(১৯৯৬ সালের ১১ মার্চ নতুন দিল্লীতে অনুষ্ঠিত অধিকার ৠালিতে প্রদত্ত ভাষণ। লিবারেশন, এপ্রিল ১৯৯৬ থেকে)

কমরেডগণ,

আমার যতদূর চোখ যায়, শুধু লাল পতাকা উড়তে দেখছি। বলা হয় যে জনগণই ইতিহাস সৃষ্টি করেন আর আপনারা এখানে সেই ইতিহাসই সৃষ্টি করেছেন।

আমরা ঘোষণা করেছিলাম যে আমাদের ৠালি বামপন্থীদের সবথেকে বড় ৠালি হবে, সমস্ত ৠালির রেকর্ড ভেঙে দেবে। এই সত্যকে আপনারা প্রমাণ করেছেন। এই দশকের ৠালির সমস্ত পুরোনো রেকর্ড ভেঙ্গে আপনারা এই নতুন ইতিহাস তৈরি করেছেন (হর্ষধ্বনি)। আজকের এই ৠালির রেকর্ড নিশ্চয় কোনোদিন ভেঙ্গে যাবে এবং জোরের সাথে বলতে পারি যে সেই রেকর্ডও ভাঙবে সিপিআই(এমএল)-ই (হর্ষধ্বনি)।

বন্ধুগণ, পথের সমস্ত বাধা দূর করে দিল্লী পৌঁছতে আমরা আহ্বান করেছিলাম। আমাদে কর্মীরা এবং অন্য বামপন্থী পার্টির কর্মীরাও আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে দিল্লী এসেছেন। এই ৠালিকে সফল করার জন্য বহু বামপন্থী বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে আমরা কথা বলেছিলাম, গণতন্ত্রপ্রিয় সমস্ত মানুষের কাছে আমরা সমর্থন ও সহযোগিতা চেয়েছিলাম। আমরা দেখলাম যে অন্যান্য অনেকের সাথে গণতান্ত্রিক ও বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরাও সমস্ত দিক থেকে আমাদের সাথে সহযোগিতা করেছেন। সবার সহযোগিতাতেই আজকের এই বিশাল ৠালি সম্ভব হয়েছে।

আমাদের দেশ এক বিশেষ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে নতুন পথের সন্ধান করছে। আজ ১১ মার্চ সম্ভবত বর্তমান লোকসভার শেষ অধিবেশন হচ্ছে এবং আজই সারা দেশ থেকে শ্রমিক-কৃষকেরা লাখে লাখে দিল্লীর রাজপথে জমায়েত হয়েছেন। সংসদের প্রতি তাঁদের একটাই জিজ্ঞাসা আছে – গত পাঁচ বছরে এই সংসদে কী হয়েছে? জনগণের তথাকথিত নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সংসদে জনগণের জন্য কী করেছেন? এই প্রশ্নে সংসদের কাছে কোনো উত্তর নেই। আমরা দেখেছি যে গত পাঁচ বছরে এক সংখ্যালঘু সরকার অন্য দলের সাংসদ কিনে নিয়ে সংখ্যাগুরু হয়েছে। আমরা দেখেছি যে এই সরকারের মন্ত্রীদের এক বড় অংশ হাওয়ালা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছে, চার্জশীট পেয়েছে, তাদের মধ্যে কয়েকজন বর্তমানে জেলের মধ্যে আছে।

