(কলকাতার ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৫ “মাও সে তুঙ জন্মশতবর্ষ উদযাপন কমিটি” আয়োজিত আলোচনা সভায় ভাষণ)

আজকে দুনিয়া জুড়ে প্রশ্নটা শুধু মাও সে তুঙ-এর বা মাও সে তুঙ চিন্তাধারার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে নয়, মার্কসবাদ-লেনিনবাদের প্রাসঙ্গিকতা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে এবং বুর্জোয়ারা এটা ঘোষণাও করে দিয়েছে যে মার্কসবাদ ব্যর্থ হয়েছে। তাই সামগ্রিক অর্থেই প্রশ্নটা আজকের মার্কসবাদ-লেনিনবাদের পুনরুজ্জীবনের প্রশ্ন এবং সেই প্রসঙ্গেই মাও সে তুঙ চিন্তাধারার প্রশ্নটা আলোচনার দাবি রাখে।

সোভিয়েত নেতৃত্ব একটা পেটিবুর্জোয়া চিন্তাধারা হিসাবে ‘মাওবাদ’কে চিহ্নিত করতেন, যার সাথে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের নাকি কোনো সম্পর্ক নেই। আমাদের আন্দোলনের মধ্যেও একটা ধারা মাও সে তুঙ চিন্তাধারাকে ‘মাওবাদ’ হিসাবে চিহ্নিত করে একটা বিশেষ কোনো ধারা হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করতেন। আমি এই মতকে সমর্থন করি না। মাও সে তুঙ চিন্তাধারাকে কোনো একটা বদ্ধ বা স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যবস্থা হিসাবে আমি দেখি না।

মাও সে তুঙ চিন্তাধারা মার্কসবাদ-লেনিনবাদের এক নির্দিষ্ট প্রয়োগ। বিশেষ করে পশ্চাদপদ অর্থনীতির দেশে সমাজতন্ত্র গড়ার ক্ষেত্রে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের এক বিশষ প্রয়োগ হিসাবে মাও সে তুঙ চিন্তাধারাকে দেখতে হবে। পশ্চাদপদ অর্থনীতির দেশে সমাজতন্ত্র গড়ার যে নির্দিষ্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা তার একটা সার্বজনীন মূল্য আছে এবং মাও সে তুঙ চিন্তাধারা এই অর্থে এক সার্বজনীন মূল্য রাখে। অন্যদিকে, আজকের যুগে মাও সে তুঙ চিন্তাধারা হচ্ছে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ পুনরুজ্জীবনের চাবিকাঠি।

মাও সে তুঙের দুটো মৌলিক অবদান। প্রথমত তিনি একটি পশ্চাদপদ দেশে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সফল করেন বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে; অর্থাৎ যে বিপ্লব পুঁজিবাদের দিকে নয়, সমাজতন্ত্রের দিকে যাত্রা করবে। এই বিপ্লব করতে গিয়ে তিনি প্রথমত কৃষকদের সাথে জোট গড়ে তুললেন এবং কৃষকদের বিপ্লবী ভূমিকাকে প্রতিষ্ঠা করলেন। দ্বিতীয়ত বুর্জোয়া শ্রেণীকে দুভাগে ভাগ করে ‘জাতীয় বুর্জোয়া’ অংশের সাথে এক জোট তৈরি করেন – এমনকি সমাজতন্ত্র গঠনের পর্যায়েও তাদের সাথে ঐক্য ও সংগ্রামের পদ্ধতিতে তাদের রূপান্তর ঘটান। সুতরাং তাঁর প্রথম মৌলিক অবদান হল এমন এক গণতান্ত্রিক বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়া, যাকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের দিকে পরিচালনা করা যায়। তাঁর দ্বিতীয় মৌলিক অবদান হচ্ছে চীনের মতো পিছিয়ে পড়া দেশে সমাজতন্ত্র গঠন।

