(২৩ মার্চ ১৯৯৪, কলকাতায় বিধানসভা অভিযানে ভাষণ)

কমরেডস,

গত বছরের মাঝামাঝি করন্দায় যখন একটা গণহত্যা হয়, আমি সেখানে গিয়েছিলাম পাঁচ-পাঁচজন ক্ষেতমজুর কমরেডের মৃতদেহে মাল্যার্পণ করার জন্য। সেদিন করন্দায় আমরা যা দেখেছিলাম সেটা নিছক একটা গ্রামের ঘটনা ছিল না। গোটা পশ্চিমবাংলা জুড়ে সিপিআই(এম)-এর নেতৃত্ব ক্রমেই এমন সব শক্তির হাতে চলে যাচ্ছে গ্রামাঞ্চলে যারা নতুন উঠতি বাবু সম্প্রদায়। আর সর্বত্রই ক্ষেতমজুর গরিব কৃষকদের ওপর শুরু হয়েছে এক ধরনের শাসানি, অত্যাচার। তারই পরিণতি ঘটেছিল করন্দায়। এবং আজও শুনতে পাই যেখানেই ক্ষেতমজুর গরিব কৃষকরা তাঁদের দাবিদাওয়া নিয়ে, তাঁদের সম্মান নিয়ে, তাঁদের অধিকার নিয়ে আওয়াজ তোলেন, এই নতুন উঠতি জোতদারেরা তাঁদের হুমকি দেয় ‘করন্দা বানিয়ে দেব’।

কিছুকাল আগে কলকাতায় কাগজের রিপোর্টারদের সাথে কথাবার্তায় বলেছিলাম – এই যে বামফ্রন্ট সরকার এখন ক্ষমতায় আছে ১৯৭৭ সাল থেকে, তা কোনো গণআন্দোলনের ফসল নয়। জাতীয় রাজনৈতক পরিস্থিতিতে যে বিশেষ পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল সেই সুযোগেই তারা ক্ষমতায় এসেছে – কোনো গণআন্দোলনের জোয়ারের ওপর দাঁড়িয়ে তারা ক্ষমতায় আসেনি। সেই কথা নিয়ে দেখলাম সিপিআই(এম)-এর তাত্ত্বিকেরা আলোচনা এড়িয়ে গেলেন। কারণ সেই আলোচনায় গেলে অনেক কথাই বেরিয়ে আসবে। ওদের একটি ছোটো দলের একজন ছোটো মাপের নেতা বললেন বিনোদ মিশ্রের ইতিহাসের জ্ঞান নেই। জ্যোতি বসু এককালে শ্রমিকদের সাথে চাটাইয়ে বসে কথাবার্তা বলতেন। বিনোদ মিশ্রের কোনো বই পড়ে ইতিহাসের জ্ঞানের দরকার নেই। কারণ সে যুগের যে ইতিহাস, আমি নিজেই সেই ইতিহাসের অংশ, আমি নিজেই সেই ইতিহাসের অংশীদার। আর জ্যোতিবাবু কবে শ্রমিকদের সাথে চাটাইতে বসে কথা বলতেন – সে যুগের কথা আলাদা। কিন্তু আজকে সারা দেশের পুঁজিপতিরা সমবেত স্বরে একটাই স্লোগান দেয়, ‘কমিউনিস্ট হো তো ক্যায়সা হো জ্যোতি বাবু য্যায়সা হো’। এই হচ্ছে বাস্তব অবস্থা। গণআন্দোলন ছাড়া যে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এসেছে, এই দিশাতেই, এই দিকেই সে যাচ্ছে।

এর প্রভাব পড়ে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে। যেমন দেখুন, আজকের বিহারে এক বিপ্লবী বামফ্রন্ট গড়ে তোলার, এক শক্তিশালী গণআন্দোলনের ওপর দাঁড়িয়ে বামফ্রন্ট গড়ে তোলার কী চমৎকার এক পরিস্থিতি এসেছে। এই কাঁসিরাম যে সারা ভারতবর্ষ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, এমনকি, কলকাতায় এসেও কত হৈ চৈ করে গেল, সে লোকটার আজ পর্যন্ত সাহস হয়নি বিহারে ঢোকার। সেখানে আমরা এক বিশাল সামাজিক পরিবর্তন ৠালি করেছি গত ১৮ মার্চ। বিহারের সবকটা কাগজে এই কথা লিখেছে যে গত বিশ বছরে যত ৠালি হয়েছে পাটনায়, সবকটার রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে সিপিআই(এমএল)-এর ৠালি। কাজেই আমি বলতে চাইছিলাম, এক বিপ্লবী বামফ্রন্ট গড়ার একটা দারুণ পরিস্থিতি সেখানে আছে। কিন্তু আমাদের সিপিআই, সিপিআই(এম) বন্ধুরা তাতে রাজি নন, তাঁরা সেখানে লালু যাদবকেই বেছে নিয়েছেন তাঁদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসাবে।