তাই বন্ধুগণ, প্রশ্ন উঠেছে, যে প্রধানমন্ত্রীর গোটা বাহিনীটাই দুর্নীতি-কেলেঙ্কারিতে যুক্ত সেই প্রধানমন্ত্রী কতটা সৎ হতে পারেন? তাই আমাদের পার্টি এই দাবি তুলেছে যে অন্যদের বিরুদ্ধে যে সিবিআই তদন্ত চলছে তার বর্শামুখ মূল পাণ্ডার বিরুদ্ধে চালিত হোক। যখন অন্য সকলের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে তখন দুর্নীতিগ্রস্ত সমগ্র মন্ত্রীসভার মূল পাণ্ডাকে অব্যাহতি দেওয়া হবে? এই একই দাবি এই ৠালি থেকে উঠেছে। রাও সাহেবকে একটা বিষয়ে ধন্যবাদ দেব, নিজেকে ডুবতে দেখে তিনি বললেন, ‘আমাকে ডুবতে তো হবেই, কিন্তু তোমাদের সকলকে নিয়েই ডুবব।’ (হর্ষধ্বনি)। এইভাবে আমরা দেখলাম সমস্ত প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক পার্টি – শাসক পার্টিগুলি এই জালে ধরা পড়ল। বলা হয় যে স্নানের ঘরে সকলেই নাঙ্গা। আমাদের সামনে এক চ্যালেঞ্জ এসে পড়েছে যে এই পরিস্থিতিতে আমাদের দেশ কোন পথে এগোবে? আমি মনে করি আমাদের দেশের এক নতুন পথ, নতুন শক্তি দরকার। এই পুরোনো শক্তিগুলির বোঝাকে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিতে হবে এবং নতুন শক্তিকে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে এসে দেশের দায়িত্বভার দুহাতে তুলে নিতে হবে। এই উদ্দেশ্যেই আমরা এই ৠালির আয়োজন করেছি। এই ৠালির প্রতি যে বিরাট সমর্থন আমরা দেখলাম, আমি অবশ্যই বলব তাতে এটা প্রমাণ করছে যে আমাদের দেশ এক নতুন পথের দিকে এগোতে চাইছে এবং আমাদের দায়িত্ব – বামপন্থীদের দায়িত্ব হল দেশের জনগণকে নেতৃত্ব দেওয়া।

কমরেড, এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলার জন্য অনেক রকম কথাই উঠছে। কিছুদিন আগে আমরা লোকেদের বলতে শুনলাম যে কিছু নির্ভরযোগ্য সৎ আমলা ভারতবর্ষে বিপ্লব আনবে। কিন্তু আপনারা দেখলেন যে তা সম্ভব নয়। ইতিহাসে কোনো দেশেই আমলাতন্ত্র বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারেনি। বৈপ্লবিক পরিবর্তন চিরদিনই এই আমলাতন্ত্রকে উৎখাত করেই এসেছে। আবার কিছু লোককে বলতে শোনা গেল যে সুপ্রীম কোর্টই সম্ভবত পরিবর্তন আনবে। সুপ্রীম কোর্ট যখন হাওয়ালা বা অন্য কেলেঙ্কারিতে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে আমরা অবশ্যই তাকে স্বাগত জানিয়েছি। কিন্তু কিছু প্রশ্ন এসে পড়ে। কিছুদিন আগে আমরা দেখলাম যে সুপ্রীম কোর্ট হিন্দুত্ব নিয়ে একটা রায় দিয়েছে। মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচনী প্রচারাভিযানে খোলাখুলি ঘোষণা করেছিলেন যে তারা সরকার গড়লে মহারাষ্ট্র হবে প্রথম হিন্দু রাজ্য। মামলার শুনানির সময় সবাই ভেবেছিল যে মনোহর যোশীর নির্বাচন খারিজ হয়ে যাবে এবং বিজেপি-শিবসেনা এমনকি নতুন মুখ্যমন্ত্রীও ঠিক করেছিল। কিন্তু সারা দেশ অত্যন্ত আশ্চর্যের সঙ্গে দেখল যে সুপ্রীম কোর্ট হিন্দুত্বের নতুন সংজ্ঞা নির্ধারণ করল এবং যোশীর নির্বাচনকে বজায় রাখল। টেলিকম কেলেঙ্কারি নিয়ে সংসদ অচল হয়ে পড়ল। সুপ্রীম কোর্টে মামলা উঠল। সাধারণভাবে আমরা দেখি যে একটা মামলার নিষ্পত্তি হতে অনেক সময় লেগে যায়। কিন্তু আশ্চর্যের সঙ্গে আমরা দেখলাম কত তাড়াতাড়ি মামলা শেষ হয়ে গেল। দ্রুত শেষ করা এই মামলায় কেলেঙ্কারি থেকে সুখরামকে মুক্ত করা হল এবং সরকারের টেলিকম নীতির সপক্ষে, বেসরকারিকরণের পক্ষে কতরকম তত্ত্ব ফেরি করা হল। তাই কেউ যদি মনে করেন যে সুপ্রীম কোর্টের মাধ্যমে দেশে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে সেটা একটা মধ্যবিত্ত কল্পনা মাত্র, বাস্তব সত্য নয়। দেশের বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার ক্ষমতা কারও যদি থাকে তা হল শ্রমিক-কৃষকের, লাখো জনগণের, যাঁরা দিল্লীর রাজপথে আজ মার্চ করেছেন। এঁরাই সেই একমাত্র শক্তি যাঁরা দেশে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারেন। (হর্ষধ্বনি)

