(লিবারেশন, জানুয়ারি ১৯৯৯ সংখ্যায় কমরেড বিনোদ মিশ্রের শেষ লেখা)

পরিবর্তনশীল আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল

এই চরম অনিশ্চয়তার যুগে আরও একটি আলোড়নময় বছর ছিল ১৯৯৮। কিন্তু গভীর অনুসন্ধান করলে এই বিরাজমান বিশৃঙ্খলার মধ্যেও এমন কিছু অন্তঃসলিলা ধারা দেখতে পাব যেগুলি নতুন শতকের মোড় নেওয়ার সাথে সাথে বড় বড় অভ্যুত্থানে ফেটে পড়তে পারে।

এই সেদিন পর্যন্ত বিশ্বায়নের প্রবক্তারা বুক বাজিয়ে বলেছিল যে পুঁজিবাদের ‘স্বর্ণযুগ’ অবশ্যই স্থায়ী হবে। তারা দাবি করেছিল, বিশ্ব অর্থনীতির তাবৎ সমস্যার সমাধান নাকি তাদের হাতের মুঠোয় রয়েছে। কিন্তু ১৯৯৮ এই সমস্ত কিছুকেই উল্টে দিয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার “শার্দুল অর্থনীতিগুলির” পতন এবং সংকট দ্রুতই লাতিন আমেরিকায় সম্প্রসারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আতঙ্কের ঘণ্টা বেজে উঠেছে। বিশ্বব্যাপী মন্দার আশঙ্কা ক্রমশই প্রকট হয়ে উঠেছে। আইএমএফ ও বিশ্ব ব্যাঙ্কের হতবুদ্ধিগ্রস্ত নীতিনির্ধারকরা আর আগের মতো আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে প্রেসক্রিপশন হাজির করতে পারছেন না। অর্থনীতির এই বেহাল অবস্থার কোনো কিনারা করতে না পারায় সমাধান সূত্রও অধরা থেকে যাচ্ছে। বিশ্বের নিয়ন্ত্রণ কর্তারা বিভিন্ন বিকল্প ব্যবস্থারই ইঙ্গিত দিচ্ছেন, যার মধ্যে আর্থিক পরিকল্পনায় রাষ্ট্রের বর্ধিত ভূমিকার কথাও রয়েছে। কিছুদিন আগেও নয়া উদারনীতিবাদের কট্টর প্রবক্তাদের কাছে এটা ছিল একেবারে নিষিদ্ধ বিষয়। বিগত প্রায় এক দশক কালের প্রথাকে ভেঙ্গে এই বছর অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় দার্শনিক অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনকে, যিনি ‘পরিস্থিতি বিগড়ে যাওয়া’ ঠেকাতে ধনী ও দরিদ্র উভয়েরই সুরক্ষা ব্যবস্থার ওকালতি করেছেন। আমরা জানি না, ৩০ দশকের ভূত দেখে এবং তার আগাম প্রতিকার ব্যবস্থা হিসাবেই নোবেল কমিটি কেইনসের এই তৃতীয় বিশ্বের অবতারকে তুলে ধরেছেন কিনা!

বিশ্বায়নের প্রকল্পটি এইভাবে ধাক্কা খাওয়ার পর বিশ্বের মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডল ফের পরিবর্তিত হতে শুরু করেছে। বর্তমানে অবশ্য মার্কসবাদী চিন্তাধারার সমাজগণতান্ত্রিক ব্যাখ্যাই প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। কিন্তু সংকট গভীরতর হয়ে ওঠা এবং বিশ্বের সর্বত্র যুব সম্প্রদায় ও শ্রমিকশ্রেণীর ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক ভূমিকা বিপ্লবী মার্কসবাদের শক্তিগুলির পুনরায় সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার পক্ষে অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।

বর্তমান জাতীয় পরিস্থিতিতে বামদের দুই কৌশল

অলীক স্থায়িত্বের নাগাল পাওয়ার লক্ষ্যে এই বছরের গোড়ায় মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু তারপর আট মাসও পার হয়নি, এর মধ্যেই রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে দেখা যাচ্ছে আর একটি মধ্যবর্তী নির্বাচনের সম্ভাবনা। যুক্তফ্রন্টের জগাখিচুড়ি জোটকে উপহাস করেছিল যে বিজেপি, সে কিন্তু আরও নিকৃষ্ট জোটের ওপর ভর করেই ক্ষমতায় আরোহন করে। তার ‘স্থায়ী সরকার ও দক্ষ নেতা’র স্লোগান বছরের সবথেকে বড় তামাশা হিসােব পরিগণিত হয়েছে। সোনিয়া গান্ধীর নেতৃত্বে পুনরুজ্জীবিত কংগ্রেসের হাতে শাসক জোটের পতনের উপক্রম হয়েছে। একইসঙ্গে ‘তৃতীয় শক্তিগুলি’কেও প্রান্তসীমায় ঠেলে দিয়েছে কংগ্রেস, একসময় যার বিপর্যয়ের বিনিময়েই তৃতীয় শক্তির অগ্রগতি হয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে বামদের গ্রহণীয় কৌশল সম্পর্কিত বিতর্ক আবার সামনে এসে গেছে।