সমাজতন্ত্র হল পুঁজিবাদ ও সাম্যবাদের মধ্যকার এক উত্তরণকালীন ব্যবস্থা। সমাজতন্ত্রের এই পর্যায় বহু বছর ধরে চলবে, এমনকি কয়েকশত বছর ধরেও চলতে পারে। মাও সে তুঙ উত্তরণকালের এই দীর্ঘমেয়াদী চরিত্রকে সামনে নিয়ে আসেন এবং বলেন, এই উত্তরণশীল অবস্থায় শ্রেণী থাকবে, শ্রেণীসংগ্রাম থাকবে, এমনকি পিছিয়ে যাওয়ার, পুঁজিবাদের পুনঃপ্রবর্তনের বিপদও আছে। এই কথা তিনি বলেছেন কোনো বিষয়ীগত কারণে নয়, তার একটা বস্তুগত কারণ আছে। দুঃখের কথা সেই বিষয়ে অধ্যয়ন আমাদের দেশে মার্কসবাদীদের মধ্যে খুবই কম। একটা সমাজতান্ত্রিক দেশের পুঁজিবাদে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ কারণ থাকে এবং বাহ্যিক কারণ থাকে। অভ্যন্তরীণ কারণের ক্ষেত্রে মূল বিষয় হল – এখানে বিতরণের যে নীতি তা মোটামুটি পুঁজিবাদী সমাজের মতোই থেকে যায়। সেখানে সমগ্র জনগণের মালিকানা থাকে তার সাথে শ্রমিকের সম্পর্কের মধ্যে দ্বৈত চরিত্র থাকে। একদিকে, যেহেতু সেটা জনগণের বা রাষ্ট্রীয় মালিকানা, সেই মালিকানার একটা অংশ তারও, অর্থাৎ সে নিজেও মালিক – এরকম একটা অনুভূতি শ্রমিকের মনে আসে। কিন্তু অন্যদিকে যেহেতু বিতরণের নীতিটা হচ্ছে কাজের ভিত্তিতে (প্রত্যেকে তার কাজ অনুসারে পাবে), সেই কারণে সে একজন মজুরি শ্রমিক – এরকম একটা অনুভূতিও তার থাকে। সমাজতান্ত্রিক সমাজ উত্তরণকালীন পর্যায়ে থাকায়, তার বিশিষ্টতার জন্যই এই দ্বৈত সত্তা শ্রমিকের চেতনায় থাকে। তেমনই এই মালিকানায় সমগ্র জনগণের মালিকানা হিসাবে একটা দিক থাকে। অন্যদিকে, যেহেতু সেটা রাষ্ট্রীয় মালিকানা, তার কর্মচারিরা রাষ্ট্রের দ্বারা নিযুক্ত হয়, কাজেই সেই মালিকানায় আমলাতন্ত্রের এক প্রবণতাও থাকে। মালিকানার মধ্যেও দ্বৈত সত্তা থাকে, শ্রমিকের মধ্যেও দ্বৈত চেতনা থাকে। আর এটাই একটা সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রধান দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বই শ্রেণীসংগ্রামের জন্ম দেয় এবং তার প্রতিফলন হিসাবে কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যেও দুই লাইনের সংগ্রামের জন্ম দিয়ে থাকে। এখান থেকে কোনো সমাজতান্ত্রিক সমাজ এই দ্বন্দ্বের সমাধান করে এগিয়েও যেতে পারে সমাজতন্ত্রের উন্নততর রূপ কমিউনিজমের দিকে, আবার সে পিছিয়েও যেতে পারে পুঁজিবাদের দিকে। এখানে মূল প্রশ্নটা হচ্ছে সর্বহারার একনায়কত্বের প্রশ্ন। মার্কস বলেছিলেন, সমাজতন্ত্রের দীর্ঘ এই উত্তরণকালীন পর্বে সর্বহারার একনায়কত্ব হচ্ছে এক যোগসূত্র। সোভিয়েত ইউনিয়নে ক্রুশ্চেভের সময় থেকেই সর্বহারা একনায়কত্বকে দুর্বল করা হয়েছে, সর্বহারা একনায়কত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, তাকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। আর তখন থেকেই সোভিয়েতের পুঁজিবাদের দিকে যাত্রাও শুরু হয়েছে।

