাতেই অতীতের এই স্মৃতিচারণা।