(দেশব্রতী, ১৬-৩০ জুন ১৯৯৩ থেকে)

পশ্চিমবাংলায় এবার পঞ্চায়েত নির্বাচন কিছুটা অপ্রত্যাশিত ফলাফল নিয়েই হাজির হয়েছে। বামফ্রন্টের জয় সুনিশ্চত ছিল। কংগ্রেস নেতৃত্বের মধ্যে কেবল কোন্দলজনিত ও কংগ্রেস-বিজেপির মধ্যে ভোটের বিভাজনের সম্ভাবনা থেকে সিপিআই(এম) নেতৃত্ব বরং এবার আগের চেয়েও ভালো ফলাফলেরই প্রত্যাশা করেছিলেন। অথচ অদ্ভুতভাবেই দেখা গেল পৌরসভাতেই হোক বা গ্রাম পঞ্চায়েতেই হোক, কংগ্রেস তার অবস্থার উন্নতি ঘটিয়েছে। এছাড়া বিজেপিও একটি পৌরসভা দখল করা ছাড়াও গ্রাম পঞ্চায়েতেও একটা অবস্থান করে নিতে পেরেছে। কংগ্রেস-বিজেপির মধ্যে বিভিন্ন স্তরে সমঝোতা হয়েছে, হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে একথাও ভুললে চলবে না যে বিজেপি নিছক কংগ্রেসের ভোটেই ভাগ বসায়নি। বামফ্রন্টের সামাজিক ভিত্তির মধ্যেও সে অল্পবিস্তর ভাঙ্গন ধরিয়েছে।

নির্বাচনের আর একটি বৈশিষ্ট্য হল – বামফ্রন্টের শরিকদের মধ্যেও এবার বহু ক্ষেত্রে সমঝোতা হয়নি এবং সিপিআই ও আরএসপি-র মতো দল সিপিআই(এম)-এর বিরোধিতা সত্ত্বেও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় সিপিআই(এম)-কে পরাজিত করেই জয়ী হয়েছে এবং নিজেদের অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় করেছে।

বামফ্রন্টের বাইরের দলগুলির মধ্যে কোচবিহারে কমল গুহদের ফরওয়ার্ড ব্লক এবং এসইউসিআই নিজেদের শক্তিকে ধরে রাখতে বা কিছুটা বাড়িয়ে তুলতেই সক্ষম হয়েছে। আইপিএফ এই প্রথম হাজার তিনেক আসনে প্রার্থী দেয় এবং নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, মালদহ ও বর্ধমানে ৩৫টির মতো আসনে জয়লাভ করতেও সমর্থ হয়। সবচেয়ে বড় কথা, সিপিআই(এম)-এর সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাঁটি হিসাবে পরিচিত বর্ধমান জেলায়, যেখানে দীর্ঘদিন ধরে অন্য কোনো বামপন্থী শক্তির কার্যকরী কোনো অস্তিত্ব নেই বললেই চলে, সেই বর্ধমান জেলায় আইপিএফ এবার ৩০০-র মতো প্রার্থী দেয়। এই প্রার্থীদের একটা বড় অংশই গত তিন বছর ধরে সিপিআই(এম) থেকে বেরিয়ে আসা। সিপিআই(এম)-এর প্রচণ্ড সংগঠিত নির্বাচনী মেশিনারী এবং ব্যাপক সন্ত্রাসের মুখেও আইপিএফ প্রার্থী এবং কর্মীরা সাহসের সঙ্গে রাজনৈতিক সংগ্রামের ময়দানে দাঁড়িয়ে থাকেন এবং বেশি কিছু জায়গায় নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা সিপিআই(এম) ও আইপিএফ-এর মধ্যেই কেন্দ্রীভূত হয়।