মাও সে তুঙের সাংস্কৃতিক বিপ্লব নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। ক্ষুদে উৎপাদকদের দেশে উগ্র সমানতাবাদের চেতনার এক গভীর সামাজিক-ঐতিহাসিক উৎস থাকে। অর্থাৎ উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ পশ্চাদপদ থেকে গেলেও বিতরণের ক্ষেত্রে উগ্র সমানতার এক আকাঙ্খা পেটি বুর্জোয়া উৎপাদকদের চেতনায় থাকে। সেক্ষেত্রে অনেকে মনে করে থাকেন, উৎপাদিকা শক্তি পিছিয়ে থাকলেও কোনো একটা মতাদর্শগত বিপ্লব – কোনো একটা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মাধ্যমে বোধহয় সেই সাম্য প্রতিষ্ঠা করা যায়। এইভাবেই সাংস্কৃতিক বিপ্লবকে অনেকে দেখে থাকেন। কিন্তু মাও সে তুঙের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ধ্যানধারণা ভিন্ন ছিল। সর্বহারা একনায়কত্বকে দৃঢ় করার জন্য, সমাজতান্ত্রিক শিক্ষা, সমাজতান্ত্রিক চেতনাকে বাড়ানোর লক্ষ্যটা অবশ্যই ছিল। কিন্তু কখনই সমাজতন্ত্র গঠনের যে মূল অর্থনৈতিক নিয়ম আছে তাকে বা সমাজতন্ত্রের বিভিন্ন পর্যায়গুলিকে খারিজ করে দিয়ে শুধুমাত্র মতাদর্শগতভাবে ‘উন্নত উৎপাদন সম্পর্ক’ প্রতিষ্ঠা করে ফেলা যায়, আমি মনে করি না যে মাও সে তুঙ তা বিশ্বাস করতেন।

আমাদের দেশে যেসব সমাজগণতান্ত্রিক শক্তি বা সংশোধনবাদী শক্তি আছে তাদের দিক থেকে মাও সে তুঙকে গ্রাস করে ফেলার একটা চেষ্টা সাম্প্রতিককালে আমরা দেখেছি। প্রথমত বুর্জোয়াদের প্রশ্ন তুলে তাঁরা বলছেন যে, মাও সে তুঙ বুর্জোয়াদের সাথে জোট তৈরি করেছিলেন। তাঁরা যে কথাটা বলছেন না, মাও সে তুঙ বুর্জোয়াশ্রেণীকে দুভাগে ভাগ করেছিলেন – মুৎসুদ্দি এবং জাতীয়। মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে তিনি লড়েছিলেন এবং জাতীয় বুর্জোয়াদের সাথে জোট করেছিলেন। এই বিভাজনকে গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যেহেতু সমাজগণতন্ত্রীরা আমাদের দেশের বুর্জোয়াদের জাতীয় বুর্জোয়াই মনে করেন, কাজেই তাঁরা মাও সে তুঙের কথা নিয়ে এসে – জাতীয় বুর্জোয়াদের সাথে ঐক্য করতে হবে – এভাবে বলে মাও সে তুঙের শিক্ষাকে বিকৃত করছেন। তাঁরা মাও সে তুঙের অন্য এক শিক্ষার কথা নিয়ে আসছেন – তিনি কৃষকদের নিয়ে বিপ্লব করেছেন। কিন্তু কৃষকদের মধ্যেও মাও সে তুঙ যে বিভাজন করেছেন এবং গরিব-ভূমিহীন-নিম্নমধ্য কৃষকদের ওপরে যে তাঁর জোর থেকেছে সেই প্রশ্নটাকে বাদ দিয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং কৃষক বলে মধ্য, ধনীকৃষক সবার কথা বলা হচ্ছে। তেমনি বারবার বলা হচ্ছে মাও সে তুঙ দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদের পক্ষে ছিলেন। এভাবে তাঁরা ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর উগ্র জাতীয়তাবাদের পক্ষেও দাঁড়াচ্ছেন। এভাবেই মাও সে তুঙকে গ্রাস করে ফেলার একটা সমাজগণতন্ত্রী প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে।

এক সময়ে মাও সে তুঙ চিন্তাধারার একটা ধারণার ভিত্তিতে আমরা বিপ্লবী আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলাম। তারপর থেকে গঙ্গা-গোদাবরী দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। বহুধা বিভক্ত হয়েও আমরা সকলেই বিভিন্নভাবে শক্তি সঞ্চয় করেছি এবং তা প্রমাণ করে যে আমাদের আন্দোলনের মধ্যে বিরাট শক্তি আছে। আমি আশা করব, মাও সে তুঙ চিন্তাধারার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ভবিষ্যতে হয়তো আবার আমরা হাত মেলাবো।