যুক্তফ্রন্টের পতন এবং বিজেপির ক্ষমতায় আরোহনের সঙ্গে সঙ্গেই বামদের মধ্যকার সুবিধাবাদী অংশটি অবস্থান পাল্টায় এবং কংগ্রেসের সঙ্গে আঁতাতের ওকালতি শুরু করে। এমনকি নির্বাচনী ফলাফল সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত হওয়ার আগেই সুরজিৎ সরকার গঠনে এগিয়ে আসার জন্য কংগ্রেসকে উস্কানি দিতে থাকেন। সম্ভাব্য কংগ্রেস সরকারের জন্য প্রদত্ত সমর্থনকে সিপিআই(এম) কৌশলগত পদক্ষেপ হিসাবে ব্যাখ্যা করলেও, পরবর্তীতে দুই দলের মাখামাখি এবং সিপিআই(এম) তাত্ত্বিকবাহিনী বিষয়টিকে যেভাবে চিত্রিত করে, তার থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে দুই দল এক রণনীতিগত সহযোগিতার লক্ষ্যেই এগিয়ে চলেছে। সিপিআই ও সিপিআই(এম) উভয়েরই পার্টি কংগ্রেসে ব্যাপক সংখ্যক প্রতিনিধি নেতৃত্বের এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করেন, এমনকি সিপিআই(এমএল)-এর মতো শক্তিগুলিকে নিয়ে তৃতীয় শক্তি গড়ে তোলার আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়। কিন্তু মনে হচ্ছে নেতৃত্ব তাঁদের পুরোনো পথে চলতেই বদ্ধপরিকর। যুক্তফ্রন্ট যখন ক্ষমতায় ছিল তখনই, ১৯৯৭-এর অক্টোবরে অনুষ্ঠিত আমাদের ষষ্ঠ পার্টি কংগ্রেসে আমরা বলেছিলাম – “বর্তমান জাতীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আমাদের অবশ্যই বিজেপি-বিরোধী ও কংগ্রেস-বিরোধী দিশায় অবিচল থাকতে হবে। অবশ্যই আমরা ভারতবর্ষের গৈরিক অধিগ্রহণের বিপদকে স্বীকার করি এবং সেই ধরনের পরিণতি এলে বিজেপি-বিরোধী মহাজোট গঠনের জন্য আমাদের কিছু কর্মনীতিগত রদবদল করতে হতে পারে। তবে এই ধরনের রদবদলকে অবশ্যই তিনটি মৌলিক মানদণ্ডের চৌহদ্দির মধ্যে থাকতে হবে : (১) পার্টির স্বাধীনতা ও উদ্যোগকে বজায় রাখতে হবে; (২) যে কোনো বিজেপি-বিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক মহাজোট থেকে কংগ্রেসকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে; (৩) অ-বিজেপি, অ-কংগ্রেসী যে কোনো সরকারের সমস্ত জনবিরোধী নীতির বিরোধিতা আমরা চালিয়ে যাব।”

এটাই হত বিপ্লবী সর্বহারা পার্টির একমাত্র সঠিক নীতি এবং আমাদের পার্টি ধারাবাহিকভাবে তা অনুসরণ করে গেছে।

পুনরুজ্জীবিত কংগ্রেস কয়েকটি প্রতিষ্ঠিত মধ্যপন্থী পার্টির অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলেছে ফলে তারাও এখন কংগ্রেসের বিরুদ্ধে খুব সরব হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বিধানসভার নির্বাচনী ফলাফল বিশ্লেষণ করে কেউ কেউ বলছেন সমগ্র রাজনৈতিক ক্ষেত্রটিই কংগ্রেস ও বিজেপি এই দুই মেরুর মধ্যে বিভাজিত হয়ে গেছে। ফলে তৃতীয় শক্তির ধারণাটিই আজ অপ্রাসঙ্গিক। এই অভিমত সংকটগ্রস্ত তৃতীয় শিবিরকে আতঙ্কিত করে তুলেছে এবং মূলত যুক্তফ্রন্টের পুরোনো শরিকদের নিয়েই জোড়াতালি দিয়ে এক তৃতীয় শিবির গঠনের প্রচেষ্টা জোরদার হয়েছে। আজকের নির্দিষ্ট অবস্থায় ঐ ধরনের যুক্তফ্রন্ট গঠনের একমাত্র উদ্দেশ্য হল কংগ্রেসের সাপেক্ষে তাদের দরকষাকষির সামর্থ্য বাড়িয়ে নেওয়া।

আমাদের পার্টি ঐ ধরনের প্রচেষ্টার শরিক হতে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে। বুর্জোয়া বিরোধীপক্ষের দলগুলির সঙ্গে সংসদ ও বিধানসভার অভ্যন্তরে বোঝাবুঝি এবং নির্দিষ্ট সময় ও পরিস্থিতিতে এমনকি তাদের সঙ্গে সাময়িক কৌশলগত আঁতাতও অনুমোদনযোগ্য। কিন্তু তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ অথবা তৃতীয় ফ্রন্টের মধ্যে তাদের সঙ্গে সমালোচনাহীন রণনৈতিক জোটে যুক্ত হওয়াটা বিপ্লবী কমিউনিস্টদের কৌশল হতে পারে না। সিপিআই দীর্ঘদিন ধরেই ‘জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট’-এর সন্দেহজনক তত্ত্বের আড়ালে ঐ ধরনের কৌশল অনুসরণ করে এসেছে এবং জাতীয় বুর্জোয়ার অন্বেষণ করতে গিয়ে সে কংগ্রেসের কোলে ঢলে পড়েছে। ফলে কংগ্রেস যেখানে এখনও যথেষ্ট শক্তিশালী, সিপিআই সেখানে দ্রুতই জাদুঘরের দ্রষ্টব্যে পরিণত হচ্ছে। আর তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ ফ্রন্টের মাধ্যমে ‘জনগণতান্ত্রিক ফ্রন্ট’-এ পৌঁছানের সিপিআই(এম)-এর সূত্রায়ন ঐ দলকেও কংগ্রেসের কবলে ঠেলে দিচ্ছে। এই পরিণতি খুবই স্বাভাবিক, কেননা ধর্মনিরপেক্ষ ফ্রন্টই যখন আপনার কৌশলের শেষ কথা হয়ে দাঁড়ায়, তখন কংগ্রেস ছাড়া কেই বা আপনার স্বাভাবিক মিত্র হতে পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রে সিপিআই-এর পরিণতি থেকেও রেহাই পাওয়ার রাস্তা নেই।

এর বিপরীতে আমরা জনগণতান্ত্রিক ফ্রন্টের কেন্দ্র হিসাবে এক বাম মেরু গড়ে তুলতে চাই। আর সেজন্যই আমরা এক বাম মহাজোটের ডাক দিয়েছি, যা গঠিত হবে কমিউনিস্ট ও সমাজতন্ত্রী ছাড়াও নতুন সামাজিক আন্দোলনে বিভিন্ন বাম ঝোঁক সম্পন্ন শক্তিগুলি সহ বিপ্লবী গণতন্ত্রের সমস্ত শক্তিগুলিকে নিয়ে। বিপ্লবী গণতন্ত্রের শক্তিগুলি তৃণমূল থেকে উঠে আসছে – সংসদবাদের চৌহদ্দির মধ্যে কদাচিৎ তাদের দেখা মিলবে। তাছাড়া, তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলির মধ্যে সকলে গণতান্ত্রিক নয়; অনেক ক্ষেত্রেই সেগুলি চরম দক্ষিণপন্থী শক্তি। সুবিধামতো তারা রং পাল্টে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অনুকূলে ঢলে পড়ে। ১৯৮০-র দশকে ও ১৯৯০-এর দশকের গোড়ায় কংগ্রেস এবং গত বছরে চন্দ্রবাবু নাইডু এটাই করেছিল।

যুক্তফ্রন্টের অগৌরবজনক পতনের পর আমরা সিপিআই(এম) ও সিপিআই-এর কাছে পুনরায় বাম মহাজোটের প্রস্তাব রাখি। কিন্তু তাদের নেতৃত্ব সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। এটা অপ্রত্যাশিত ছিল না, কেননা তাঁরা কংগ্রেসের সঙ্গে মাখামাখিতেই ব্যস্ত ছিলেন। একদিকে বামপন্থী কর্মীবাহিনী এবং শ্রমজীবী জনগণ যখন ১১ ডিসেম্বরের ধর্মঘটকে সফল করে তোলার জন্য সংঘবদ্ধভাবে লড়াই চালাচ্ছিলেন; সিপিআই(এম) নেতৃত্ব তখন বুর্জোয়া বিরোধীপক্ষের বিকৃত শক্তিগুলি – যারা সমগ্র নয়া আর্থিক নীতিরই দৃঢ় সমর্থক – তাদের নিয়ে তথাকথিত তৃতীয় ফ্রন্ট গড়ার লক্ষ্যে ঐ ধর্মঘটকে কাজে লাগিয়ে নেওয়ার মতলব করছিলেন। এর বিপরীতে আমাদের অবস্থান হল বামপন্থী কর্মীবাহিনী ও শ্রমজীবী মানুষের এই সংহতিকে বিকশিত করে বাম মহাজোটে রূপান্তরিত করা।

একদিকে যুক্তফ্রন্টের পতন, অন্যদিকে কিছু রাজ্যে নিজেদের শক্তিবৃদ্ধি করতে সিপিআই(এম) ও সিপিআই-এর ব্যর্থতা, এমনকি তাদের সমর্থনভিত্তির ক্ষয় বুর্জোয়া বিরোধীপক্ষের প্রতি তাদের কৌশল সম্পর্কে নিজেদের ভেতরেই গুরুতর বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। আবার কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মেলানোর প্রশ্নেও তাদের মধ্যে বিক্ষোভ রয়েছে। তাঁদের পার্টি কংগ্রেসগুলিতে ব্যাপক সংখ্যক বাম কর্মীবাহিনী বামদের ঐক্যবদ্ধতা ও তাদের স্বাধীন কার্যকলাপের পক্ষেই মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। সুতরাম বাম মহাজোটের স্লোগান বাম কর্মীবাহিনী ও ব্যাপক সংখ্যক শ্রমজীবী মানুষের আকাঙ্খাকেই প্রতিফলিত করে।

এই ব্যাপারে স্পষ্ট থাকা উচিত যে বাম মহাজোটের স্লোগান যেমনভাবে হোক সমস্ত বাম শক্তিগুলিকে এক মঞ্চে জড়ো করার কোনো সাধু আকাঙ্খা মাত্র নয়, বরং তা হল ‘যুক্তফ্রন্ট’ ধরনের সুবিধাবাদী কৌশলের বিপরীতে বিপ্লবী কমিউনিস্টদের সুনির্দিষ্ট কৌশলগত প্রত্যুত্তর। আমাদের তাই এই শ্লোগানের প্রতি একনিষ্ঠ থাকতে হবে, বামদের মধ্যকার দুই কৌশলের এই লড়াইকে ব্যাপক বাম কর্মীবাহিনী ও শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে নিয়ে যেতে হবে এবং তাঁদের বিপ্লবী কমিউনিজমের পক্ষে জয় করে আনতে হবে। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এটি এক দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়া এবং সমাজগণতন্ত্রের বিরুদ্ধে আমাদের ঐতিহাসিক সংগ্রামের তা এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এই কৌশল আবার নৈরাজ্যবাদের বিরুদ্ধেও সর্বাপেক্ষা কার্যকরী প্রতেষেধক, কেননা সমাজগণতন্ত্রীদের ‘যুক্তফ্রন্টীয়’ কৌশলের মধ্যে নিহিত সংসদসর্বস্বতাই বিপ্লবী যুব সম্প্রদায়কে সংগঠিত বাম আন্দোলন থেকে বিক্ষিপ্ত করে তাদের নৈরাজ্যবাদী শিবিরের দিকে ঠেলে দেয়।

কৃষক সংগ্রামকে মূল যোগসূত্র হিসাবে ধরুন

জমিদারদের ভাড়াটে বাহিনী আমাদের সামাজিক ভিত্তির ওপর আঘাত হানায় বিহারের গ্রামাঞ্চলে বিশেষত ভোজপুর ও জাহানাবাদে আমরা কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছিলাম। ১৯৯৭-এর শেষে ঘটে বাথে গণহত্যা, যেখানে আক্ষরিক অর্থেই ৬০ জন মানুষকে জবাই করা হয়। এটা অবশ্য আমাদের আন্দোলনের ধারায় একটা মোড়ও সূচিত করে। রাজনৈতিক বিক্ষোভগুলি সংগঠিত করা ছাড়াও কিছু পাল্টা আঘাতও হানা হয় এবং পরবর্তী সংসদীয় নির্বাচনে আমরা গ্রামীণ দরিদ্রদের মধ্যে আমাদের ভিতকে ধরে রাখতে ও সক্রিয় করতে সমর্থ হই। সাম্প্রতিককালে তাদের সামাজিক ভিতের মধ্যে ফাটল দেখা দেওয়ায় রণবীর সেনা এক ধরনের স্থিতাবস্থার মধ্যে পড়েছে ও তাদের মধ্যে ভাঙ্গন দেখা যাচ্ছে। অপরদিকে আমাদের ভোজপুরের ‘পুনর্জাগরণ’ সমাবেশ ব্যাপক সাফল্যলাভ করে এবং তা দেখিয়ে দেয় যে গণ উদ্যোগের দরজা আবার খুলে যাচ্ছে। কিন্তু আত্মতুষ্টির কোনো অবকাশ নেই, কেননা রণবীর সেনার আঘাত হানার শক্তি এখনও অটুট। যে শয়তান বাহিনী বিহারে আমাদের আন্দোলনের সামনে সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে হাজির হয়েছে, তার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়লাভের জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ অতিক্রম করতে হবে।

ষষ্ঠ কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত অনুসারে বিহারে এবং অন্যত্র আমাদের আন্দোলনের এলাকাগুলিতে ক্ষেতমজুর সংগঠন গড়ে উঠছে। বিহারে এই শাখাগুলির মধ্যে রাজ্যস্তরে সমন্বয়সাধনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে এবং নতুন বছরে আমাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল রাজ্য স্তরের একটি সংগঠন বানানো। কৃষি বিপ্লবে নিয়োজিত পার্টির কাছে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হল গ্রামীণ সর্বহারাদের তাদের শ্রেণী সংগঠনে সংগঠিত করা ও তাদের শ্রেণী চেতনার বিকাশ ঘটানো।

বিহারে পূর্বেকার কিষাণ সভা অকার্যকর অবস্থায় রয়েছে। কিন্তু কয়েকটি পকেটে স্থানীয় ভিত্তিতে ও স্থানীয় ইস্যুর ভিত্তিতে ব্যাপক কৃষক জনতাকে সংগঠিত করার কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবাংলা, অন্ধ্র ও উড়িষ্যাতেও কৃষক প্রতিরোধের কিছু এলাকা বিকাশলাভ করছে। কমরেড নাগভূষণ পট্টানায়কের মৃত্যু সত্ত্বেও উড়িষ্যায় জমিদারদের আক্রমণ প্রতিহত করা হয়েছে।

বিশ্ব বাণিজ্যিক সংস্থার ক্রমবর্ধমান চাপের ফলে ভারতীয় কৃষি সংকটগ্রস্ত হয়ে পড়ার অজুহাত দেখিয়ে সমাজগণতন্ত্রীরা গ্রামীণ দরিদ্রদের তাদের সংগ্রাম পরিত্যাগ করতে বলছে এবং ধনী চাষিদের পিছনে সমাবেশিত হওয়ার উপদেশ দিচ্ছে। ঐ একই যুক্তির ভিত্তিতে নৈরাজ্যবাদীরাও ধনী কৃষকদের সংগঠনগুলির সাথে একই মঞ্চে মিলিত হয়েছে। এটি হল দুই চরম বিপরীতের একই বিন্দুতে মিলিত হওয়ার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। মার্কসবাদের শ্রেণী দৃষ্টিকোণ পরিত্যাগ করেছেন এমন কিছু প্রাক্তন মার্কসবাদী জাতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কর্তব্যকর্মকেই চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করেছেন। তাই তাঁরা জাতিবর্গের ভিত্তিতেই কথা বলেন, বিএসপি-মার্কা রাজনীতিতে আটকে পড়েন এবং দরিদ্র নিপীড়িত জনতার নেতৃত্ব দলিত ও পশ্চাদপদ বর্গের সেই সুবিধাবাদী স্তরের হাতে তুলে দেন, যারা সাধারণ মানুষকে কামানের খোরাক হিসাবে ব্যবহার করে সংসদীয় ব্যবস্থাপনার মধ্যে তাদের লুটের ভাগ আদায় করে নেয়। অন্ধ্রে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী মহলে এই ধারা যথেষ্ট সক্রিয় ছিল, ফলে সেখানে আন্দোলন প্রান্তিক হয়ে পড়ে এবং কিছু গোষ্ঠীর মধ্যে ভাঙ্গন ঘটে। তামিলনাড়ুতেও এই বিষয়টি যথেষ্ট বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। যথেষ্ট সম্ভাবনা সত্ত্বেও সেখানে আন্দোলন যে জোরদার হয়ে উঠছে না তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে এখানেই। বিহারেও এমসিসি ও পার্টি ইউনিটি-কে এই একই চিন্তাধারা শক্তিশালী পশ্চাদপদ জাতি গোষ্ঠীগুলি ও শাসক দলের হাতে দাবার ঘুটিতে পরিণত করেছে।

জাতি হল অবিভাজিত শ্রেণী আর তাই সমস্ত ধরনের জাতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম – যা হল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ – সমগ্র সমাজে শ্রেণী বিভাজনের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। কমিউনিস্ট হিসাবে আমাদের প্রাথমিক দায়িত্ব হল এই ব্যাপক সামাজিক আলোড়ন থেকে সুনির্দিষ্ট পরিচিতি নিয়ে উঠে আসা সর্বাহারা শ্রেণী শক্তিগুলিকে সংহত করা, আর আমাদের পার্টি ঠিক এই কাজটিই করছে। মণ্ডল হাওয়ায় প্রভাবিত হয়ে এবং সমাজতন্ত্রের সংকটকালে যাঁরা আমাদের পরিত্যাগ করেছিলেন তাঁরা লালু বাহিনীর হয় তাত্ত্বিক না হয় সক্রিয় কর্মীতে অধঃপতিত হয়েছেন, আর আমরা আমাদের অবস্থানে দৃঢ় থেকেছি, আমাদের শ্রেণী শক্তিগুলিকে সংগঠিত করেছি, গণআন্দোলনের আগুনের মধ্য থেকে কমিউনিস্ট পার্টিকে গড়ে তুলেছি এবং ক্রমে ক্রমে তথাকথিত সামাজিক ন্যায়ের শক্তিগুলির দুর্গে হানা দিচ্ছি। কৃষি সংগ্রামের রণাঙ্গনে সমস্ত ধরনের উদারনীতিবাদী ধ্যানধারণার আমাদের দৃঢ়ভাবে বিরোধিতা করতে হবে এবং পার্টির শ্রেণী লাইনের প্রতি অবিচল থাকতে হবে। এই সংগ্রামগুলিই হল পার্টির প্রাণ। এখান থেকেই জন্ম নেবে জনগণের অমিত বলশালী শক্তিগুলি – যে শক্তি দেশের চেহারাটাই দেবে পাল্টে।

সার্বিক উদ্যোগে ঝাঁপিয়ে পড়ুন

প্রধান শত্রুর বিরুদ্ধে দেশব্যাপী প্রচারাভিযান পরিচালনা করার যে গৌরবময় ঐতিহ্য পার্টির রয়েছে তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আমরা এই বছরের শেষের দিকে ‘গৈরিক হঠাও, দেশ বাঁচাও’ অভিযান পরিচালনা করি। এই ধরনের অভিযানের প্রাথমিক লক্ষ্য হল জনগণকে রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা। একইসঙ্গে এই অভিযানগুলির মাধ্যমে সমগ্র পার্টিকে সমাবেশিত করে জাতীয় স্তরের কেন্দ্রীয় ইস্যুর প্রতি পার্টির দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত করা হয় এবং এইভাবে তার লৌহদৃঢ় ঐক্য সুনিশ্চিত করা হয়। তাই তথাকথিত সৃজনশীল প্রয়োগের নামে কোনো রাজ্য শাখা বা গণসংগঠন যদি জাতীয় স্তরের আহ্বানকে লঘু করে তোলে, তবে সেটা অনুমোদনযোগ্য নয়।

উপরোক্ত অভিযান শেষ হয়ে গেলেও বিজেপি শাসনের বিভিন্ন দিককে এখনও উন্মোচিত করে যেতে হবে। আমাদের বিশেষভাবে জোর দিতে হবে তার আমূল বিশ্বায়নের আর্থিক মতবাদ ও আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির স্বার্থের কাছে আত্মসমর্পণের ওপর। তার স্বদেশীয়ানার চমকদারি সম্পূর্ণ উন্মোচিত হয়ে গেছে এবং বামদের পক্ষে স্বনির্ভর অর্থনীতিকে জোরালোভাবে তুলে ধরার এটাই প্রকৃষ্ট সময়। ১১ ডিসেম্বরের শ্রমিক শ্রেণীর কার্যক্রম ছিল এই লক্ষ্যে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ। শ্রমিক ফ্রন্টে বরফ গলতে শুরু করেছে, আমরাও ভালো সাড়া পাচ্ছি, সুতরাং এখানে আমাদের উদ্যোগ অনেক বাড়িয়ে তুলতে হবে। শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনের রাজনৈতিকীকরণ ঘটানোর পক্ষে এটা অত্যন্ত অনুকূল সময় এবং আমাদের ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দকে কাগজ-কলমের ওপর জোর কমিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে সরাসরি আন্তঃক্রিয়ার উপর মনোনিবেশ করতে হবে।

রাজনৈতিক পরিস্থিতি টালমাটাল হয়ে উঠেছে। ১৯৯৯ সালেই মধ্যবর্তী নির্বাচনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। সুতরাং আমাদের পার্টিকে যে কোনো পরিস্থিতির মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আর তাই আমাদের সমস্ত গণসংগঠনগুলিকে, বিশেষত যুব ফ্রন্টকে জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সমস্ত ইস্যুতে সাহসী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে, অন্য সবাইকে ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। চার দেওয়ালের মধ্যে আলোচনার দিন শেষ। এখন সার্বিক উদ্যোগের সময়। ইতিহাসে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের নিষ্পত্তি তো রাস্তাতেই হয়ে থাকে।

পার্টি সংগঠনকে শক্তিশালী করুন

পার্টির ষষ্ঠ কংগ্রেস পার্টি গঠনের লক্ষ্যে নিম্নলিখিত কর্তব্যকর্মগুলিকে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে তুলে ধরেছিল : (১) পার্টি সদস্যদের প্রাণবন্ত ও গতিময় পার্টি ব্রাঞ্চগুলিতে সংগঠিত করা; (২) একেবারে নিম্নতম স্তর পর্যন্ত পার্টি শাখাকে সম্প্রসারিত করা; (৩) পার্টি মুখপত্রগুলিকে জনপ্রিয় গণপত্রিকা হিসাবে বিকশিত করা; (৪) উপদলীয়তার যে কোনো অভিব্যক্তির বিরুদ্ধে দৃঢ় সংগ্রাম চালানো এবং পার্টির মধ্যে এক স্বাস্থ্যকর ও জীবন্ত পরিবেশ সুনিশ্চিত করা; (৫) লিঙ্গ ও অঞ্চলগত ভারসাম্যহীনতাগুলিকে যতদূর সম্ভব কমিয়ে আনা এবং পার্টির মধ্যে শ্রমিকশ্রেণীর ভিত্তিকে শক্তিশালী করা।

তারপর থেকে এক বছরেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে এবং আমার মনে হয় প্রতিটি পার্টি কমিটিরই উচিত উপরোক্ত কর্তব্যকর্মের ভিত্তিতে গত এক বছরের সাফল্যের পর্যালোচনা করা। আমার মতে প্রথম এবং চতুর্থ কর্তব্যকর্ম দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ওপরে আমাদের শক্তিশালী পার্টি কমিটিগুলি থাকতে পারে, কিন্তু নীচে যদি প্রাণবন্ত ও গতিশীল ব্রাঞ্চসমূহের পরিকাঠামো না থাকে তবে ঐ ব্যবস্থাপনাকে যথার্থ সংগঠন বলা যাবে না। উপর থেকে নীচ পর্যন্ত বিস্তৃত একটি কাঠামো নিয়েই হয় সংগঠন এবং কমিউনিস্ট পার্টির বুনিয়াদী শক্তি যেহেতু সৈন্যবাহিনীর মতোই দৃঢ়বদ্ধ সংগঠন ছাড়া অন্য কিছু নয়, তাই কমিউনিস্ট পার্টির কাছে এটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

চতুর্থ কর্তব্যকর্মটি সম্পর্কে বলা যায় যে ইতস্তত কয়েকটি পকেটে ছাড়া আমাদের পার্টিতে উপদলীয়তাবাদ তেমন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা নয়। কিন্তু কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পার্টি কমিটির মধ্যকার নেতৃত্বের মধ্যে বোঝাবুঝি উৎকৃষ্ট মানের নয়। আমি এমন অনেক নেতাকে দেখেছি যাঁরা পার্টি অফিসে একই সঙ্গে থাকেন বা একই শহরে বা এলাকায় থাকেন, কিন্তু তাঁদের মধ্যে পারস্পরিক বার্তালাপ প্রায় নেই। তাঁদের মধ্যে সদ্ভাবের চেয়ে অসদ্ভাবই বেশি এবং যা আরও খারাপ তা হল এই যে তাঁরা সরাসরি ও খোলাখুলি কথা বলে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করেন না। প্রত্যেকেরই নিজস্ব পছন্দের বৃত্ত রয়েছে যেখানে কেবল অন্যের সমস্যা চুপিসাড়ে চর্চিত হয়। একে উপদলীয়তা বললে হয়তো বাড়াবাড়ি হবে, কিন্তু পার্টির মধ্যে সুস্থ ও জীবন্ত গণতান্ত্রিক পরিবেশের পথে তা অবশ্যই অন্তরায় সৃষ্টি করে।

পার্টি শিক্ষাকে একেবারে নীচের স্তরে নিয়ে যেতে কয়েকটি রাজ্যের পার্টি কমিটি কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, কিন্তু সেগুলি আদৌ সন্তোষজনক নয়। ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত পার্টি স্কুল ব্যবস্থাকে পুনরায় সংগঠিত করতে হবে এবং মার্কসবাদী শিক্ষার ওপর জনপ্রিয় পুস্তিকা প্রকাশনাকে পুনরায় শুরু করতে হবে। মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ দৃঢ়ভাবে আয়ত্ত না থাকায় অনেক কমরেডই উদারনীতিবাদী চিন্তাধারায় প্রভাবিত হয়ে পড়েন। পার্টি যখন গুরুত্বসহকারে সংসদীয় অনুশীলনে নিয়োজিত তখন ঐ ধরনের ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ার যথেষ্ট সম্ভাবনাই থাকে।

পার্টির ষষ্ঠ কংগ্রেস সতর্ক করে বলেছিল, “খোলা ও গণ পার্টির অর্থ অবশ্যই কমিউনিস্ট পার্টির বুনিয়াদী বৈশিষ্ট্যকে লঘু করা নয়, তার সংহত চরিত্রকে দুর্বল করা নয়, তার কেন্দ্রিকতা ও শৃঙ্খলাকে খাটো করা নয়। তাই বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টিকে সমাজগণতান্ত্রিক সংসদীয় সংস্থায় রূপান্তরিত করতে চায় এমন সব ধরনের উদারনৈতিক ধারণার বিরুদ্ধে দৃঢ়তার সাথে সংগ্রাম করতে হবে।” খুব কম করে বললেও বলতে হয়, এই সতর্কীকরণ আজ আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।

বিপ্লবী মার্কসবাদের পতাকাকে দৃঢ়ভাবে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে এমন এক শক্তিশালী কমিউনিস্ট পার্টি, গ্রামীণ দরিদ্রদের এক শক্তিশালী আন্দোলন এবং গৈরিক শক্তির দুরভিসন্ধির বিরুদ্ধে সার্বিক উদ্যোগ – নতুন বছরে আমাদের সামনে এই তিনটি হল চ্যালেঞ্জ। ভুল কৌশলগত লাইন অনুসরণের জন্য সমাজগণতন্ত্রীরা এবং সমস্ত বর্ণের নৈরাজ্যবাদীরা গুরুতর অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়েছে। আমাদের প্রতিটি অগ্রগতি তাদের আরও টলিয়ে দেবে এবং বাম আন্দোলনের পুরোভাগে নিয়ে আসবে আমাদের পার্টিকে। বুর্জোয়া বিকল্পের বিভিন্ন সংস্করণের বিপরীতে জনগণের এক প্রকৃত বিকল্প হয়ে উঠতে পারে এমন এক গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গড়ে তোলার জন্য এই ধরনের বিকাশ অপরিহার্য।

কমরেডস,

১৯৯৮ সালে আমরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতৃবৃন্দ ও ক্যাডারকে হারিয়েছি যাঁরা শ্রেণীশত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে নিজেদের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। আততায়ীর গুলি কমরেড অনিল বড়ুয়াকে আমাদের মধ্যে থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। কমরেড অনিল বড়ুয়া ছিলেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, অসমীয়া সমাজের এক অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। পার্টি ও জনগণের স্বার্থে তিনি ছিলেন উৎসর্গীকৃত প্রাণ। বছরের শেষদিকে আমরা হারালাম কমরেড নাগভূষণ পট্টনায়ককে। ভারতবর্ষের প্রায় ৭৫ বছরের কমিউনিস্ট আন্দোলন যে কয়েকজন মহান কমিউনিস্ট নেতার জন্ম দিয়েছে নাগভূষণ ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তাঁর মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাণশক্তিই হয়ে দাঁড়িয়েছিল ধ্বংসস্তুপ থেকে সিপিআই(এমএল)-এর বারবার উঠে দাঁড়ানোর প্রাণশক্তির প্রতীক। মৃত্যুশয্যায় তিনি ঘোষণা করেছিলেন, “জীবন ও মৃত্যুতে আমি পার্টি ও বিপ্লবের জন্য নিবেদিত প্রাণ।” এই হল একজন যথার্থ বিপ্লবী কমিউনিস্টের ভাবমানস এবং তা অনুসরণ করেই আমরা আগামী দিনগুলিতে বৃহত্তর সাফল্য অর্জনে কঠোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাব।