(লিবারেশন, মে ১৯৯৩ থেকে)

আমাদের পার্টির কলকাতা কংগ্রেসে আমরা স্থির করেছি ভারতবর্ষে একটি একক কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার লক্ষ্য নিয়ে বামপন্থী ঐক্যের জন্য আমাদের প্রচেষ্টাকে আরও জোরদার করে তুলব। পার্টি কংগ্রেসের পর থেকে বিগত তিন মাসে আমি যেখানেই গিয়েছি সেখানেই আমাদের আন্দোলনের শুভাকাঙ্খী এবং সাংবাদিক বন্ধুদের কাছ থেকে বারবার প্রশ্ন এসেছে – আমাদের এই স্বপ্ন সফল হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু বা সেই লক্ষ্যে নির্দিষ্ট পদক্ষেপই বা কী নেওয়া হচ্ছে? শুনেছি, পশ্চিমবাংলার সিপিআই(এম)-এর একজন বর্ষীয়ান কমিউনিস্ট ভদ্রলোক নাকি আমাদের এই ধারণাকে নিছক কল্পনাবিলাস বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু অন্য কেউ কেউ মনে করেন যে প্রবীণ নেতৃত্বের তরফ থেকে বাধা এলেও কমিউনিস্টদের নতুন প্রজন্ম এতে ব্যাপকভাবেই সাড়া দেবেন।

কমরেড হরকিষেণ সিং সুরজিৎ এবং কমরেড ইন্দ্রজিৎ গুপ্তের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার সময় আমি যে বিষয়টির উপর বিশেষ জোর দিই তা হল সংঘ পরিবার যেখানে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে বামপন্থার ঘাঁটি পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালায় আক্রমণ হানছে, বামপন্থীরা কিন্তু সেখানে হিন্দি বলয়ে বিজেপির ঘাঁটিতে কোনো সফলতা পাচ্ছেন না। বামপন্থীদের রণনীতিতেও হিন্দিভাষী এলাকায় বিজেপির মোকাবিলা করার দায়িত্বটা মধ্যপন্থী বিরোধীপক্ষের বা এমনকি কংগ্রেসের উপর ছেড়ে দেওয়া আছে – বামপন্থীদের নিজস্ব ভূমিকাটা সেখানে কেবলই পেছন থেকে সমর্থন যোগানোর। রাজনৈতিক ও সংসদীয় কারসাজির মাধ্যমে বিজেপির ক্ষমতায় আসাটাকে এভাবে যদি আপাতত ঠেকিয়েও রাখা যায় গণমানস থেকে সাম্প্রদায়িকতার জীবাণুকে কখনই নির্মূল করা যাবে না। আজ সাম্প্রদায়িক শক্তি ব্যাপক মেহনতি মানুষের ওপর এক ফ্যাসিস্ট হিন্দু রাষ্ট্র চাপিয়ে দিতে চাইছে। অথচ এই সাম্প্রদায়িকতার মোকাবিলায় জনগণকে সমাবেশিত করে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার কোনো প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে না। কংগ্রেসের সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী সম্প্রীতির বিমূর্ত স্লোগান ছাড়া আর কিছু নেই – বাস্তব জীবনে সংকটের প্রতিটি মুহূর্তে সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে আপোশ ও তোষণ করে চলাটাই কংগ্রেসী ঐতিহ্য।

কংগ্রেসকে দিয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই চালানো আর তার ধারাবাহিকতায় কংগ্রেসের সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ মোর্চা গড়ে তোলার কৌশলের যৌক্তিকতা সম্পর্কে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। সত্যি বলতে কী, এই কৌশলে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কাটাই বেশি – জনগণের চেতনাকে ভোঁতা করে ফেলা, গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে বিভক্ত করা আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে গণসমাবেশকে দুর্বল করে দেওয়া ছাড়া এর আর কোনো অবদান নেই।

