(২২ এপ্রিল ১৯৯৪, পার্টি প্রতিষ্ঠার রজত জয়ন্তী সমাবেশে শহীদ মিনার ময়দানে ভাষণ)

কমরেডস,

আজ থেকে ২৫ বছরে আগে আমাদের পার্টি সিপিআই(এমএল)-এর জন্ম হয়েছিল এবং ১৯৬৯ সালের ১ মে এই শহীদ মিনারেই তা ঘোষণা করা হয়েছিল। আজ পার্টির ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে আমরা সেই ঐতিহাসিক ময়দানে আবার মিলিত হয়েছি।

আমাদের আন্দোলনকে প্রচণ্ড দমন-পীড়ন সহ্য করতে হয়েছে – ভারতবর্ষে কোনো আন্দোলনকেই বোধ হয় এত বেশি অত্যাচার, এত বেশি দমন-পীড়ন সহ্য করতে হয়নি। কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে সিপিআই(এমএল)-কে শেষ করা যায়নি, সে বেঁচে আছে এবং এগিয়ে চলেছে।

অনেকে ভাবতেন যে নকশালপন্থীরা দমন দিয়ে শেষ হয়নি বটে কিন্তু এদের বহু গ্রুপ আছে – নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করেই ক্রমে ক্রমে এরা শেষ হয়ে যাবে। ইতিহাস কিন্তু প্রমাণ করেছে যে এই ধারণাটিও ছিল ভুল। ইতিহাসের অনিবার্য নিয়মে ঠিক যেভাবে রুশ বিপ্লবে বহু গ্রুপের ভেতর থেকে কমরেড লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকরাই সোভিয়েত রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান ধারা, সোভিয়েত রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি হয়ে উঠে এসেছিলেন – বাকি সমস্ত গ্রুপই ক্রমে ক্রমে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল, সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটছে ভারতবর্ষে। বহু গ্রুপের ভেতরকার সংঘাতের মধ্যে দিয়ে, রাজনৈতিক বিতর্কের মধ্য দিয়ে আমরাই ভারতবর্ষের পার্টি হিসাবে বেরিয়ে এসেছি। বহু গ্রুপই ক্রমে ক্রমে বিলীয়মান এবং বাকিরা সেই পথের দিকেই চলেছে।

অনেকে আবার মনে করেছিলেন নতুনভাবে উঠে দাঁড়ালেও আজকের পরিস্থিতিতে আবার আগেকার মতো কাণ্ডকারখানা, পুরোনো ভুলের পুনরাবৃত্তিই এরা করবে এবং এই প্রক্রিয়ায় জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে – শেষ হয়ে যাবে। আমরা এই ধারণাকেও ভুল বলে প্রমাণ করেছি। আমাদের পার্টি ভারতবর্ষের নির্দিষ্ট পরিস্থিতির সাথে সঙ্গতি রেখে তার লাইনকে বিকাশ করেছে এবং চরমতম কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও কীভাবে এগিয়ে যাওয়া যায় তা দেখিয়ে দিয়েছে। নকশালপন্থী বলতে যদি সশস্ত্র বিপ্লবের ফাঁকা বুলি আওড়ানো মনে করা হয়, যদি সশস্ত্র দল বানিয়ে কিডন্যাপিং বোঝানো হয়, সশস্ত্র স্কোয়াড বা দলের সাহায্যে পোস্ট অফিস পোড়ানো, রেল লাইন ওপড়ানো মনে করা হয়, তথাকথিত গণআদালতের নামে লোকজনের কান-নাক কাটা বোঝায়, শিশু-মহিলা নির্বিশেষে সাধারণ গরিব মানুষের গণহত্যা বোঝানো হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই আমরা নকশালপন্থী নই। যদি নকশালপন্থী বলতে সেই শক্তিকে বোঝানো হয়ে থাকে, যে শক্তি লক্ষ লক্ষ কৃষক সাধারণের সংগ্রামকে নেতৃত্ব দেবে, তাদের বিপ্লবী গণআন্দোলনকে নেতৃত্ব দেবে, সেই বিপ্লবী গণআন্দোলনের মধ্যে তাদের সশস্ত্র প্রতিরোধকে নেতৃত্ব দেবে – তাহলে সেই অর্থে আমরা অবশ্যই নকশালপন্থী এবং আমরাই ভারতবর্ষের একমাত্র নকশালপন্থী।

কমরেডস, নকশালবাড়ির সংগ্রামের ধারাবাহিকতাকে শুধু আমাদের পার্টিই এগিয়ে নিয়ে চলেছে। পার্টি পুনর্গঠন করতে গিয়ে আমাদের পার্টির ভেতরে যে নৈরাজ্যবাদীরা ছিল তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়েছে। এবং আজ সংসদীয় সুবিধাবাদী শক্তিগুলি, সিপিআই-সিপিআই(এম)-এর মতো পার্টিগুলি যারা বামপন্থার নেতৃত্ব নিয়ে বসে আছে, তাদের বিরুদ্ধে আমাদের পার্টি সবচেয়ে শক্তিশালী চ্যালেঞ্জ হিসেবে উঠে দাঁড়িয়েছে। আজ প্রশ্ন এসেছে ভারতবর্ষের বাম আন্দোলনের, কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতৃত্ব কাদের হাতে থাকবে। এই সংসদীয় সুবিধাবাদী পার্টিগুলির হাতে থাকবে নাকি একটি বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি – ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)-র হাতে থাকবে। করন্দা-কালনার ঘটনা দেখিয়ে দেয় সিপিআই(এম)-এর ভেতর যে বিপ্লবী শক্তি ছিলেন, বিপ্লবী কমরেডরা ছিলেন, তাঁরা সিপিআই(এম) থেকে ভেঙে আমাদের  পার্টিতে যোগ দিচ্ছেন। সিপিআই(এম)-এর দেউলিয়াপনা এখানেই যে আমাদের সাথে রাজনৈতিক সংগ্রামের মাধ্যমে এই সমস্ত শক্তিগুলিকে তারা আটকে রাখতে পারেনি, তাই তারা হত্যার রাজনীতি আমদানি করে তাদের ভাঙ্গনকে ঠেকাতে চাইছে। করন্দা-কালনা সত্ত্বেও, সেইসব হত্যাকাণ্ড সত্ত্বেও, আমাদের পার্টি রাজনৈতিক প্রতিবাদই করেছে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতায় ২৩ মার্চ আমি একটা কথা বলেছিলাম যে এরকম করন্দা যদি ঘটতে থাকে তাহলে আমরা অবশ্যই নকশালবাড়ি সংগঠিত করব। কারণ পশ্চিমবাংলার ক্ষেতমজুর-গরিব কৃষকরা পড়ে পড়ে মার খেতে পারেন না, তাঁদের অধিকার আছে প্রতিবাদ করার, প্রতিরোধ করার। এই কথাতে তাঁরা আমাদের বিরুদ্ধে রাগ দেখালেন। আশ্চর্য লাগল আমার। একজন নকশালপন্থী হয়ে আমি তো নকশালবাড়ির কথাই বলব। আমি তো আর মামাবাড়ির কথা বলতে পারি না, সাঁইবাড়ির কথা বলতে পারি না। এতে অত আশ্চর্যের কী ছিল। অথচ দেখলাম তাঁরা আমার ঐ বক্তব্যের সূত্র ধরে বললেন যে পশ্চিমবাংলায় তাঁরা আমাদের সাথে আর সংযুক্ত কার্যকলাপ করবেন না। সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংযুক্ত কার্যকলাপও তাঁরা আমাদের সাথে করবেন না। যে মহামিছিল আমরা একসাথে করতে যাচ্ছিলাম সেটা ছিল ডাঙ্কেল প্রস্তাবের বিরুদ্ধে – গ্যাট চুক্তির বিরুদ্ধে। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তাঁরা অর্জুন সিং-এর সাথে হাত মেলাতে রাজি, তামাম জনতা দলের শক্তির সাথে হাত মেলাতে রাজি। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদের মতো বিপ্লবী বাম শক্তির সাথে হাত মেলাতে রাজি নন।

কমরেডস, আমরা তাঁদের বারবার বলেছি, পশ্চিমবাংলা একটি রাজ্য – ভারতবর্ষের একটি রাজ্য মাত্র। এখানে আপনারা সরকারে আছেন, আমরা আপনাদের বিরোধী পক্ষে আছি। আমাদের মধ্যে সংঘাত থাকবে এটা স্বাভাবিক। এ সংঘাত আজকের নয়, এ সংঘাতের জন্ম ১৯৬৭ সালে নকশালবাড়ি থেকেই। নকশালবাড়ির সেই সময়ে আপনারা সরকারে ছিলেন এবং আমরা কৃষকের বিদ্রোহ সংগঠিত করেছিলাম। আপনাদের এবং আমাদের মধ্যেকার সম্পর্ক এখান থেকেই তো শুরু। আমরা বলেছিলাম পশ্চিমবাংলায় না হয় থাক, আমাদের মধ্যে সংগ্রাম-সংঘাত থাকতেই পারে। কিন্তু পশ্চিমবাংলা ভারতবর্ষের একটি রাজ্য মাত্র। গোটা দেশের কথা ভাবুন, জাতীয় স্বার্থের কথা ভাবুন। জাতীয় অর্থে আপনারাও একটা বিরোধীপক্ষ, আসুন সেখানে হাত মেলাই। আসুন সেখানে আমরা সমস্ত বামপন্থী রাজনৈতিক শক্তি মিলে কেন্দ্রের কংগ্রেসী সরকারের বিরুদ্ধে একটা শক্তিশালী বামপন্থী প্রতিরোধ গড়ে তুলি। এটা ছিল আমাদের আহ্বান। আমরা তাঁদের বারবার বলেছি আপনারা যদি নরসিমহা রাওয়ের বিরুদ্ধে সত্যিকারের আন্দোলন করতে চান, কেন্দ্রের কংগ্রেসী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে আপনারা যদি সত্যিই আন্তরিক হন, তাহলে অবশ্যই আমাদের মতো বিপ্লবী বামপন্থী শক্তির সাথে আপনারা হাত মেলাতে চাইবেন। কমরেডস, তাঁরা তাতে রাজি নন। তাঁরা বলছেন যে পশ্চিমবাংলায় বামফ্রন্ট সরকারের মর্যাদাটাই সবচেয়ে বড়। সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতার চেয়েও বড়। সব কিছুর থেকে বড়। আমরা বলেছি বামফ্রন্ট সরকারের মর্যাদা আপনারা নিজেরাই স্খলন ঘটাচ্ছেন – রশিদ খানের সঙ্গে যোগসাজশের মধ্যে দিয়ে, করন্দার মধ্যে দিয়ে। আপনাদের বামফ্রন্ট সরকারের মর্যাদার স্খলন যদি ঘটে তার জন্য আমরা দায়ী নই, দায়ী আপনাদের কার্যকলাপ।

কমরেডস, যখন তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন যে এখানকার যৌথ সংগ্রাম থেকে আমাদের বাদ দেবেন তখন পশ্চিমবাংলার দশটি বামপন্থী পার্টি আমাদের সঙ্গে আসেন। আমি এ ব্যাপারে খুবই খুশি হয়েছিলাম। তাঁরা বলেন যে সিপিআই(এম)-এর এই আচরণ অগণতান্ত্রিক। তাঁরা স্পষ্টভাবে প্রতিবাদ জানান এবং তাঁরা এই সিদ্ধান্তও নেন যে সেই মহামিছিলে সামিল হবেন না। বামপন্থী পার্টিগুলির এই বলিষ্ঠ ও সাহসী সিদ্ধান্তের, বামপন্থী মর্যাদার এই সিদ্ধান্তের জন্য এই মঞ্চ থেকে আমি তাঁদের সকলকে আমার বিপ্লবী অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমার খুব আফশোস রয়ে গেল যে বামফ্রন্টের মধ্যেকার কিছু শরিক পার্টি তাঁদের মেরুদণ্ড সোজা করে এই অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করার সাহস দেখাতে পারলেন না। আলাদাভাবে তাঁরা বলেন যে আমাদের এটায় ঠিক সায় ছিল না। কিন্তু তাঁরা এই ধরনের অগণতান্ত্রিক বামপন্থা-বিরোধী – বামপন্থী শক্তির ক্ষয় করবে এমন এক সিদ্ধান্তের স্পষ্ট প্রতিবাদ করতে পারলেন না। বামফ্রন্টের ভেতরে থাকতে থাকতে তাঁদের এই করুণ অবস্থা হয়েছে। যাই হোক, আমাদের পার্টি এই সংসদীয় সুবিধাবাদ, সমাজগণতন্ত্রী রাজনীতির বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। পাশাপাশি নৈরাজ্যবাদী ধারার বিরুদ্ধেও সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। এর ভিতর দিয়ে আমাদের এই পার্টিই হয়ে উঠবে ভারতবর্ষের বৃহত্তম কমিউনিস্ট পার্টি – এই বিশ্বাসে আমরা দৃঢ়।

কমরেডস, আমি আপনাদের বলতে চাই যে পথ হাজার হাজার শহীদ তাঁদের রক্ত দিয়ে সিঞ্চিত করেছেন, যে পথের নির্মাণ করেছেন, আমাদের পার্টি সেই পথেই চলছে। আমাদের পার্টির প্রতিষ্ঠাতা কমরেড চারু মজুমদারের যে আহ্বান ছিল – জনগণের স্বার্থই পার্টির স্বার্থ, আমাদের পার্টি সেই দিশা-নির্দেশ নিয়েই নিজেকে পুনর্গঠিত করে এগিয়ে চলেছে। পার্টি প্রতিষ্ঠার রজত জয়ন্তী উপলক্ষে আমি আমাদের পার্টির প্রতিষ্ঠাতা মহান নেতা কমরেড চারু মজুমদারকে সমগ্র পার্টি ও সমগ্র কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে বিপ্লবী অভিনন্দন জানিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করছি।