(লিবারেশন, জানুয়ারি ১৯৯৬ থেকে)

সিপিআই(এম), আরএসপি ও ফরওয়ার্ড ব্লক ছাড়াও এসইউসিআই ও পিডব্লুপি এবং আমাদের পার্টিও সম্প্রতি দিল্লীতে অনুষ্ঠিত সিপিআই-এর ষোড়শ কংগ্রেসের উদ্বোধনী অধিবেশনে উপস্থিত থাকতে এবং প্রতিনিধি অধিবেশনে বক্তব্য রাখতে আমন্ত্রিত হয়েছিল। ভারতবর্ষের বাম শক্তির ব্যাপকতর অংশই রয়েছে এই দলগুলির মধ্যে। একটি মঞ্চে এই দলগুলির মিলন তাই সংবাদমাধ্যমে এই ধারণার সঞ্চার করে যে এই দলগুলির মধ্যে পারস্পরিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বিকাশ ঘটেছে এবং কিছু সংবাদপত্রে এমনকি এই দলগুলির মধ্যে ইতিমধ্যেই কিছু বোঝাপড়া হয়ে গেছে – এমন সংবাদও প্রকাশ করে। এই বিষয়ে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক এবং অনেক কমরেডেরই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় আমাকে। এঁদের বিভ্রম দূর করতে এবং এটিকে আনুষ্ঠানিক ব্যাপার হিসাবেই চিত্রিত করতে আমি বাধ্য হই। তাঁদের উৎসাহে জল ঢেলে দিতে আমি একটু দুঃখই পেয়েছিলাম। কিন্তু, বাম ঐক্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল বিষয় যেখানে আলোচ্যবস্তু, তখন শব্দ নিয়ে খেলা করার বিলাসিতা একেবারেই চলে না।                                                      

আসুন, সিপিআই-এর কংগ্রেসে বাম ঐক্যের সামগ্রিক বিষয়টি কীভাবে আলোচিত হয়েছে দেখা যাক। ঐক্যের প্রশ্নে সিপিআই ও সিপিআই(এম)-এর মধ্যে যে তিক্ত বিতর্ক বর্তমান এবং যা প্রায়শই বুর্জোয়া সংবাদমাধ্যমে স্থান করে নেয় সে সম্পর্কে পাঠকরা বোধকরি অবগত আছেন। সিপিআই-এর মতে কোনো বুনিয়াদী পার্থক্যের ভিত্তিতে ১৯৬৪-র ভাঙ্গন ঘটেনি, কাজেকাজেই তা এড়ানো সম্ভব ছিল। এই প্রেক্ষিত থেকেই সিপিআই দুটি দলের মিলনের কথা বলে থাকে। অন্যদিকে, সিপিআই(এম) ১৯৬৪-র ভাঙ্গনের পরিপ্রেক্ষিত হিসেবে মূলত ভারতীয় রাষ্ট্রের ও ভারতীয় বিপ্লবের চরিত্রায়ন সম্পর্কে বুনিয়াদী মতপার্থক্যের উল্লেখ করে থাকে এবং এই পার্থক্য আজও বর্তমান বলেই সে মনে করে। এই পরিপ্রেক্ষিত থেকে সে সিপিআই-এর কাছে তার কর্মসূচির আমূল সংস্কারের দাবি রাখে এবং ইতিমধ্যে তার অধিকতর ক্ষমতা ও সংগঠনশক্তির জোরে সিপিআই-এর মধ্যে ভাঙ্গন ঘটিয়ে তার গণভিত্তিকে জয় করে নেওয়ার পরিকল্পনা করতে থাকে। ঝাড়খণ্ড, উত্তরাখণ্ড, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ইত্যাদির মতো আঞ্চলিক স্বায়ত্ততাবাদী আন্দোলনগুলি সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান ছাড়াও, বিভিন্ন রাজ্যে জোট বাঁধার জন্য বুর্জোয়া মিত্র বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রেও সিপিআই ও সিপিআই(এম)-এর মতপার্থক্য রয়েছে। দুই পার্টির মিলনের ব্যাপারে সিপিআই(এম)-এর অনীহার কথা মাথায় রেখে পার্টি কংগ্রেস দুই দলের মিলনের প্রস্তাবটিকে আপাতত মুলতুবি রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সিপিআই-এর সাংগঠনিক দলিল বলছে, “ইতিমধ্যে আমাদের কর্মীবাহিনীকে এই প্রশ্নে বিভ্রান্ত হতে দিলে চলবে না, কেননা সিপিআই(এম)-এর সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য রয়েছে।” রিপোর্টে “পার্টির স্বাধীন পরিচিতি ও কার্যকলাপের” ওপর এবং সিপিআই(এম)-এর সাপেক্ষে “কর্মসূচিগত ও সাংগঠনিক অবস্থান সম্পর্কে” পার্টির “নীতিনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গিকে” তুলে ধরার ওপরেও জোর দেওয়া হয়েছে। শেষমেষ একটি পার্টিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সাধু অভিপ্রায়ের চেয়ে টিকে থাকার সহজাত প্রবৃত্তিই জোরদার হয়ে দেখা দিয়েছে।

