(২৮ ডিসেম্বর, ১৯৯২ ব্রিগেড ময়দানে ভাষণ)

“বহু বছর আগে একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম। ৭০ দশকের শেষের দিকে আমরা যখন গণ-বিচ্ছিন্নতায় ভুগছিলাম একদিন কলকাতার রাস্তায় লাখ লাখ মানুষের মিছিল দেখেছিলাম – লাল ঝাণ্ডা হাতে নিয়ে। একটা ইচ্ছে জেগে ছিল এমন দিন কী আসবে যখন আমার পার্টির নেতৃত্বে আমাদের পার্টির ঝাণ্ডা নিয়ে লাখ লাখ মানুষের মিছিল কলকাতার রাস্তায় এভাবেই যাবে। আজ সেই স্বপ্ন সফল হয়েছে।

“এই কলকাতা ১৯৭০-এর দশকে আমাদের আন্দোলন দেখেছে। তাছাড়া দেখেছে কেমনভাবে হাজার হাজার তরুণকে ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। হত্যা করা হয়েছে এই ব্রিগেড ময়দানেই কমরেড সরোজ দত্তকে নৃশংসভাবে। কমরেড চারু মজুমদারকে ঠাণ্ডা মাথায় লালবাজার পুলিশ লক-আপে হত্যা করা হল। সারা পশ্চিমবাংলা জানল, সারা দেশ জানল, সারা পৃথিবী জানল ১৯৭০-এর দশকে কলকাতায় হাজার হাজার যেসব বিপ্লবী তরুণরা জীবন দিয়েছিল তারা ছিল নকশালপন্থী। অথচ আশ্চর্যের সঙ্গে দেখলাম বামফ্রন্ট সরকার যখন ক্ষমতায় এল তাঁদের নেতারা বললেন অর্ধ-সন্ত্রাসের যুগে অর্ধ-ফ্যাসিবাদের যুগে নাকি ওঁদের ১১০০ কর্মী মারা গেছেন এবং সেটাই যেন সেই ফ্যাসিবাদের আসল অত্যাচারের কথা। শুনে আশ্চর্য হয়েছি। সিপিআই(এম)-এর বা অন্য যে সব বামপন্থী কর্মীরা সেই কংগ্রেসী সন্ত্রাসের যুগে প্রাণ হারিয়েছেন তাঁদের সকলকেই আমরা শহীদের মর্যাদা দিই। কিন্ত হাজার হাজার যে সব বিপ্লবী তরুণ জীবন দিলেন তাঁরা কিন্তু সেই সংগ্রামের অংশীদার হিসাবে সেই মর্যাদা পেলেন না। শহীদ বলে স্বীকারও করা হল না তাঁদের। আমরা দেখেছি ও ব্যাপারে তদন্তগুলো হল না। আজও সরোজ দত্তের হত্যারহস্য – রহস্যই থেকে গেল। চারু মজুমদারের হত্যারহস্য – রহস্যই থেকে গেল। আর আমরা শুনেছি ১৫ বছর ধরে নাকি এখানে একটা বামফ্রন্টের শাসন আছে। কমিউনিস্ট পার্টি শাসন চালায়। অথচ কংগ্রেসী সন্ত্রাসের যুগের সেই সমস্ত অত্যাচার ও সেই সমস্ত নেপথ্য কাহিনীগুলো আজও কেন যে নেপথ্যে থেকে গেল সে প্রশ্নের জবাব কিন্তু আমরা পেলাম না।

“১৯৭০-এর দশকে এই পশ্চিমবাংলার বুকে একটা ঝড় এসেছিল। সেই ঝড়ে অনেক কিছু পড়ে গিয়েছিল। বহু মনীষীর মূল্যায়নে আমরা একপেশেপনার শিকার হয়েছিলাম। আমরা ভুল করেছি। ক্রমে ক্রমে সে ভুল শুধরেছি। যে কোনও জাতির একটা আবেগ থাকে, একটা মর্যাদা থাকে। সেই মনীষীদের সেই সম্মান অনেক সময়ই আমরা দিতে পারিনি। সমালোচনা আমরা যা করেছি তার অনেক দিক সঠিক থাকা সত্ত্বেও তাঁদের সম্পূর্ণভাবেই নাকচ করে দেওয়ার প্রবণতাটি ছিল ভুল। হয়তো বিপ্লবী আন্দোলনের একটা জোয়ারে এভাবেই শুরু হয়ে থাকে। তবে আজ আমরা আমাদের সেই ভুলগুলো শুধরে নিয়ে পশ্চিমবাংলার বুকে আবার উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছি। আজ আজকের এই ৠালি দেখিয়ে দিচ্ছে যে আমরা পশ্চিমবাংলার বুকে আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শুরু করেছি।

“আজকের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে এবার দু-চার কথা বলব। বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে। আপনারা জানেন, এরপরে আমাদের দেশের চেহারা বিরাটভাবে বদলে গেছে। এ ব্যাপারে আমরা দেখছি, কংগ্রেস সরকার বলছে – আমরা বিজেপি-কে বিশ্বাস করেছিলাম আর এটাই ছিল আমাদের ভুল। কিন্তু এখানে একটা কথা বলার আছে। জাতীয় সংহতি পরিষদের বৈঠকে কেন্দ্রীয় সরকার কেবল একটাই প্রস্তাব দেয়। তা হল, পুরো বিষয়টা সুপ্রীম কোর্টের ওপর ছেড়ে দেওয়া যাক। এই প্রস্তাবে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়ার কোনো কথাই ছিল না। তা ঐ বৈঠকে আমাদের কমরেড জয়ন্ত রংপিও উপস্থিত ছিলেন। তিনি আমাদের পার্টির বক্তব্য সেখানে রাখেন। তিনি বলেন – রাও সাহেব, আপনি ভুল রাস্তা নিচ্ছেন। সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলোকে এভাবে তুষ্ট করে চললে তাদের মারমুখীভাব আরও বাড়তে থাকে। সমঝোতার পথ আপনি ছাড়ুন। ওদের বিরুদ্ধে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। কমরেড রংপি আরও বলেন – জাতীয় সংহতি পরিষদের উচিত রাও সরকারকে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া। কিন্তু আমাদের কমরেডের কথা সেখানে শোনা হয়নি। বরং আমরা দেখলাম, সিপিআই(এম)-এর প্রতিনিধি প্রস্তাব দিয়ে বসলেন – কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর আমাদের ভরসা আছে, সুতরাং রাও সাহেব যা করবেন আমরা তার পেছনে থাকব।

“এরপরে কী ঘটল তা তো আপনারা জানেনই। এখন নরসীমা রাও বলছেন যে আমরা বিজেপির ওপর ভরসা রেখেছিলাম কিন্তু তারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আর সিপিআই(এম) বলছে – আমরা রাও সাহেবের ওপর ভরসা করেছিলাম কিন্তু তিনি আমাদের পথে বসিয়েছেন। এইভাবে এক রাজনীতির খেলা চলছে। অনেক দ্বিধা করে কয়েকটি বিলম্বিত পদক্ষেপ নেওয়ার পর কংগ্রেস এখন বিজেপির সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে। সিপিআই(এম)ও কংগ্রেসের সঙ্গে সহযোগিতার পথ খুঁজছে। এমনকি, কংগ্রেসের সঙ্গে এক “ধর্মনিরপেক্ষ মোর্চার” কথাবার্তাও শোনা যাচ্ছে।

“আমি বলতে চাই, মোর্চা তো আপনারা বানিয়েই ছিলেন। জাতীয় সংহতি পরিষদ তো এক ধরনের মোর্চাই ছিল। ঐ মোর্চা গড়ার পরেই বা কী হল? বাবরি মসজিদের ওপর হামলা তো আপনারা রুখতে পারলেন না। তাহলে আবার ঐ একই লোকেদের সঙ্গে মোর্চা গড়ে সাম্প্রদায়িকতার ঢেউ আপনারা রুখতে পারবেন মনে করছেন?

“অবশ্য এর পাশাপাশি অন্য একটা প্রচেষ্টাও চলছে। বামপন্থীরা নিজেরা আরও ঘনিষ্ঠভাবে ঐক্যবদ্ধ হোক এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক শক্তিগুলিকে সামিল করে মোর্চা গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালাক। এই প্রচেষ্টায় আমরা অবশ্যই থাকব, সম্প্রতি গঠিত জাতীয় প্রচার কমিটিতে আমরা আছিও। কিন্তু আমরা মনে করি, কংগ্রেসকে সাথে নিয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সত্যিকারের কোনো লড়াই আদৌ লড়া যায় না।

“আসল প্রশ্নটা হল, বামপন্থার কর্তব্যটা ঠিক কী? কখনও জনতা দলের পিছনে চলার আর কখনও কংগ্রেসের পিছনে চলার সিদ্ধান্ত নেওয়াটুকুই কি একমাত্র কর্তব্য হয়ে গেছে? আমাদের পার্টির মতে, এ ব্যাপারটা এবার ছাড়া উচিত। বহুকাল থেকেই ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন তথা বামপন্থী আন্দোলন এই পাপচক্রে ঘুরপাক খাচ্ছে। আমাদের সদ্যসমাপ্ত পার্টি কংগ্রেসে আমরা এটাই বলেছি। বামপন্থীদের আজ এগিয়ে যেতে হবে এক নতুন দৃশ্যকল্প নিয়ে, এক বামপন্থী বিকল্পের ধারণা নিয়ে। আর এটাই আজকের রাজনীতির মূল কথা, আসল কথা – আমাদের সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের পার্টি কংগ্রেসে আমরা এনিয়ে আলোচনা করেছি এবং এজন্য আমরা সর্বশক্তি দিয়ে কাজ করে যাব।