বন্ধুগণ, শাসকশ্রেণী যে বিরাট সংকটে ফেঁসে গেছে তার থেকে পরিত্রাণ পেতে সমস্ত রকম চেষ্টাই তারা করবে। বিজেপি ঠিক করেছে যে হিন্দুত্বের ইস্যুকেই তারা জোরের সাথে তুলে ধরবে। আমরা দেখছি যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কথা নতুনভাবে তোলা হচ্ছে, উত্তেজনা গড়ে তোলা হচ্ছে। বিজেপিকে আমি বলতে চাই যে দেশপ্রেমের ঠিকা তুমি নাওনি। দেশকে আমরা ভালোবাসি। দেশের স্বাধীনতার জন্য, তার স্বার্বভৌমত্বের জন্য লড়াইয়ে আমরা কমিউনিস্টরা সব থেকে আগে থাকবো। এই লড়াইয়ের অন্যান্য যে কোনো শক্তির থেকে আমরা অনেক বেশি আত্মত্যাগ স্বীকার করব। (হর্ষধ্বনি)। শুরু থেকেই এই জনসংঘের লোকেদের আমরা জানি, সারা দেশ জানে যে তারা আমেরিকার দালাল। কিছুদিন আগেই সিআইএ বলেছে যে ভারতবর্ষ খুব শীঘ্রই টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। এটা আমেরিকার স্বপ্ন, সিআইএ-র স্বপ্ন। আমরা মনে করি যে ভারতবর্ষকে বিভক্ত করার চক্রান্ত যদি কেউ করে থাকে তারা হল ভারতীয় জনতা পার্টি। কারণ হিন্দুত্বের নামে তারা যেভাবে ভারতবাসীর হৃদয় বিভক্ত করছে, যেভাবে হিন্দু ও মুসমানদের বিভক্ত করছে, তা কোনো না কোনোদিন আবার দেশভাগের দিকে নিয়ে যাবে। আমি বলতে চাই যে দেশপ্রেমের নামে বিজেপির সাম্প্রদায়িক শক্তি সিআইএ-র নির্দেশে আরও একবার ভারতবর্ষকে বিভক্ত করার চেষ্টা করছে এবং সেই চেষ্টাকে আমাদের অবশ্যই ব্যর্থ করে দিতে হবে।

বন্ধুগণ, বিকল্পের বিষয়ে তৃতীয় মোর্চার কথা উঠেছে। আমরা ইতিমধ্যেই বলেছি যে সমস্ত বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তির সাথে বন্ধুত্ব করতে চাই। কিন্তু একটা কথা আমি বলে দিতে চাই যে ‘মণ্ডল’ থেকে সামাজিক ন্যায়ের যে শক্তি সামনে এসেছিল তাদের সামাজিক প্রগতির সীমানা শেষ হয়ে গেছে। উত্তরপ্রদেশে মুলায়ম সিং সরকারের আমলে মুজফ্ফরনগরে উত্তরাখণ্ড আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানো হয়েছিল, মহিলাদের ধর্ষণ করা হয়েছিল। এই বিষয়ে মুলায়ম সিং প্রথমে বিবৃতি দিলেন – এটা মিথ্যা, পুলিশের মনোবল ভাঙার চক্রান্ত। আমাদের দেশের পুলিশের মনোবল টিকিয়ে রাখা খুবই জরুরি এবং এই মনোবল টিকিয়ে রাখার জন্য বলাৎকারের ছাড় দেওয়া শাসকশ্রেণীরই রাজনীতি। চাপ বাড়াতে তিনি বললেন যে যদি এটা প্রমাণ হয় তাহলে আমি সমগ্র জাতির কাছে ক্ষমা চাইব। প্রমাণ তো হয়ে গেছে। কিন্তু তিনি জাতির কাছে ক্ষমা চাননি। কেবল উত্তরাখণ্ডের লোকেদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। আমি বলতে চাইছি বন্ধুত্বের হাত বাড়ানোর আগে মুজফ্ফরনগরের ঘটনা নিয়ে সমগ্র জাতির কাছে তাঁকে ক্ষমা চাইতে হবে। এটা তাঁর প্রতিশ্রুতি ছিল এবং আমাদেরও ধারাবাহিক দাবি ছিল।