ধর্মনিরপেক্ষ মোর্চার কৌশল

সাম্প্রতিক এআইসিসি অধিবেশনে কংগ্রেস সভাপতি নরসীমা রাও-এর একটি বক্তব্য যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। রাও-এর মতে “ধর্ম ছাড়া বিজেপির আর বাকি আছেটাই বা কী? এবার সেটাও নিয়ে নিলে বিজেপি-কে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।” অর্থাৎ বিজেপির অর্থনৈতিক কর্মসূচি এবং বৈদেশিক নীতি কংগ্রেস ইতিমধ্যেই দখল করে নিয়েছে। শুধু ধর্মটাই বাকি আছে আর এবার সেটাই কংগ্রেস কব্জা করে নেবে।

বাবরি মসজিদ ভাঙার আগেই শোনা যাচ্ছিল বিশ্ব হিন্দু পরিষদকে সরিয়ে রেখে কংগ্রেস এবার নিজেই বিতর্কিত স্থানে রামমন্দির নির্মাণের জন্য আদালত থেকে অনুকূল নির্দেশ আদায়ের আশ্বাস দিয়েসাধু মহন্তদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ গড়ে তুলতে চাইছে। এতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই। ১৯৪৯ সালে বাবরি মসজিদের ভিতরে রামলালার মূর্তি ঢুকিয়ে দিয়ে মসজিদটিকে বিতর্কিত মুসলিম পরিত্যক্ত ‘ইমারতে’ পরিণত করার ষড়যন্ত্র থেকে শুরু করে তালা খোলা এবং শিলান্যাস অবধি অযোধ্যা বিবাদের ক্রমবিকাশে একের পর এক কংগ্রেস সরকার চিরকালই সন্দেহজনক ষড়যন্ত্রকারীর ভূমিকা পালন করে এসেছে। বস্তুত মন্দির প্রশ্নে যাতে কংগ্রেস উদ্যোগ কেড়ে নিতে না পারে সেই ভয়ে মরিয়া হয়েই বিজেপি শেষ অবধি মসজিদ ভাঙার চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেয়। খেলা তাতেও শেষ হয়নি – ট্রাস্ট বানানোর নাম করে সাধুদের মধ্যে অনুপ্রবেশ বা সমান্তরাল উদ্যোগের মাধ্যমে কংগ্রেসী কারসাজি আজও অব্যাহত রয়েছে। মুসলমানেরা এটা ভালো বোঝেন আর তাই কংগ্রেস আজও তাদের থেকে গভীরভাবে বিচ্ছিন্ন।

এমন একটি পার্টির সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ মোর্চা গড়ে সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী কোনো প্রকৃত আন্দোলনকে আদৌ কি শক্তিশালী করে তোলা সম্ভব? কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যেকার দ্বন্দ্বকে কাজে লাগাতে বা প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে কংগ্রেস-কে নিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ মোর্চা বানানোটা কি একান্তই অপরিহার্য?

বিজেপির সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদ এবং কংগ্রেসের সাম্প্রদায়িক কারসাজির বিরুদ্ধে যুগপৎ বিরোধিতার ভিত্তিতে কোনো ধর্মনিরপেক্ষ মোর্চা গড়ে উঠলে সেই সংগ্রামকে কংগ্রেস ও বিজেপির অভিন্ন ভিত্তির – নয়া আর্থিক ও বৈদেশিক নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত করা যায়, আর এভাবেই ধর্মনিরপেক্ষ মোর্চা থেকে ধীরে ধীরে একটি ব্যাপক গণতান্ত্রিক মোর্চায় উপনীত হওয়া সম্ভব। এই প্রশ্নে তাত্ত্বিক-রাজনৈতিক ধ্যানধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য অবশ্যই রয়েছে আর সংযুক্ত মঞ্চে ও যৌথ কার্যকলাপের ক্ষেত্রে সিপিআই-সিপিআই(এম)-এর সঙ্গে আমাদের তীব্র সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই এটা প্রতিফলিত হয়। তবে অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তির চাপে এবং মুসলিম প্রতিক্রিয়ার ভয়ে তাদের এই লাইনকে তারা এখনও বাস্তবায়িত করার সাহস করে উঠতে পারেননি।