বাম ঐক্যের প্রশ্নে কংগ্রেস গোটা বিষয়টিকে আসন্ন সংসদীয় নির্বাচনের প্রয়োজনবাদী পরিপ্রেক্ষিতেই উপস্থাপিত করেছে। ফলে, বাম ঐক্যের প্রশ্নে বাগাড়ম্বর দিয়ে শুরু হয়েছিল যে পার্টি কংগ্রেস, তা শেষ হয় নির্বাচনগত দিক থেকে অধিকতর ফলপ্রসূ মুলায়ম সিং যাদবের সঙ্গে ঐক্যের অঙ্গীকারের মধ্যে।

এককথায় বলতে গেলে, আগামী সংসদীয় নির্বাচনের জন্য পার্টিকে উদ্বুদ্ধ করে তোলার লক্ষ্যে এক কসরত ছাড়া এই পার্টি কংগ্রেস আর কিছুই ছিল না। তাঁর উদ্বোধনী ভাষণে কমরেড ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত আলোচনার সুর বেঁধে দিয়ে বলেছেন, “যাঁরা বিশ্বাস করেন যে, একটি ন্যূনতম সাধারণ কর্মসূচির ওপর ভিত্তি করে কয়েকটি পার্টির মধ্যে একটি জোটের মাধ্যমে কেন্দ্রে একটি বাম-গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ সরকার শুধু কাম্যই নয়, তা বাস্তবায়িত হওয়াও সম্ভব, তাঁদের সবাইকেই তাঁদের শক্তি সমাবেশিত করতে হবে এবং ভ্রাতৃত্ববোধের ভিত্তিতে নির্বাচনী ঐক্যের প্রচেষ্টা চালাতে হবে, যে ঐক্যই কেবলমাত্র ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম। শক্তিগুলির এই বিন্যাস জনগণের, বিশেষত দরিদ্র জনগণের আকাঙ্খার এবং জাতীয় স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করবে।” কিন্তু কমরেড গুপ্তের পক্ষে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে, তাঁর নিজের দল ছাড়া অন্য কোনো বাম দলেরই এই চমকপ্রদ পরিকল্পনায় আস্থা নেই।

অবশ্য এতে নিরস্ত না হয়ে সিপিআই-এর পার্টি কংগ্রেস এগিয়ে গেছে সেই কর্মসূচি সূত্রায়নের কষ্টসাধ্য প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে, যে কর্মসূচি কিনা সমস্ত বর্ণের বাম, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির পক্ষে ন্যূনতম সাধারণ কর্মসূচি হয়ে উঠতে পারে।

জোটে গ্রহণযোগ্য গণতান্ত্রিক এবং বিশেষত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির ব্যাপ্তি নিঃসন্দেহে ব্যাপকতম। কংগ্রেসের তিওয়ারী-অর্জুন শিবির পর্যন্ত তার বিস্তার, যাঁরা কমরেড গুপ্তের ভাষায় “প্রধানমন্ত্রীর নীতিগুলি ও তাঁর কার্যধারার প্রতি একটি নীতিনিষ্ঠ চ্যালেঞ্জ” খাড়া করার কৃতিত্বের অধিকারী। পার্টি কংগ্রেসের দলিলে আত্মসমালোচনামূলক ভঙ্গিতে উত্তরপ্রদেশের বিগত নির্বাচনে সমাজবাদী পার্টি-বহুজন সমাজ পার্টির বিজয়ী জোটের শরিক হওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করার জন্য অনুতাপ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রীয়তাবাদের শিকার হয়ে জাতীয় পরিষদের উপদেশকে অবজ্ঞা করা এবং ভুল ঘোড়ায় বাজি ধরার জন্য উড়িষ্যা ও মণিপুরের রাজ্য কমিটিগুলিকে তিরস্কার করা হয়েছে। বিপরীতে বিহার ও অন্ধ্রের অনুশীলনকে সঠিক নির্বাচনী কৌশলের মডেল হিসেবে উচ্চ প্রশংসায় জর্জরিত করা হয়েছে। অবশ্য, পাটনা লোকসভার উপনির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ব্যাপারে অনমনীয় মনোভাবের জন্য বিহার রাজ্য কমিটির সমালোচনা করা হয়েছে।

তামিলনাড়ু শাখার যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রবণতায় পার্টি কেন্দ্র অবশ্যই এখনও উদ্বিগ্ন হতে পারে, কেননা ঐ শাখা ডিএমকে-র সঙ্গে মৈত্রী সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। তামিলনাড়ুতে এআইডিএমকে-ই হল শক্তিশালী দল এবং রাজনৈতিক দলিলে ইঙ্গিত রাখা হয়েছে যে পার্টি ঐ দলের পক্ষ থেকে সুবিধাজনক নির্বাচনী কৌশলের প্রতীক্ষা করছে।

এই তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির বেশ কয়েকটি বিভিন্ন রাজ্যে সরকার পরিচালনা করছে এবং সক্রিয়ভাবেই নয়া অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ করে চলেছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই, কেন্দ্রের নীতির বিরুদ্ধে গণকার্যকলাপ পরিচালনা করার কোনো আগ্রহই তাদের নেই। তাদের মধ্যে অনেকেই আবার দুর্নীতি-কেলেঙ্কারী, মাফিয়া-রাজনীতিবিদ আঁতাতকে লালন করা, জাতিগত-সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তিগুলির সঙ্গে মাখামাখি করা এবং গ্রামীণ দরিদ্র ও দলিত জনসাধারণের ওপর পুলিশী নিপীড়নকে স্থায়ী করার ব্যাপারে যথেষ্ট কুখ্যাতি অর্জন করেছে। সিপিআই-এর দলিলেও এই সমস্ত প্রশ্নে এই দলগুলি ও তাদের সরকারগুলির বিরুদ্ধে কিছু সমালোচনা রাখা হয়েছে।

সিপিআই তাহলে কিসের ভিত্তিতে আশা করে যে ঐ সমস্ত দলগুলিকে এমন এক ন্যূনতম সাধারণ কর্মসূচির ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব, যে কর্মসূচি অন্যান্য বিষয় ছাড়াও জোর দেবে সমস্ত ধরনের নিপীড়নমূলক আইন ও অর্ডিন্যান্স প্রত্যাহার, পুলিশবাহিনীর সংস্কার ও তার আমূল পুনর্বিন্যাস, সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তিগুলির বিরুদ্ধে সার্বিক প্রতিরোধ, তফশিলী জাতি ও উপজাতিদের অধিকারের সুরক্ষা, রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের সুরক্ষা, ঊর্ধ্বসীমা আইনকে সক্রিয়ভাবে কার্যকর করা, শিক্ষা ও চাকুরির অধিকারের স্বীকৃতি, কুখ্যাত দুষ্কৃতিদের নির্বাচনে প্রার্থীপদ দিতে অস্বীকার করা, কালো টাকার উদ্ধার, ইত্যাদির ওপর।

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সিপিআই যদি এই ন্যূনতম সাধারণ কর্মসূচির ব্যাপারে যথার্থই আন্তরিক হয়, তবে যে সমস্ত দল, বিশেষত যে শক্তিশালী দলগুলি সিপিআই-কে ভালো সংখ্যক আসনে জিততে সাহায্য করতে পারে তার সংখ্যার বিচারে ঐ ফ্রন্টের পরিসর একেবারেই সংকীর্ণ হয়ে পড়বে। অবশ্য পার্টি ব্যাপকতম জনগণের কাছে পৌঁছতে পারবে, যাতে কিন্তু আশু নির্বাচনী সাফল্য নাও আসতে পারে। পার্টি কংগ্রেস অবশ্য সিপিআই-এর অগ্রাধিকার সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ রাখেনি। আর তাই আমরা একমাত্র এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হতে পারি যে, ন্যূনতম সাধারণ কর্মসূচির এই কসরত নিছক লোকদেখানো ব্যাপার ছাড়া কিছুই নয়। নির্বাচনী ফায়দা এনে দিতে পারবে – এমন শক্তিশালী বু্র্জোয়া মিত্রের সন্ধানের ভিত্তিতেই এখনও ফ্রন্ট ও আঁতাত গড়া চলতেই থাকবে। ক্ষমতার অন্বেষণে পার্টি যে তার নিজের ন্যূনতম সাধারণ কর্মসূচিটিকেও শিকেয় তুলে রাখতে পারে তা তার কথাশেষের বক্তব্য থেকেই সুস্পষ্ট, “ন্যূনতম কর্মসূচিটিকে যখন পরিবর্ধিত, চূড়ান্ত ও সুনির্দিষ্ট রূপ দেওয়া হবে, তখন সেটিকে নির্দিষ্ট সময়কালের বাস্তব পরিস্থিতি ও সম্ভাবনাগুলির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে।” অন্যভাবে বলতে গেলে, ন্যূনতমটিকেও প্রয়োজনে যত খুশি কাটছাঁট করা চলবে।

এগোনো যাক। দেখা যাক এই মহান পরিকল্পনার মধ্যে আমাদের স্থান কোথায়। দলিলে বলা হয়েছে, “জাতীয় মোর্চা-বামফ্রন্ট কাঠামোর মধ্যে একটি ঐক্যবদ্ধ বাম শক্তি নির্বাচনী প্রচারে চমকপ্রদ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে এবং ঐ জোটের মধ্যে সিমেন্ট ও চুন-সুরকির কাজ করতে পারে।”

“কাজেই আসন্ন নির্বাচনী লড়াইয়ে – যা দেশের ভবিষ্যতের পক্ষে অতীব গুরুত্বপূর্ণ – বামেদের অবস্থানকে শক্তিশালী করে তুলে এসইউসিআই, সিপিআই(এমএল), মার্কসিস্ট কো-অর্ডিনেশন কমিটি ইত্যাদির মতো দলগুলিকে সিপিআই, সিপিআই(এম), ফরওয়ার্ড ব্লক ও আরএসপি-র সাথে হাত মেলাতে রাজি করানোর জন্য সমস্ত ধরনের প্রয়াস চালানোটা জরুরি। বামফ্রন্ট সরকারের প্রতি তাদের বিদ্বেষ পরিত্যাগ করতেও তাদের রাজি করাতে হবে।”

কাজেই বাম ঐক্যের গোটা অনুশীলনটাই পর্যবসিত হচ্ছে জাতীয় মোর্চা-বামফ্রন্ট কাঠামোর – স্পষ্টতই সিপিআই নির্ধারিত কাঠামোর – অন্তর্ভুক্ত হয়ে কাজ করতে এবং বামফ্রন্ট সরকারের প্রতি ‘বিদ্বেষ’ পরিত্যাগ করতে আমাদের ‘রাজি’ করানোর একমুখীন কর্মধারায়।

খুব কম করে বললেও, সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতেই এক বড়দাসুলভ মনোভাব প্রকট, যা তারা তাদের পূর্বতন সোভিয়েত প্রভুদের কাছ থেকে অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে রপ্ত করেছে। আমাদের অবস্থানের কোনো মূল্যায়ন নেই এবং পার্থক্যগুলিকে স্বীকার করে ঐক্যের জায়গাগুলি অন্বেষণের কোনো প্রয়াসও নেই। অথচ সেটাই ঐক্যের প্রশ্নে একমাত্র মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি হতে পারে। সিপিআই(এম)-এর দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে এর একমাত্র পার্থক্য হল, ‘চাপিয়ে দেওয়ার’ বদলে ‘রাজি করানো’। এই উভয় দৃষ্টিভঙ্গিকেই আমরা যথাযোগ্য ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করি।

বামফ্রন্ট সরকারের প্রতি ‘বিদ্বেষ’ সম্পর্কিত এই সমস্ত অর্বাচীন কথাবার্তার অর্থ কী? এটা তাঁদের পছন্দ না হতে পারে, কিন্তু বামফ্রন্ট সরকারের প্রতি আমাদের একটি নীতিনিষ্ঠ ও ঐতিহাসিকভাবে উদ্ভূত বিপ্লবী বাম বিরোধীপক্ষের অবস্থান রয়েছে। এই প্রশ্নে পার্থক্যগুলির সমাধান কেবলমাত্র নীতিনিষ্ঠ বিতর্কের মাধ্যমে এবং রাজনৈতিক বিকাশের প্রক্রিয়াতেই সম্ভব। কোনো সদাশয় বড়দার কোনো ধরনের সমঝানোতেই ঐ সমস্যার সমাধান হতে পারে না। সিপিআই(এম) এবং বামফ্রন্ট সরকারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে ‘বিদ্বেষ’ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। কেননা যেখানেই এবং যখনই সম্ভব আমরা সিপিআই(এম)-এর সঙ্গে সহযোগিতা করতে দ্বিধা করিনি। এমনকি বামফ্রন্ট সরকারের ক্ষেত্রেও কংগ্রেস(ই)-বিজেপির চক্রান্তের বিরুদ্ধে তাকে সমর্থন করার প্রশ্নে আমরা কখনই দ্বিধান্বিত হইনি। উন্মত্ত বিদ্বেষ আসলে আমাদের প্রতি সিপিআই(এম)-এর দৃষ্টিভঙ্গিরই বৈশিষ্ট্য। সিপিআই বাম ঐক্যের স্বার্থ অনেক ভালোভাবে সিদ্ধ করতে পারবে যদি তার সমঝানোর দক্ষতা সে সিপিআই(এম)-এর ওপরেই কাজে লাগায়।

সিপিআই কংগ্রেসে তাঁর ভাষণে কমরেড নাগভূষণ পট্টানায়ক স্পষ্টভাবেই বলেছেন যে বাম ঐক্য এবং সংসদসর্বস্বতার সহাবস্থান অসম্ভব।

আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, প্রথমত ঐক্যবদ্ধ বামেদের জাতীয় মোর্চা-বামফ্রন্ট কাঠামোর অঙ্গীভূত হওয়া উচিত নয়, যা কেন্দ্রে এক জোট সরকারের লক্ষ্যে পরিচালিত। ঐ ধরনের যে কোনো সরকারের থেকেই তাকে দূরে থাকতে হবে, বড় জোর তা এক কংগ্রেস-বিরোধী বিজেপি-বিরোধী জোটের প্রতি সমালোচনামূলক সমর্থন জানাতে পারে। এর অর্থ বামেদের এক সাধারণ কর্মসূচিকে যতদূর সম্ভব রূপায়িত করার জন্য ঐ ধরনের সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। সমালোচনামূলক দিকটিকে অবশ্য সক্রিয় হতে হবে এবং ১৯৮৯ সালের বামেদের ভূমিকার পুনরাবৃত্তি ঘটলে চলবে না।

বর্তমান পর্যায়ে বাম ঐক্য কেবলমাত্র এক মহাজোটের চরিত্র নিয়েই রূপ পরিগ্রহ করতে পারে, যেখানে প্রতিটি দলেরই বিভিন্ন রাজ্যে তাদের নিজস্ব কৌশলগত লাইন অনুসরণের স্বাধীনতা থাকবে। সিপিআই যখন জোর দিয়ে বলে যে ১৯৬৪-র ভাঙ্গনকে সিপিআই(এম) নেতৃত্ব এড়াতে পারত, তখন সে খুব একটা ভুল বলে না। ১৯৭৭ সাল থেকে দীর্ঘ ১৮ বছর যেভাবে তারা একসঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে চলেছে – প্রতিটি স্তরে তারা সমন্বয়ী কমিটি বানিয়েছে এবং কখনও সখনও রাজ্যবিশেষে মিত্র বেছে নেওয়ার ব্যাপারে মতপার্থক্য বা আসনের বখরা নিয়ে বাদানুবাদ সত্ত্বেও মোটামুটি একই কৌশলগত লাইন অনুসরণ করে চলেছে – তাতে বুনিয়াদী মতপার্থক্যের অনেকটা বনিয়াদই ধ্বসে গেছে। তাছাড়া, মুলায়ম সিং, লালু যাদব বা চন্দ্রবাবুর মতো শক্তিশালী বুর্জোয়া মিত্রদের সমালোচনাহীন সমর্থনের যে ঐতিহ্য সিপিআই-এর ছিল, সিপিআই(এম) তা আত্মসাৎ করে নিয়েছে, উভয়ই একই সুরে জাতীয়তাবাদী বুলি আওড়ায়, গ্রামীণ দরিদ্রদের জঙ্গী সংগ্রামের প্রতি উভয়েরই প্রবল অনীহা এবং উভয়েই একনিষ্ঠভাবে কুলাকদের সঙ্গে সম্পর্কের বিকাশ ঘটায় ও নির্বাচনে বিজয়লাভের জন্য প্রয়োজনীয় জাতিভিত্তিক সমীকরণের আশ্রয় নেয় – এই পরিপ্রেক্ষিতে তাদের মধ্যে মিলন এক যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত প্রস্তাব।

সিপিআই(এম) তার ১৯৬৪-র শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের অবস্থান থেকে অর্ধেক এগিয়ে বুর্জোয়াদের শক্তিশালী অংশের সাথে যৌথভাবে সংস্কারের পথে চলেছে। অন্যদিকে সিপিআই সোভিয়েতের পতন ও নয়া বিশ্বব্যবস্থার যুগে তার অ-একচেটিয়া বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে জাতীয় গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার অবস্থান থেকে অর্ধেক পথ পিছিয়ে এসেছে। নেহরু ও তার সমাজতন্ত্র অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে এবং তার ঐ তত্ত্বের আর সমর্থক মিলছে না।

সিপিআই ও সিপিআই(এম) মিলনের দিকে যাক বা না যাক ১৯৬৪-র ভাঙ্গনের ঐতিহাসিক তাৎপর্য কখনই মুছে দেওয়া যাবে না, কেননা কারুরই বিস্মৃত হওয়া উচিত নয় যে বিপ্লবী কমিউনিস্টরাও ১৯৬৪-র ভাঙ্গনে এক শক্তিশালী অংশ ছিলেন, যে ভাঙ্গন যথাযথ পরিণতি লাভ করে ১৯৬৭ সালে।

এখন লাখ টাকার প্রশ্ন হল – সিপিআই নিজে কতটা ঐক্যবদ্ধ? পার্টি কংগ্রেসের ঠিক আগেই সিপিআই-এর প্রবীণ তাত্ত্বিক চতুরানন মিশ্র তাঁর অন্যতম বিতর্কিত প্রবন্ধে লেখেন, এক শক্তিশালী অর্থনৈতিক শক্তি হয়ে ওঠার জন্য ভারতবর্ষের বিদেশী সাহায্যের প্রয়োজন, আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য উন্নত দেশগুলির প্রয়োজন ভারতের বাজার। কাজেই, “এটা সাম্রাজ্যবাদের কাছে ভারতের আত্মসমর্পণ নয়, এটা হল সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতবর্ষের মিলন বিন্দু”। তিনি আরও লেখেন, “ভারতীয় রাষ্ট্র এখনও বৈদেশিক চাপের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। দিল্লীতে জোট নিরপেক্ষ দেশগুলির সম্মেলনে বৈদেশিক বাণিজ্যের সঙ্গে সামাজিক ধারার সংযুক্তির বিরোধিতা করার মধ্যে তা প্রতীয়মান হয়”। “মারাকাংশ বিশ্বব্যাঙ্ক এবং আইএমএফ-এর সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে ভারত বিরোধীর ভূমিকা রাখে। অস্ত্র সম্বরণ চুক্তি ও ক্ষেপণাস্ত্রের প্রশ্নে ভারত মার্কিনের চাপের প্রতিরোধ করে আসছে”। “এমন একটা মনোভাব গড়ে উঠছে যে বর্তমান সরকারের পরিচালনাধীনে ভারত বিদেশী চাপের কাছে নতিস্বীকার করছে। প্রকৃত ঘটনা হল অনেক ক্ষেত্রেই বিদেশী চাপের বিরোধিতা করা ভারতের পক্ষে কষ্টকর হচ্ছে”।

সিপিআই কংগ্রেস নরসীমা রাও সরকারের এই নির্লজ্জ সমর্থনকে প্রত্যাখ্যান করেছে, এটাই পার্টি কংগ্রেসের ইতিবাচক দিক যা পার্টিকে কংগ্রেসের কোলে ফিরে যাওয়া থেকে প্রতিহত করেছে। কিন্তু কিসের মূল্যে, তা কেবল ভবিষ্যতই বলতে পারে।

১৯৯৩-এ একবার সিপিআই-এর এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা আমাকে বিদ্রুপের সুরে বিহারে আমাদের বিধায়কদের দলত্যাগের কারণ জিজ্ঞাসা করেন। উত্তরে আমি বলি যে, ব্যক্তিগত লাভের আকাঙ্খা এবং তার সঙ্গে পশ্চাদপদদের জনতা দলের দিকে মেরুকরণ ঘটাই মতাদর্শগত দিক থেকে দুর্বল ব্যক্তিদের দলত্যাগে প্ররোচিত করে থাকবে। আমি জোর দিয়েই বলি যে বিহারে আমাদের পার্টির নেতৃত্ব অটুট রয়েছে এবং ঐ সমস্ত বিধাকদের কেউই গুরুত্বপূর্ণ পার্টি দায়িত্বশীল ছিল না। সন্তুষ্ট না হয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন, “ব্যক্তিগত লাভের আকাঙ্খায় কমিউনিস্টরা বিচ্যুত হয় কীভাবে, আমাদের বিধায়কদের দেখুন”। তিনি আমাকে গভীর অনুসন্ধানের পরামর্শ দেন। আমি চুপ করে থাকাই শ্রেয় মনে করি। পরিহাসের বিষয় হল, পরদিনই সংবাদপত্রে দেখা গেল উত্তরপ্রদেশে সিপিআই-এর রাজ্য সম্পাদক তথা বিধায়ক মুলায়ম সিং-এর দলে ভিড়েছেন। আরও একজন বিধায়ক শীঘ্রই একই পথ অনুসরণ করলেন। অতএব আমি সাগ্রহে সিপিআই-এর কংগ্রেসের দলিলে ঐ বিষয়ে এক গভীর অনুসন্ধানের অপেক্ষা করছিলাম। দলিলে বলা হয়েছে যে ব্যক্তিগত লাভের কারণেই তাঁরা দলত্যাগী হয়েছেন। এরপর দলিলে বিষয়টিকে সাধারণীকরণ করে বলা হয়েছে যে দলত্যাগের ঘটনা শুধুমাত্র সিপিআই-এর ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, অন্যান্য অনেক রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রেও তা ঘটেছে। অনেক ধর্মনিরপেক্ষ দলও ভাঙ্গনের মুখোমুখি হচ্ছে। “সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতার যে ধারা প্রবহমান, সেই প্রেক্ষাপটেই বিষয়টিকে উপলব্ধি করতে হবে”। তা বেশ, কিন্তু আপনাদের মতো কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষেত্রে তা ঘটে কীভাবে? রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রবণতার পিছনে কি কোনো সামাজিক যৌক্তিকতা নেই? পার্টি কংগ্রেসের দলিলে অবশ্যই পার্টির মধ্যে জাতিগত মতাদর্শের প্রভাব ইত্যাদির বিরুদ্ধে লড়াই-এর কথা বলা হয়েছে, কিন্তু পশ্চাদপদদের মধ্যে সুবিধাভোগী স্তর ও অন্যান্যদের মধ্যে কোনোরকম পার্থক্যকীকরণ করতে একেবারে অস্বীকার করে পার্টি কি লোহিয়াপন্থীদের জাতিগত মতাদর্শের কাছে আত্মসমর্পণ করেনি? আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর মেলেনি। আর ঐ ধরনের দলত্যাগ রোধে পার্টির পরিকল্পনা কী? তা, উত্তরপ্রদেশ থেকে পার্টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে শিক্ষা গ্রহণ করেছে তা হল, মুলায়ম সিং-এর সঙ্গে জোট বাঁধার ক্ষেত্রে তার ব্যর্থতা। এর থেকে সারকথা যা বেরিয়ে আসে তা হল : অল্প কয়েকজনের দলত্যাগ প্রতিরোধ করতে গোটা পার্টিটাকেই দলত্যাগী করে দাও। বিহারে এই কৌশল যথেষ্ট ফলদায়ক হয়নি কি?