তৃতীয় মোর্চার অপর শক্তি লালু যাদব ও তার জনতা দলের নাম এর পরেই এসে পড়ে। সংবাদ মাধ্যমের দৌলতে যে ছবি দেশের সামনে তুলে ধরা হয়েছে আমি মনে করি তা বিহারের আসল ছবি নয়। বিহারে গেলে দেখবেন সেখানে সবর্ণদের উপরিস্তর এতদিন একচেটিয়াভাবে যে লুটপাট চালাতো সেখানে সামাজিক ন্যায়ের নামে পশ্চাদপদদের উপরিস্তরটিও সামিল হয়েছে। আজ যে পশুপালন কেলেঙ্কারির কথা উঠেছে তাতে প্রধান দুটি নাম জগন্নাথ মিশ্র ও লালু যাদব এবং এরা পরস্পরকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে।

কমরেড, বিহারে আমাদের এক নির্বাচিত বিধায়ক, জনগণের প্রিয় নেতা গত ৬ মাস জেলে বন্দী হয়ে আছেন। যে সামন্ত শক্তির বিরুদ্ধে গণআন্দোলন গড়ে তোলার জন্য আমাদের হাজার হাজার কমরেডদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা চাপানো হয়েছে, আমরা দেখছি সেই জমিদার-সামন্তদের সাথে জোটবদ্ধ রয়েছে সরকারি প্রশাসন। সেখানে অবিরত নরহত্যা হচ্ছে, নানা রকম ঘটনা ঘটছে – কিন্তু প্রশাসন চুপ করে আছে। অন্যদিকে আমাদের হাজার হাজার সাথীদের হয় জেলে বন্দী রাখা হয়েছে না হয় ওয়ারেন্ট জারি করা হয়েছে। দমন করে ওরা বিহার থেকে সিপিআই(এমএল)-কে উৎখাত করতে চাইছে। কিন্তু বাস্তবের দিকে তাকান। আমি আগেও বলেছি এবং আজও বলব যে এমন কোনো বন্দুকের গুলি তৈরি হয়নি, এমন কোনো বন্দুক আবিষ্কৃত হয়নি যা সিপিআই(এমএল)-কে মাটি থেকে উৎখাত করতে পারে। (হর্ষধ্বনি)। আজ পর্যন্ত এমন কোনো টাকা তৈরি হয়নি যা দিয়ে সিপিআই(এমএল) নেতাদের কেনা যায়। বন্ধুগণ, আমরা বেঁচে আছি, আমরা এগিয়ে চলেছি। আমাদের হাজার হাজার লোক মারা গেছে, হাজার হাজার লোক জেলে বন্দী, আরও বেশি লোকের বিরুদ্ধে মামলা চলছে – এসত্ত্বেও আমাদের গণআন্দোলন, আমাদের শক্তি বেড়েই চলেছে। আর যারা ভাবতেন যে লালু যাদবের লেজুড়বৃত্তি করলেই তাদের শক্তি বাড়বে বিহারের মাটিতে সেই সব পার্টির কবর হয়ে গেছে। (হর্ষধ্বনি)