সাম্প্রদায়িকতার বিপদের মোকাবিলায় জনতা দল ও তার বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে জোট বাঁধায় আমাদের কোনো আপত্তি নেই – কিন্তু মতাদর্শের ক্ষেত্রে যদি মণ্ডলবাদীদের হাতে নেতৃত্ব ছেড়ে দেওয়া হয় আর লালু যাদব-মুলায়ম সিং-দের যুগপুরুষ হিসাবে তুলে ধরা হয় তাহলে শেষ পর্যন্ত তা ব্যাপক ক্ষতিই ডেকে আনবে। এতে এটাই প্রমাণিত হবে যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিন্দি বলয়ে বিজেপির চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় বামপন্থীদের কাছে নিজস্ব কোনো জবাব নেই। আর এভাবে ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলিতে নিজস্ব ভিত্তি সত্ত্বেও ভারতীয় রাজনীতির মূলধারায় বামপন্থীরা ক্রমেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবেন। বিশেষ করে বিজেপি যখন বামপন্থীদের এলাকাগুলিতে ঢুকে পড়ছে।

বামপন্থার স্বাধীন অগ্রগতি

উত্তরপ্রদেশে আমাদের সাম্প্রতিক কিছু উদ্যোগ এবং বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচনগুলিতে আমাদের জয় যদি চারিদিক থেকে প্রশংসা কুড়িয়ে থাকে এবং নতুন আশা জাগিয়ে তোলে তাহলে তার একমাত্র কারণ হল এর মধ্যে দিয়ে আমরা এটা দেখাতে পেরেছি যে দৃঢ়প্রতিজ্ঞা নিয়ে নামলে বিজেপির ঘাঁটিতেও বামপন্থীরা তাকে পরাজিত করতে পারে। তাছাড়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হল, আমাদের জয়ের অর্থ শুধু বিজেপির মারমুখী সাম্প্রদায়িক মতাদর্শের পরাজয়ই নয়, মণ্ডলভিত্তিক রাজনীতিকে ইতিবাচকভাবে বর্জন করে উন্নততর রাজনীতিকে গ্রহণ করার একটা প্রবণতাও এতে প্রতিফলিত হয়েছে। উত্তরপ্রদেশের বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরগুলি মণ্ডল-বিরোধী আন্দোলনে ভালোই মেতে উঠেছিল – ছাত্র সমাজের মধ্যে দেখা দিয়েছিল গভীর বিভাজন। জাতভিত্তিক সংরক্ষণের যৌক্তিকতা মেনে নিয়েও নির্বাচনী অভিযানে আমরা বেকারির সমস্যাকে সবচেয়ে প্রাধান্য দিয়ে তুলে ধরি আর এভাবে ছাত্রদের সমস্ত অংশের সমর্থন আমরা জয় করে নিই।

হিন্দিভাষী এলাকাগুলিতে, বিশেষত উত্তরপ্রদেশে জনতা দলের সঙ্গে যৌথ কার্যকলাপের ওপর জোর দেওয়ার সাথে সাথে বামপন্থীদের সমান্তরাল উদ্যোগকেও আমরা বাড়িয়ে তুলতে চাই। শুরুতে আমরা হয়তো আজ একটি ছোটো শক্তি – কিন্তু বামপন্থার অগ্রগতির প্রশ্নটি একটি রাজনীতিগত প্রশ্ন এবং সেই অগ্রগতির যথেষ্ট সম্ভাবনা আজকের পরিস্থিতিতে নিহিত রয়েছে। তাছাড়া, লোহিয়া এবং জয়প্রকাশের সমাজবাদী আদর্শবাদের অবসানের পর আজ এই সমস্ত এলাকাগুলিতে এক মতাদর্শগত শূন্যতা বিরাজ করছে। মুলায়ম সিং ও লালু যাদবকে সামনে রেখে বিজেপির উত্থানকে আপাতত কোনোরকম ঠেকাতে পারলেও, মতাদর্শের দিক থেকে বিজেপির কোনো পাল্টা জবাব এদের কাছে নেই। প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবীরা কিন্তু একটা মতাদর্শগত বিকল্প খুঁজছেন, খুজছেন সৎ, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এক শক্তিকে। এইভাবে নতুন রাজনৈতিক শক্তির আবির্ভাব বা শক্তিবিন্যাসের জন্য পরিস্থিতি ক্রমেই পেকে উঠছে আর বামপন্থীদের এতে নেতৃত্বকারী ভূমিকা নিতে হবে।