দেশের বৃহত্তর স্বার্থে, জাতীয় স্বার্থে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে, বহুজাতিক কোম্পানিগুলির বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে বামপন্থী ঐক্য নিশ্চয়ই আমরা চাই। সারা দেশেই হোক, বিভিন্ন রাজ্যেই হোক, এমনকি পশ্চিমবাংলাতেই হোক আমরা অবশ্যই বামপন্থী শক্তিদের সাথে হাত মিলিয়ে একসাথে চলতে চাই। কিন্তু এই বামফ্রন্ট সরকারের যেভাবে এক সার্বিক অধঃপতন হয়ে চলেছে – করন্দায় তাঁরা ক্ষেতমজুরদের হত্যা করছেন, কোথাও স্কুলের হেডমাস্টারকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে মারা হচ্ছে, কোথাও শিশু মহিলা সহ একটা বর্গাদার পরিবারকে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, বীরভূমে একজন ডাক্তারের বদলি নিয়ে মানুষের যে বিক্ষোভ সেখানে পুলিশ গুলি চালাচ্ছে, কে একটা সাট্টা ডন আছে কী এক খান, তার সাথে শোনা যাচ্ছে সিপিআই(এম) নেতাদের ভালোই মেলামেশা, মহিলা সমিতির যিনি নেত্রী তিনি মহিলা বিরোধী কার্যকলাপের সাথে যুক্ত – এই যে একটা সার্বিক অধঃপতন হচ্ছে, এই যে একটা স্খলন হচ্ছে বামফ্রন্ট সরকারের, সেখানে তাদের বিরোধিতা করা ছাড়া আমাদের কাছে আর কোনো পথ খোলা নেই। আমরা তাঁদের বলেছি, শ্রেণীসংগ্রামের হাতিয়ার বলে আপনারা আপনাদের যাত্রা শুরু করেছিলেন কিন্তু আজ আপনারা গণআন্দোলন দমনের যন্ত্রে পরিণত হয়েছেন। আমরা আপনাদের এই স্খলনের অংশীদার হতে পারব না, আপনাদের এই দমনযন্ত্রের সাথে হাত মেলাতে পারব না – দয়া করে আমাদের ক্ষমা করবেন।

তাঁরা আমাদের হুমকি দেন, “আমরা আপনাদের সারা ভারতবর্ষের বামপন্থী রাজনীতি থেকে, বামপন্থী শক্তিগুলি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেব”। আমরা বললাম সে চেষ্টা আপনারা করে দেখতেই পারেন। আমরা অনেক বছর ধরেই অপেক্ষা করছি। আরও বহু বছর অপেক্ষা করার ধৈর্য্য আমাদের আছে, কিন্তু কোনোমতেই আমরা আপনাদের অধঃপতনের অংশীদার হতে পারব না এবং পশ্চিমবাংলায় সার্বিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করা এক গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য বলেই আমরা মনে করি।

পশ্চিমবঙ্গে দেখা যাচ্ছে বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের যে বিক্ষোভ আছে, আক্রোশ আছে সেটাকে পুঁজি করে মমতা ব্যানার্জী অনেক হাঁকডাক করে বেড়ান। এই সুযোগে যুব কংগ্রেসের ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীকে তিনি সংগঠিত করার চেষ্টা করছেন। তাঁর স্লোগান – পশ্চিমবঙ্গ থেকে লাল হঠাও। আমরা বলতে চাই পশ্চিমবঙ্গ সোভিয়েত ইউনিয়ন বা পূর্ব-ইউরোপ নয়। এখানে যেমন ক্ষমতালিপ্সু অধঃপতিত বামপন্থীরা আছেন তেমনই বিপ্লবী বামপন্থী শক্তিও আছে। পশ্চিমবাংলার বুকে সিপিআই(এমএল)-ই ছিল তৃতীয় শক্তি যে সমগ্র রাজ্যে এক বিশাল শক্তি হয়ে উঠেছিল। বামফ্রন্ট সম্পর্কে যে নৈরাশ্য আজ মানুষের মনে জাগছে সেই পরিপ্রেক্ষিতে নতুন করে সেই শক্তিও উঠে দাঁড়াচ্ছে। কাজেই মমতা ব্যানার্জীদের আমি বলে দিতে পারি – তাঁরা যদি মনে করেন যে বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে লড়েই লালকে হঠাতে পারবেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে, সেটা কোনোদিনই সম্ভব নয়। তার পেছন থেকে উঠে আসছে আর এক বিপ্লবী লাল শক্তি এবং সেই লাল শক্তির সাথে লড়াইটা চলবে। কাশীপুর-বরানগরের গণহত্যার কথা আমরা ভুলিনি। কংগ্রেসের সাথে আমাদের অনেক হিসেব-নিকেশ বাকি আছে। কাজেই সে সুযোগ আমরা কংগ্রেসীদের কোনোদিন দেব না। পশ্চিমবাংলায় বামফ্রন্ট সরকারের ভাঙন ও পতনের ফলে যদি এখানে কোনো এক নতুন শক্তি উঠে দাঁড়ায় সেটা হবে নকশালপন্থার বিপ্লবী বামশক্তি। আর কোনো বিকল্প এখানে গড়ে উঠতে পারে না।

করন্দায় আমরা দেখলাম এই হত্যাকাণ্ডের পিছনে যার মুখ্য ভূমিকা, সেই রামনারায়ণ গোস্বামীকে তাঁরা প্রমোশন দিয়ে কিষাণসভার বড় নেতা বানিয়ে দিয়েছেন এবং যে লোকটা প্রধান অভিযুক্ত তাকে তাঁরা সেখানে পঞ্চায়েত প্রধান বানিয়ে দিলেন। তাঁরা এই হুমকিটাই দিয়ে যাচ্ছেন যে, করন্দা ঘটিয়ে দেব। আমিও বলে দিতে চাই যে তাঁরা যদি করন্দা ঘটিয়ে দিতে থাকেন, করন্দা যদি ঘটে – তাহলে নকশালবাড়িও ঘটবে এবং নকশালবাড়ির কৃষক আন্দোলনের লক্ষ্য হবে এই নতুন জোতদারেরা যারা সিপিআই(এম)-এর ঝাণ্ডা নিয়ে পঞ্চায়েতকে কাজে লাগিয়ে নতুন করে ক্ষমতা দখল করে বসে আছে। এই কটি কথা বলে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি।

ইনকিলাব জিন্দাবাদ।