বর্ধমানের মতো জেলায় সিপিআই(এম)-এর একাংশের আইপিএফ-এ চলে আসাটা কিন্তু নিছক দলবদলের কোনো ঘটনা নয় – সিপিআই(এম)-এর গণভিত্তির এই বিভাজন এখানে একটা শ্রেণীবিভাজনের রূপ গ্রহণ করে চলেছে। গ্রামের সম্পন্ন সম্ভ্রান্ত অংশ,  পার্টি-প্রশাসন-পঞ্চায়েতের ওপর কর্তৃত্বের জোরে যারা গত পনেরো বছর ধরে ক্রমেই ফুলে-ফেঁপে উঠেছে, সেই অংশটির সাথে গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র-ভূমিহীন কৃষক ও ক্ষেতমজুর জনগণ ও তাদের ঘনিষ্ঠ পার্টি কর্মীদের একাংশের মধ্যে যে ব্যবধান বেড়ে উঠেছে তারই প্রতিফলন ও পরিণতি হিসেবে এককালের সিপিআই(এম) সমর্থক ও কর্মীবাহিনীর এই অংশটি আমাদের দিকে আসতে শুরু করেছেন। এই প্রক্রিয়াটি অবশ্যই আরও গভীর অনুসন্ধানের দাবি রাখে এবং বর্ধমানের এই ধারাটি শুধু উন্নত কৃষি-অর্থনীতির এলাকাগুলিতে ক্রমবর্ধমান আর্থ-সামাজিক মেরুকরণেরই একটি রাজনৈতিক প্রতিচ্ছবি না গ্রামবাংলার রাজনৈতিক জীবনের সাধারণ কোনো প্রবণতা তা এখনও স্পষ্ট নয়। কিন্তু এটা স্পষ্ট যে বর্ধমানে এই শ্রেণীবিভাজন শ্রেণীসংগ্রামের রূপ নেয় এবং পঞ্চায়েত নির্বাচনের মতো রাজনৈতিক সংগ্রামে যখন উদীয়মান কায়েমী স্বার্থান্বেষী ও স্বার্থবাহীদের ‘ঘুঘুর বাসায়’ ঘা পড়ে তখনই তারা মরীয়া হয়ে ওঠে। ঘটে যায় করন্দা, গণহত্যার এমন নারকীয় ঘটনা যার তুলনা কেবল বিহারের বহুনিন্দিত নরসংহারগুলির সাথেই করা চলে।

সামগ্রিক বিচারে বলা যায় যে বিগত কয়েক বছর ধরে পশ্চিমবাংলায় যে রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা চলছিল, এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তা হঠাৎই নড়েচড়ে উঠেছে। কংগ্রেস, বিজেপি থেকে শুরু করে সিপিআই, আরএসপি, কমল গুহর ফরওয়ার্ড ব্লক বা এসইউসি, আইপিএফ সকলেই সিপিআই(এম)-এর বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান মজবুত করেছে। এরই পরিণতিতে গোটা পশ্চিমবাংলা জুড়ে একের পর এক নির্বাচন-পরবর্তী সংঘাত ও হিংসার ঘটনা ঘটে চলেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তির বেড়ে ওঠা সক্রিয়তায় হঠাৎই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে পশ্চিমবাংলার রাজনৈতিক আবহাওয়া। একচ্ছত্র রাজনৈতিক আধিপত্য ও নড়ে ওঠা রাজনৈতিক ভারসাম্যকে ফিরিয়ে আনতে মরীয়া হয়ে সিপিআই(এম) বেছে নিয়েছে সেই অতিপরিচিত কংগ্রেসী সন্ত্রাসের পথ। বিপরীতে নির্বাচনী সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে কংগ্রেস-বিজেপি বামপন্থার বিরুদ্ধে তাদের সার্বিক অভিযান আরও তীব্র করে তুলেছে। পাশাপাশি করন্দার কলঙ্কজনক গণহত্যা ও অন্য বামপন্থী শক্তিগুলির ওপরেও নেমে আসা সিপিআই(এম)-এর আক্রমণের বিরুদ্ধে বিভিন্ন বামপন্থী শক্তিগুলির মধ্যে সহযোগিতার একটা সম্ভাবনাও গড়ে উঠেছে। করন্দার গণহত্যার প্রতিবাদে ৩ জুন পার্টি নির্বিশেষে যেভাবে ব্যাপক বামপন্থী কর্মীর সহযোগিতা ও সমর্থনে বর্ধমান জেলায় ১২ ঘণ্টার সর্বাত্মক বনধ পালিত হল তা এই সম্ভাবনারই একটি ইঙ্গিত বহন করছে।

এমন এক জটিল অবস্থায় বাম ঐক্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের বন্ধুরা অনেকেই চিন্তিত হয়ে উঠেছেন। তাঁদের আশঙ্কা, বামপন্থী শক্তিগুলির মধ্যে বিভাজনের সুযোগ নিয়ে কংগ্রেস-বিজেপি এ রাজ্যে মাথাচাড়া দিয়ে না ওঠে। আমি মনে করি, এ ব্যাপারে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। সিপিআই(এম)-এর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আজ যে বামপন্থীরা সোচ্চার হচ্ছেন তাঁরা কংগ্রেস-বিজেপির সাথে নীতিগত ও রাজনৈতিক দূরত্ব বজায় রাখার প্রশ্নে যথেষ্ট সচেতন ও সচেষ্ট। কিন্তু কংগ্রেস-বিজেপির ধুয়ো তুলে সিপিআই(এম) যদি বিভিন্ন বামপন্থী শক্তিকে পোষ মানাতে চায় তাহলে এটুকুই বলতে পারি যে সেটা হবে অত্যন্ত ন্যক্কারজনক নেতিবাচক রাজনীতি। পুরোনোভাবে বাম ঐক্যকে আর ধরে রাখা যাবে না – তাকে দাঁড়াতে হবে এক নতুন ভিত্তির ওপর। বামফ্রন্টের অভ্যন্তরে যেসব শরিক দল তাদের স্বাধীন অস্তিত্ব তুলে ধরেছে তাদের সকলেরই দাবি – সিপিআই(এম)-কে তার দাদাগিরির মনোভাব ছাড়তে হবে। বামফ্রন্টের বাইরে যে বামশক্তি আছে, বামফ্রন্ট সরকারের ভূমিকা নিয়ে তাদের সাথে তাত্ত্বিক বিতর্কে অবতীর্ণ হওয়ার সাহস সিপিআই(এম)-এর নেতৃত্বকে দেখাতে হবে – সম্মান জানাত হবে বামফ্রন্ট সরকারের জনবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে বামপন্থীদের আন্দোলন করার অধিকারকে। আর অবশ্যই করন্দার মতো কলঙ্কজনক ঘটনার ক্ষেত্রে সিপিআই(এম) নেতৃত্বকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় আত্মসমালোচনা করতে হবে, দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দিতে হবে। সিপিআই(এম) যদি এই পথ বেছে নিতে পারে তাহলে অবশ্যই পশ্চিমবাংলায় বাম ঐক্যের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে, তার নীতিগত ভিত্তিও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। এরকম নীতিনিষ্ঠ বাম ঐক্যই প্রকৃত মার্কসবাদীদের কাম্য।

আর এ পথ না নিয়ে সিপিআই(এম) যদি অধুনালিপ্ত সোভিয়েত নেতৃত্বের মতো নিজেদের মডেলকেই সর্বশ্রেষ্ঠ বলে অহংকারে ভোগেন, দাদাসুলভ মনোভাব নিয়ে সকলের ওপর নিজেদের  কর্তৃত্ব চাপিয়ে দিতে চান, সোভিয়েত নেতৃত্বের মতোই পার্টির প্রচারযন্ত্রের মাধ্যমে ভুল ও বিকৃত তথ্য পার্টি কর্মীবাহিনীর কাছে পরিবেশন করতে থাকেন, তাহলে বাম ঐক্য তো দূরের কথা সোভিয়েত নেতৃত্বের মতোই তাঁদেরও পতন ঘটবে। লেনিন একসময়ে বলেছিলেন, ইতিহাসে বহু বিপ্লবী পার্টিই, যারা অহংকারী হয়ে উঠেছিল ও প্রকৃত আত্মসমালোচনা করার সাহস দেখাতে পারেনি, ধ্বংস হয়ে গেছে। ইতিহাসের এমনই পরিহাস যে খোদ সোভিয়েত পার্টির মতো বিশালকায় পার্টি ও তার দ্বারা পরিচালিত বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শক্তিও লেনিনের এই শিক্ষা ভুলে গিয়ে সেই পরিণতিরই শিকার হয়েছে। সিপিআই(এম) নেতৃত্ব ইতিহাস থেকে কী শিক্ষা নেবেন জানি না, ইতিহাস কিন্তু তার নিজস্ব অমোঘ গতিতেই এগিয়ে চলবে।