বন্ধুগণ তৃতীয় মোর্চা গড়ে উঠুক এটা আমরা অবশ্যই চাই। আমরা চাই সমস্ত বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক শক্তি ঐক্যবদ্ধ হোক। কিন্তু তার জন্য প্রথমত জনগণের শক্তির প্রতি, শ্রমিক-কৃষকের শক্তির প্রতি নির্ভর করতে হবে। কোনো লালু বা মুলায়ম বা জয়ললিতার শক্তি থাকে না, শক্তি থাকে জনগণের – শ্রমিক-কৃষকের। সেই শক্তির ওপর নির্ভর করেই আমরা সামনে এগোতে পারি। কিন্তু প্রথমে আমাদের অবশ্যই হিম্মত থাকতে হবে। এই হিম্মতের জোরেই আমরা বন্ধু খুঁজতে পারি, ঐ বন্ধুদের নেতৃত্ব দিতে পারি, তাদের লেজুড়বৃত্তি করলে চলবে না। বন্ধুগণ, রাজনীতিতে নানা ধরনের সমঝোতা করতে হয়। বিভিন্ন ধরনের শক্তির সাথে বিভিন্ন ইস্যুতে এখানে সেখানে বন্ধুত্ব করতে হতে পারে। রাষ্ট্রীয় স্তরে অন্যান্য গণতান্ত্রিক শক্তির সাথে কিছু দিনের জন্য মোর্চাও হতে পারে। কিন্তু আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই যে আমরা কোনো ধরনের দীর্ঘস্থায়ী মোর্চা গড়ায় বিশ্বাসী নই। তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ বিকল্পের ধারণার সঙ্গে আমরা সহমত নই, যে ধারণায় ন্যাশনাল ফ্রন্টের মতো শক্তিগুলির নেতৃত্বে স্থায়ী ধরনের এক তৃতীয় মোর্চা গড়ে তোলা হবে। বামপন্থী শক্তিকে, গণতান্ত্রিক শক্তিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে, গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে কারও না কারও সাথে কিছুদিনের জন্য বন্ধুত্ব নিশ্চয় করতে পারি। কিন্তু কোনো স্থায়ী মোর্চার মধ্যে নিজেদের বেঁধে ফেলতে পারি না – এটাই হল বিপ্লবী রাজনীতি। (হর্ষধ্বনি)

বন্ধুগণ, আমাদের সামনে আজ এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। আমরা সমগ্র দেশ জুড়ে বামপন্থী বন্ধুদের কাছে আহ্বান রেখেছি যে আসুন আমাদের মধ্যে অনেক পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও আমরা একসাথে চলার চেষ্টা করি। একটা কথা আমি স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই যে বামপন্থী আন্দোলনের মধ্যে যে সুবিধাবাদ জন্ম নিয়েছিল তাকে ধ্বংস করতেই সিপিআই(এমএল)-এর জন্ম হয়েছিল। তাই এই সুবিধাবাদের সঙ্গে সে কোনো সমঝোতা করতে পারে না। এটি এক বুনিয়াদী প্রশ্ন। যদি সিপিআই(এমএল) এই প্রশ্নে সমঝোতা করে, যদি সুবিধাবাদের সাথে সমঝোতা করে তার অর্থ খোদ আন্দোলনের ক্ষেত্রেই সমঝোতা করা এবং সিপিআই(এমএল)-এর অস্তিত্বের আর কোনো প্রয়োজন থাকে না। কোনো চাপের মাধ্যমে বা বড়দাদাসুলভ হুমকিতে কেউ যদি মনে করে থাকেন, এই বিপ্লবী লক্ষ্য থেকে আমাদের সরানো যাবে তাহলে তিনি মুর্খের স্বর্গে বাস করছেন। (হর্ষধ্বনি)। সমস্ত বুনিয়াদী পার্থক্য সত্ত্বেও দেশের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আমরা একসাথে কাজ করতে পারি। গণসংগঠনগুলির মঞ্চে গত পাঁচ বছর ধরে আমরা একসাথে কাজ করছি এবং যাবতীয় পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও রাজনীতির ময়দানে রাজনৈতিক ইস্যুগুলিতে জাতীয় স্তরে আমরা অবশ্যই একসাথে কাজ করতে পারি। এর জন্য আমাদের পার্টি অবশ্যই চেষ্টা চালাবে। গত আট বছর ধরে সেই চেষ্টা চলছে, আগামী আট বা দশ বছর ধরে সেই চেষ্টা অব্যাহতও থাকবে। সিপিআই(এম)-সিপিআই-ই হোক কিংবা নকশালপন্থী ধারাই হোক, বামেদের সমস্ত ধারার সাথেই মিত্রতার কথা আমরা বলেছি। সাধারণ ইস্যুতে একসাথে লড়াই করার কথা আমরা বলেছি। এ প্রশ্নে আমাদের পার্টি কোনো সংকীর্ণতা করে না – গণসংগঠনের মঞ্চে আমাদের অংশগ্রহণের মধ্যে এটা প্রমাণ হয়ে গেছে।

আমাদের মৌলিক পার্থক্যগুলি আছে ও থাকবে। আমাদের বলা হয়ে থাকে যে ‘আপনারা বামফ্রন্ট সরকারের সমালোচনা করবেন না।’ আপনাদের সামনে, দিল্লীর সমস্ত বুদ্ধিজীবীদের সামনে আমি বলতে চাই যে বাংলায় সিদ্ধার্থশংকর রায়ের কংগ্রেসী জমানায় হাজার হাজার যুবককে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা হয়েছিল। আমাদের পার্টির নেতা চারু মজুমদার ও সরোজ দত্তকেও ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছিল। বামফ্রন্ট সরকার গর্বভরে বলে থাকে যে তারা ১৮ বছর ধরে সরকারে আছে। ঠিক আছে আপনারা ১৮ বছর ধরে শাসন করেছেন, চান তো আপনারা ৮৮ বছর ধরে শাসন করুন – আমাদের বলার কিছুই নেই। কিন্তু আমাদের একটি প্রশ্ন আছে। ১৯৭০ দশকে এই সমস্ত গণহত্যা হয়েছিল এবং আপনাদের পার্টিও স্বীকার করে যে এই গণহত্যাগুলি ঘটেছিল, সেই সময়কালে ফ্যাসিবাদী শাসন চলছিল। আমি কেবল জানতে চাই যে তার জন্য গত ১৮ বছরে একজন দোষীকে একদিনের জন্যও কি কোনো শাস্তির ব্যবস্থা বামফ্রন্ট সরকার করেছে? আমি জানতে চাই যে সরোজ দত্ত, যিনি শুধু আমাদের পার্টির নেতাই ছিলেন না, পশ্চিমবাংলার এক বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীও ছিলেন. তাঁর মৃত্যুর তদন্ত আজও হল না কেন? তদন্তের দাবিতে পশ্চিমবঙ্গের দশ হাজার বুদ্ধিজীবীর স্বাক্ষর সম্বলিত একটি স্মারকলিপিও জ্যোতি বসুর কাছে দেওয়া হল, কিন্তু আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে কিছুই হল না। আমরা এই প্রশ্নগুলি তুলছি সিপিআই(এম) বিরোধিতার জন্য নয়, এই প্রশ্নগুলি সামগ্রিকভাবে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ভবিষ্যতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। কারণ কংগ্রেসের সেই কালো শক্তি আবার একবার বাংলায় মাথা তুলতে শুরু করেছে, সিদ্ধার্থশংকর রায় আবার সেখানে দাঁড়াতে চাইছে, মমতা ব্যানার্জী জনগণের মধ্যে জায়গা করে নিচ্ছে। তাই আমরা এই প্রশ্ন তুলছি যে আপনারা গত ১৮ বছরে এই দোষী ব্যক্তিদের একজনকেও যে সাজা দিলেন না তারই পরিণতিতে ঐ কালো শক্তি আবার একবার ফিরে আসার চেষ্টা করছে। আমরা এই দাবি তুলতেই থাকব। কারণ এই দাবি বাম ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের স্বার্থবাহী। এই দাবি কোনো একটি পার্টি বা কোনো একটি সরকারের নিছক বিরোধিতার জন্য নয়। এই দাবি গণতন্ত্রের জন্য এবং সেকারণেই আমরা গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা বলি। গণতন্ত্রের পক্ষে যায় এমন দাবিগুলির মধ্যে আমরা একটিও ছাড়তে পারি না, ছাড়তে পারি না এমন একটিও দাবি যা গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিয়ে যায়। তাতে আমরা ভোট পাব কিনা, নির্বাচনে জয়লাভ করব কিনা তার পরোয়া আমরা কখনই করি না। (হর্ষধ্বনি)।

বন্ধুগণ, আপনারা এসেছেন লালকেল্লার সামনে। এই লালকেল্লায় লাল নিশান ওড়ানোর স্বপ্ন ভারতবর্ষের কমিউনিস্টদের অনেক পুরোনো স্বপ্ন। এই সেই লালকেল্লা যেখানে ১৮৫৭ সালে স্বাধীনতার লড়াই-এর বিউগল বেজে উঠেছিল। আজ একদিকে বিদেশী বহুজাতিক সংস্থার হাতে আমাদের দেশকে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে, অপরদিকে দেশের মধ্যে হাওয়ালার শক্তি দেশকে কালো টাকা ও মাফিয়াদের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে। আগে যেখানে সাংসদের টাটা ও বিড়লার কাছে বিক্রি হয়ে যেতে শোনা যেত, আজকে সেই সাংসদদের নামগোত্রহীন হর্ষদ মেহেতাদের মতো পাতি ঠগদের কাছে বিক্রি হয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে। তাই বন্ধুগণ, আরও একবার স্বাধীনতার জন্য আমাদের লড়তে হবে। দেশপ্রেমের পতাকাকে কমিউনিস্টদের ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে। ১৮৫৭-তে যে লড়াই শুরু হয়েছিল তা এখনও শেষ হয়নি। এই লড়াই জারি আছে এবং এই পতাকাকে আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এটাই আমাদের কর্তব্য। আমি সমস্ত বুদ্ধিজীবী, সমস্ত প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের কাছে – যারা বিভিন্ন ধরনের আন্দোলনে যুক্ত আছেন – আবেদন করছি যে দেশের এই সংকটে নিজেদেরকে নিজেদের একক আন্দোলনে সীমাবদ্ধ রাখা ঠিক হবে না। আপনারা সকলেই মূল্যবান ও যোগ্যতা রাখেন এবং আজ প্রয়োজন সমস্ত সৎ বুদ্ধিজীবী, দেশের সমস্ত সৎ নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঘোষণা করা : এই দেশ কোনো অর্থশক্তি, মাফিয়া বা পুঁজিপতিদের নয়, এই দেশ দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদেরও নয়। এই দেশ শ্রমিকদের, এই দেশ কৃষকদের, এই দেশ যুবকদের, এই দেশ বুদ্ধিজীবীদের। এই দেশ আমাদের। এই দেশের ওপর আমাদের অধিকার। এই দেশ থাকবে আমাদের হাতে।

কমরেড, আপনাদের এই লড়াই লড়তে হবে। আপনারা ক্ষেত থেকে এসেছেন, কারখানা থেকে এসেছেন। ফিরে গিয়ে আবার আপনাদের লড়াইয়ে নামতে হবে। বিশেষ করে ভোজপুরের কমরেডদের আমি বলছি যারা সাহসিকতার সঙ্গে সমস্ত প্রতিকূলতা অতিক্রম করে এখানে এসেছেন। তাদের ওপর গ্রেনেড ছোঁড়া হয়েছিল। ভোজপুরের সংগ্রাম খুবই তীব্র। প্রায় এক মাসের মধ্যে সামন্তপ্রভুরা ১২ জনকে হত্যা করে। আপনারা ফিরে গিয়ে এই সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। আপনাদের শপথ নিয়ে যেতে হবে যে ফিরে গিয়ে এই সামন্তশক্তিকে, রণবীর সেনাকে আপনারা নিশ্চিহ্ন করে দেবেন (হর্ষধ্বনি)। আমি বলতে চাই বিহারের সংগ্রামী কৃষকদের প্রতি এইটিই হল ৠালির বার্তা। এই সামন্তশক্তিগুলি হল সমগ্র দেশের কাছে কলঙ্ক, সমাজ বিকাশের পথে বাধা এবং তারা নিরীহ গরিব লোকদের হত্যা করে। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের হিম্মতের সাথে লড়াই করতে হবে।

বন্ধুগণ, নির্বাচন সামনে এবং তা যে কোনোদিন ঘোষণা হতে পারে। এই নির্বাচন আপনাদের সামনে এক বড় সুযোগ এনে দিয়েছে। সমস্ত রাজনৈতিক পার্টিগুলির আসল চেহারা বেরিয়ে পড়েছে। আপনারা জনগণের কাছে যান। তাঁদের কাছে রাজনৈতিক পার্টিগুলির চেহারা তুলে ধরুন; রাজনৈতিক ব্যবস্থার চেহারা তুলে ধরুন। জনগণকে বলুন যে আজ দেশের প্রয়োজন এক নতুন পথের। একমাত্র সিপিআই(এমএল)-ই এই নতুন পথে নিয়ে যেতে পারে। আমার পুরো বিশ্বাস যে আজ থেকে কয়েক বছর পর আবার একবার আমরা দিল্লীতে মিলিত হব। আরও একবার ৠালির রেকর্ড ভেঙে দেব।

আমরা আবার এখানে মিলিত হব।
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক!