[সিপিআই(এমএল) নিউ ডেমোক্রেসী কর্তৃক সংগঠিত ১৯৯৩ সালের ১৪ অক্টোবর ডাঙ্কেল প্রস্তাব সম্পর্কিত কনভেনশনে প্রদত্ত অভিভাষণ – লিবারেশন, নভেম্বর ১৯৯৩ থেকে]

প্রথমেই আমি এই কনভেনশনের উদ্যোক্তাদের এক প্রয়োজনীয় ও সময়োপযোগী উদ্যোগ গ্রহণের জন্য অভিনন্দন জানাই।

প্রায় দু-বছর ধরে ডাঙ্কেল প্রস্তাবকে ঘিরে নানা আলাপ-আলোচনা চলছে এবং এ বছরের মধ্যেই প্রস্তাবটি গ্যাট কর্তৃক অনুমোদিত হবে বলে মনে হয়।

উরুগুয়ে পর্যায়ের আলোচনাগুলির প্রাথমিক পর্যায়ে ভারত সরকার কট্টর দরকষাকষির এক অবস্থানকে হাজির করার চেষ্টা করে। পরবর্তীতে প্রস্তাবের দুটি-একটি ধারার ক্ষেত্রে ছোটোখাটো কিছু সুবিধা আদায়ের মাধ্যমে অবস্থানটিকে আরও নরম করে নেওয়া হয়। আর এখন তো মনে হচ্ছে সরকার অবিকল প্রস্তাবটিতেই স্বাক্ষরদানের জন্য প্রস্তুত।

শুরুতে প্রস্তাবের সম্ভাব্য অনুমোদনকে পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতা বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। এখন ভারত কী কী সুবিধা ভোগ করতে পারে তার ফিরিস্তি দেওয়া হচ্ছে।

কেউ কেউ তো এমন কথাও বলছে যে ডাঙ্কেল প্রস্তাবে নাকি পশ্চিমী দেশগুলির বিরুদ্ধেই রসদ ঠাসা আছে। যারাই প্রস্তাবের বিরোধিতা করছেন তাঁদের নির্বোধ বলে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে এবং আরও অনেক কিছুই বলা হচ্ছে।

চাষিদের সেই অংশটা যারা বহুজাতিক সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে আশু কিছু অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা হাতিয়ে নিতে পারে তাদের প্রতিনিধিত্বকারী এক চাষি সংগঠন ডাঙ্কেল প্রস্তাব মেনে নেওয়ার দাবিতে রাস্তায় নেমে পড়েছে। কিছু কিছু নিকৃষ্ট মার্কসবাদী ‘মুক্ত বাজার’ ও ‘মুক্ত বাণিজ্য’র কথা বলে দু-হাত তুলে ডাঙ্কেলের গুণকীর্তন করছে। কোনো কোনো বুর্জোয়া ভাঁড় ঐ প্রস্তাবের ‘অজ্ঞ’ বিরোধিতাকারীদের শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে ডাঙ্কেলের সহজ পাঠ ছেপে বার করে ফেলেছেন।

যাই হোক, ডাঙ্কেল একটা ভালো কাজ করেছে। নয়া বিশ্বব্যবস্থার প্রামাণ্য মুখ্য দলিল হিসেবে এটি বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এক বড় পরিমাপের বিতর্ককে জাগিয়ে তুলেছে। ক্রমে বিতর্কটি গড়াতে গড়াতে কৃষক জনগণের মধ্যে নেমে এসেছে। তাঁরা ডাঙ্কেলের ক্ষতিকারক ফলাফল সম্পর্কে উত্তরোত্তর সচেতন হয়ে উঠছেন। বহুজাতিকদের কাজ-কারবারের বিরুদ্ধে কৃষকদের জঙ্গী প্রতিবাদের মধ্যে সজাগতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে – যার একটি আমরা কর্ণাটকে নানজুন্দাস্বামীর সংগঠনের মধ্য দিয়ে প্রত্যক্ষ করেছি। ডাঙ্কেল চাচা মণ্ডল ও কমণ্ডল-এর কবল থেকে মধ্য কৃষক ও সম্পন্ন চাষিদের বেরিয়ে আসতে সাহায্য করছে।

চাষিদের সংগঠনগুলির সমন্বয়ের (co-ordination) মধ্যে আবশ্যকীয় ও ইতিবাচক ভাঙ্গনের পর তাদের একটি শক্তিশালী অংশ এখন বামদের, বিশেষ করে বিপ্লবী বামদের, স্বাভাবিক মিত্র বলে মনে করছে। এই সমস্ত বিকাশের জন্য আমাদের কি ডাঙ্কেলকে ধন্যবাদ জানানো উচিত নয়?

মাসখানেক আগে আমি সানডে পত্রিকায় মণিশংকর আয়ারের ডাঙ্কেলের সহজ পাঠ পড়ছিলাম – যেখানে তিনি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ সরস ও উদ্ধত ভঙ্গিতে ডাঙ্কেলের সমালোচকদের বেশ করে নিন্দামন্দ করেছেন। তা যাই হোক, আমার মনে হল আমাদের মধ্য থেকেও যদি কেউ আমাদের কৃষকদের আরও ভালো উপলব্ধির জন্য জনপ্রিয় ভাষায় এক পুস্তিকা লেখেন তাহলে খুব সুন্দর হয়। আমার জানা নেই হয়তো ইতিমধ্যই এ কাজ হয়ে গিয়ে থাকবে, নতুবা, কেউ না কেউ এই কাজে হাত লাগিয়েছেন।

ডাঙ্কেল প্রস্তাবের বিভিন্ন দিক নিয়ে অনেক কথাই বলা হয়েছে বা লেখা হয়েছে এবং এখানে কমরেড যতেন্দ্র ইতিমধ্যেই বিস্তৃত ব্যাখ্যা রেখেছেন। আমি বরং সামান্য কয়েকটি বিষয়েই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখব।

১। বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতি যেহেতু বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলির আধিপত্যাধীন, তাই এক নয়া বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। সোভিয়েত ব্লকের পতনের পর এই প্রক্রিয়াটি আরও জোরদার হয়েছে। স্বভাবতই, আইএমএফ, বিশ্ব ব্যাঙ্ক ও গ্যাটের মতো প্রতিষ্ঠানগুলিও এক নতুন ও আক্রমণাত্মক চেহারা নিতে সচেষ্ট। বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলির স্বার্থে জাতীয় সীমারেখাগুলি মুছে ফেলার প্রচেষ্টা চলছে। এই লক্ষ্যেই অসম দেশগুলির মধ্যে বাণিজ্যের সমশর্তকে বলবৎ করার জন্য ডাঙ্কেল প্রস্তাব মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করছে।

২। ভারতের মতো দেশে উন্নয়নের কর্মসূচি রচনায়, বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলি অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াকে দিশা প্রদান করবে উপর থেকে আর নীচের থেকে উন্নয়ন প্রকল্পগুলি হাতে নিয়ে, কাঙ্খিত আধুনিকতার দিকে জনসাধারণকে প্রস্তুত করে তোলার কাজটি চালিয়ে যাবে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলি। সরকারের ভূমিকা হয়ে দাঁড়াবে নিছক মধ্যস্থতাকারীর আর শাসক রাজনীতিবিদরা কমিশনভোগী, উৎকোচভাগী ও দালালে পরিণত হবে। এটিই হল নয়া উপনিবেশবাদের নির্দিষ্ট পরিকল্পনা – যা ইতিমধ্যেই আমরা লাতিন আমেরিকায় প্রত্যক্ষ করেছি। সেদিন আর দূরে নয় যখন দেখা যাবে মন্ত্রী আর সরকারি কর্তাব্যক্তিরা চোরাচালান আর মাদক পাচারে যুক্ত হয়ে পড়েছে।

সবশেষে এটি আমি স্পষ্ট করে দিতে চাই যে ভারতকে যদি Banana Republic-এ পর্যবসিত করার উদ্যোগ-আয়োজন চলতে থাকে তাহলে জনগণের রণাঙ্গনগুলি ও গেরিলাবাহিনীও দূরের বস্তু হয়ে থাকবে না।