“অবশ্য বাম ঐক্য গড়াটা কোনো সহজ কাজ নয়। অনেক গুরুতর ও মৌলিক বিষয়ে আমাদের মতপার্থক্য থাকায় বাম ঐক্য গড়ে তোলা বা তাকে ধরে রাখা খুবই কঠিন। তবু আমরা এদিকে এগোচ্ছি। বেশ কয়েকটি ফ্রন্টে আমরা একসাথে কাজ করছি। বিহারে আটটি বামপন্থী দল যুক্তভাবে জমি দখল আন্দোলন চালাচ্ছে। সেখানে সিপিআই আছে, সিপিআই(এম) আছে, আমরা সকলে মিলে হাজার হাজার একর উদ্বৃত্ত জমি দখল করেছি। এখন আমরা পরবর্তী স্লোগান হিসাবে ফসল তোলার আওয়াজ রেখেছি।

“একইভাবে, শ্রমিকফ্রন্টে বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়নগুলি মিলিত হয়ে ভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন সমূহের উদ্যোক্তা (স্পনসরিং) কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটির আহ্বানেই কদিন আগে দিল্লীতে হাজার হাজার শ্রমিকের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হল। এটা সত্যিই এক ইতিবাচক ঘটনা। তবু, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নামে বামপন্থী পার্টিগুলি অর্থনৈতিক ইস্যুতে সংগ্রাম কমিয়ে আনতে পারে এবং কংগ্রেসের প্রতি নরম মনোভাব নিতে পারে – এ বিপদ সর্বদাই থেকে যায়। আমাদের অবশ্যই এ ধরনের সমস্ত প্রবণতার বিরুদ্ধে সর্বদা সজাগ থাকতে হবে।

“কৃষক ও শ্রমিকদের, ছাত্র ও মহিলাদের এই ধরনের সব সংগ্রামের ভিত্তিতেই আমরা সমস্ত বামপন্থী শক্তির এক দৃঢ়, শক্তিশালী ঐক্য গড়তে চাই। ঐক্য বলতে আমরা নেতাদের মধ্যে সমঝোতা বুঝি না, নির্বাচনী আসন বা মন্ত্রীত্ব বিতরণের ফর্মুলা বুঝি না। এ ধরনের সংকীর্ণ ভাসা ভাসা ঐক্যের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। গণআন্দোলনের ভিত্তিতে ঐক্য, শ্রেণীসংগ্রামের আগুনে পোড় খাওয়া ঐক্যই আমরা চাই।

“এরকম ঐক্য গড়তে সময় হয়তো বেশি লাগবে, কিন্তু আমাদের ধৈর্য্য হারালে চলবে না। যেভাবেই হোক সাময়িক কিছু বানানোর দিকে আমরা ছুটব না। স্থায়ী ও দৃঢ় ঐক্য গড়তে প্রয়োজনীয় সময় আমাদের দিতেই হবে।

“আর একটি কথা। আমাদের পার্টি কংগ্রেস নব্বই-এর দশককে বিপ্লবী সংগ্রামের দশকে পরিণত করার ডাক দিয়েছে। আমরা বর্তমান শতকেই আমাদের দেশের চেহারায় পরিবর্তন নিয়ে আসতে চাই। আমরা চাই, আগামী শতাব্দী – একবিংশ শতাব্দীতে প্রবেশ করুক এক নতুন ভারত। এই কাজ সম্পন্ন করতে আমাদের পার্টি কমিউনিস্ট ঐক্যের কথা অর্থাৎ সমস্ত ভারতীয় কমিউনিস্টদের একটিই কমিউনিস্ট পার্টির পতাকাতলে নিয়ে আসার কথাও তুলে ধরেছে। সত্যিই তো, ভারতবর্ষে কেন এতগুলি কমিউনিস্ট পার্টি থাকবে? আমরা, ভারতের কমিউনিস্টরা, কেন একটি পার্টিতে মিলে মিশে কাজ করতে পারব না?

“কিন্তু আমরা এও জানি যে, এই লক্ষ্য তখনই অর্জন করা যাবে যখন আমরা নিজেদের ভারতের বৃহত্তম কমিউনিস্ট দলে পরিণত করতে পারব। কেবল তখনই আমরা দেশমায়ের মুখচ্ছবি পাল্টে দিতে পারব। কেবল তখনই আমরা লেনিনের স্বপ্ন – বিংশ শতাব্দীকে বিশ্বের নিপীড়িত জনগণের মুক্তির শতাব্দীতে পরিণত করার স্বপ্ন – অংশত হলেও পূরণ করতে পারব। কেবল তখনই আমরা পারব বিপ্লবের এক নতুন জোয়ার সৃষ্টি করতে, যে জোয়ার প্রবাহিত হবে গঙ্গা থেকে ভল্গার দিকে।

“অতএব আসুন, আমরা নিজেদের উৎসর্গ করি ভারতের বৃহত্তম কমিউনিস্ট পার্টি হয়ে ওঠার কাজে। বামপন্থী শক্তিগুলির দৃঢ় ও সংগ্রামী ঐক্য গড়ে তোলার কাজে। আমাদের দেশের চেহারাটাই পাল্টে দেওয়ার কাজে। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প থেকে আমাদের মহান মাতৃভূমিকে মুক্ত করার কাজে।

“আমার বক্তব্য আজকের মতো এখানেই শেষ করছি। লাল সেলাম।”