দীর্ঘমেয়াদী রণনীতিগত পরিপ্রেক্ষিত এবং বামপন্থীদের প্রতিটি অগ্রগতির ওপর আমরা যে লাগাতার জোর দিয়ে চলেছি তাকে আমাদের ‘মার্কসবাদী’ সমালোচকেরা প্রায়ই বিচ্ছিন্নতাকামী কর্মনীতি ও কৌশল হিসাবে চিহ্নিত করে থাকেন আর তাঁদের মতে এর অর্থ হল বুর্জোয়া শিবিরের ভেতরকার বিভাজন ও দ্বন্দ্বগুলিকে কাজে লাগানোর কৌশলের ওপর আমরা যথেষ্ট জোর দিচ্ছি না। আমাদের রণনীতিগত লক্ষ্যের স্বার্থে তথাকথিত কোনো ব্যাপক মোর্চায় নিজেদের স্বাতন্ত্র বিসর্জন দেওয়ার পরিবর্তে কখনও কখনও আমরা বিচ্ছিন্নতাকেও বরণ করে নিই ঠিকই, কিন্তু বুর্জোয়া বিরোধীপক্ষের বিভিন্ন রাজনৈতিক ধারার সঙ্গে কৌশলগত এমনকি সাময়িক বোঝাপড়া বা জোট বাঁধাটিকে আমরা কখনোই খাটো করে দেখি না। নিজস্ব স্বাধীন উদ্যোগের ওপর নির্ভর করে এই দিশায় আমরা ক্রমেই ধাপে ধাপে আমাদের নীতির আরও বিকাশ ঘটিয়ে চলেছি। বুর্জোয়া বিরোধী শিবিরের বিভিন্ন নেতৃত্বকারী শক্তির সঙ্গে আমাদের যৌথ কার্যকলাপের পরিধিও নিঃসন্দেহে সাম্প্রতিককালে অনেক বিস্তৃত হয়েছে।

আমার সাম্প্রতিক একটি বক্তৃতায় বিক্ষুব্ধ কংগ্রেসীদের উল্লেখ শুনে এবং সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী ব্যাপক কোনো মোর্চায় ভবিষ্যতে তাদের অন্তর্ভুক্তির সম্ভাবনার প্রতি ইঙ্গিত দেখে আমাদের কমরেডদের অনেকেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন। কিন্তু আমার মনে হয়, কংগ্রেসের ভেতরে বিক্ষোভ যখন বেড়ে চলেছে এবং বিজেপি সংক্রান্ত কৌশলের প্রশ্নটিকে ঘিরেই যখন সে বিক্ষোভ দানা বাঁধছে তখন রাষ্ট্রীয় একতা অভিযানের মতো কোনো ব্যাপক সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী মঞ্চের পক্ষে কংগ্রেসের এই বিক্ষুব্ধ অংশকে সঙ্গে নেওয়ার প্রশ্নটিকে সরিয়ে রাখা বোধহয় সম্ভব নয়। আমার মনে হয় না এতে এধরনের জোটের কংগ্রেস-বিরোধী চরিত্র কোনোভাবে ক্ষুণ্ণ হবে, বরং তা আরও মজবুতই হয়ে উঠবে।

সংক্ষেপে সাম্প্রদায়িকতার বিপদের বিরুদ্ধে একটি ব্যাপক মোর্চা গড়ে তোলার প্রশ্নে সিপিআই ও সিপিআই(এম)-এর সঙ্গে আমাদের মতপার্থক্য নেই। তবে এই ধরনের কোনো মঞ্চের স্বাভাবিক বিজেপি-বিরোধী চরিত্রকে অজুহাত বানিয়ে তার সুযোগ নিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে মোর্চা বানানোর তাদের প্রচেষ্টার আমরা বিরোধী। এই জাতীয় কোনো মঞ্চকে রাজনীতির মারপ্যাঁচের আখড়া বানিয়ে দেওয়ার বিপরীতে আমরা চাই গণসমাবেশের ওপর বেশি বেশি করে জোর দেওয়া হোক। আর মঞ্চের ভেতরে বুর্জোয়া বিরোধীপক্ষের হাতে উদ্যোগ ছেড়ে দেওয়া এবং বুর্জোয়া নায়কদের ঢাক পেটানোর যাবতীয় প্রচেষ্টার আমরা বিরোধিতা করি। দিশার প্রশ্নে আমরা মনে করি, কেবলমাত্র একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রই প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হতে পারে আর তাই ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য সংগ্রাম একই সঙ্গে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিকীকরণের সংগ্রামও বটে। ধর্মনিরপেক্ষ মোর্চা বানানোটা তাই আমাদের কাছে দীর্ঘমেয়াদী পরিপ্রেক্ষিত-বিস্মৃত কোনো প্রয়োজনবাদী কৌশল নয়। বরং তা হল ভারতবর্ষে একটি গণতান্ত্রিক মোর্চা নির্মাণের রণনীতিগত দায়িত্বেরই এক অভিন্ন অঙ্গ।

জনস্বার্থে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন

বিহারে জমির প্রশ্নে বামপন্থী পার্টিগুলির ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনই হোক অথবা নয়া আর্থিক নীতির বিরুদ্ধে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনই হোক, আমরা বরাবরই জনস্বার্থে বিভিন্ন প্রশ্নে যৌথ আন্দোলন গড়ে তোলার ওপরেই সবচেয়ে বেশি জোর দিয়ে এসেছি। সচেষ্ট থেকেছি যৌথ আন্দোলনের পরিধিকে সম্প্রসারিত করে ছাত্র, যুব, মহিলা ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলিকেও এই প্রক্রিয়ায় সামিল করে নিতে। এই পরিপ্রেক্ষিত থেকে ট্রেড ইউনিয়নগুলির সমন্বয় কমিটিকে প্রসারিত করে নয়া আর্থিক নীতি ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে গণসংগঠনগুলির একটি যুক্তমঞ্চ গড়ে তোলার প্রচেষ্টাকে আমরা আন্তরিকভাবে স্বাগত জানিয়েছি। এই মঞ্চটি মূলত বামপন্থীদের নেতৃত্বে পরিচালিত গণসংগঠনগুলিকে নিয়েই গড়ে উঠেছে। এর মূল লক্ষ্য হল সরকারের আর্থিক ও শিল্প নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিচালিত করা যা স্বাভাবিকভাবেই ভারত বন্ধ-এর দিকে এগিয়ে চলেছে। এই সমস্ত কারণে আমরা মনে করি যে আগামীদিনে বামপন্থী দলগুলির এক রাজনৈতিক মহাজোট গড়ে ওঠার বাস্তব ভিত্তি হিসাবেও আজ এধরনের যুক্ত গণমঞ্চের যথেষ্ট প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে।

তবে যেভাবে সাম্প্রদায়িকতা আর নয়া আর্থিক নীতির প্রশ্নকে মিলিয়ে মিশিয়ে দিয়ে এই মঞ্চের কেন্দ্রীয় লক্ষ্যবস্তুগুলিকে গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে আমরা তার বিরোধিতা করি। প্রধান বামপন্থী দলগুলি যেভাবে চিরকাল কংগ্রেস(ই) সরকারকে বাঁচানোর চেষ্টা করে এসেছে, কঠিন মুহূর্তে কংগ্রেসকে সমর্থন জানিয়ে এসেছে এবং বিজেপি-বিপদকে ঠেকানোর নাম করে সরকার-বিরোধী গণআন্দোলনের লাগাম টেনে ধরেছে তাতে মঞ্চের মূল লক্ষ্যকে বিভ্রান্ত করে দেওয়ার যে কোনো প্রচেষ্টায় শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

তাছাড়া এই ধরনের কোনো মঞ্চকে অবশ্যই রাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান নিপীড়নকারী চরিত্রের বিরুদ্ধে সরব হয়ে উঠতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না যে সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলা করার নাম করে রাষ্ট্র ক্রমেই যে দানবীয় ক্ষমতা বাড়িয়ে চলেছে তা সবই শেষ অবধি গণসংগ্রামের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে। সুসঙ্গত গণতন্ত্রের প্রবক্তা হিসাবে নাগরিক অধিকার, মানব অধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকার হননের প্রতিটি ঘটনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়াটা বামপন্থীদের অবশ্য কর্তব্য। মহিলাদের ওপর নিপীড়নের প্রশ্নে, বিশেষত পুলিশ হাজতে নারী ধর্ষণের বিরুদ্ধে বা শ্রেণী ও সম্প্রদায়গত নিপীড়নের হাতিয়ার হিসাবে নারী অত্যাচারের বিরুদ্ধেও এই গণমঞ্চকে অবশ্যই দৃঢ় ও সুস্পষ্ট অবস্থান নিতে হবে। আমরা আরও মনে করি ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে গণমুখী উন্নয়নের দাবিতে তৃণমূলে বিভিন্ন বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ইতিবাচক সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। আইএমএফ-বিশ্বব্যাঙ্ক নির্দেশিত আর্থিক নীতি তথা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধেও এই সংগঠনগুলি ক্রমেই সরব হয়ে উঠেছে। এই সমস্ত শক্তিকেও প্রস্তাবিত এই গণমঞ্চের আওতায় আনতে হবে। বিগত কয়েক দশকের উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন যে বিতর্কিত প্রশ্নগুলি সামনে উঠে এসেছে সেই প্রশ্নগুলিকে বামপন্থার নিজস্ব এজেন্ডাতেও উপযুক্ত গুরুত্বসহকারে স্থান করে দিতে হবে। আর এই লক্ষ্যে, বামপন্থী শক্তিকে এই সমস্ত সংগ্রামী শক্তির সঙ্গে বেশি বেশি করে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে, অবশ্যই নিজস্ব মতাদর্শ ও সাংগঠনিক শক্তির ওপরে সম্পূর্ণ আস্থা রেখেই। এই সমস্ত এবং অন্যান্য প্রশ্নে মঞ্চের ভেতরে আমাদের লড়াই অব্যাহত থাকবে। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে যুক্ত রাজনৈতিক জোট এবং নয়া আর্থিক নীতি বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ গণমঞ্চের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন বামপন্থী শক্তির বিকাশমান ঐক্যের একটা ছবি আমরা দেখতে চাইছি, অন্যদিকে যৌথ আন্দোলনের সমগ্র আঙ্গিনা জুড়ে শুরু হয়ে গেছে বামপন্থার দুই কৌশলের মধ্যে লড়াই।

ঐক্য থেকে শুরু করে সংগ্রামের মাধ্যমে আমরা পৌঁছে যেতে চাই উচ্চতর পর্যায়ের ঐক্যে। ভারতবর্ষের বামপন্থী আন্দোলনের ভবিষ্যত আজ এই ঐক্য-সংগ্রাম-ঐক্যের ওপরেই নির্ভর করছে।