(লিবারেশন, জানুয়ারি ১৯৯১ থেকে)

উচ্ছ্বাসের অবসান হয়েছে। চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী উচ্ছ্বাস সর্বদাই ক্ষণস্থায়ী। ভারতীয় রাজনীতি বিশেষ করে ‘বিরোধী পক্ষের’ রাজনীতিতে যার তেমন কোনো শিকড় ছিল না, সেই ভি পি সিং-এর মতো ব্যক্তির পক্ষে ১১ মাস ক্ষমতায় টিকে থাকা মোটেই কম সাফল্য নয়। পরিহাস এখানেই, যে ব্যক্তি পদত্যাগ-এর রাজনীতিতে অন্য সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন, শেষপর্যন্ত তিনিই একমাত্র প্রধানমন্ত্রী যিনি সংসদের মধ্যে ভোটের মাধ্যমে অপসৃত হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করলেন।

ভি পি সিং চলে গেছেন। তিনি কী শীঘ্রই ফিরে আসবেন নাকি প্রান্তীয় রাজনীতির একজন প্রবক্তায় পর্যবসিত হবেন, সে সম্পর্কে এখনই কোনো ভবিষ্যৎবাণী করা ঠিক হবে না। বরং এখন আমরা পুরোনো প্রবাদ ‘অপেক্ষা করেই দেখুন’-এ নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখি।

ভি পি সিং বারংবার দাবি করে চলেছেন ধর্মনিরপেক্ষতার মহান আদর্শ রক্ষা করতেই তাঁর সরকারকে বিসর্জন দিতে হয়েছে। তাঁর যুক্তির ধারা হল, বিজেপির দাবিগুলি মেনে নিলে তিনি সরকারকে রক্ষা করতে পারতেন। ধর্মনিরপেক্ষতার উচ্চ আদর্শ রক্ষার কারণেই তিনি শহীদ হয়েছেন বলে নিজেকে জাহির করছেন, এবং তিনি বলছেন আস্থা ভোট ছিল সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার যুদ্ধরেখা। তিনি এমনকি সাংসদদের কাছে বিবেক অনুযায়ী ভোট দেওয়ার জন্যও আবেদন করেছিলেন।

যদিও ভোটের ফলাফল থেকে দেখা যাচ্ছে, যুদ্ধরেখা, বরং বলা ভালো, যুদ্ধরেখাগুলি বিভিন্ন তলে টানা হয়েছিল ও তাঁর নিজের দলের প্রায় অর্ধেক সাংসদই পার্টি হুইপকে অগ্রাহ্য করেছিল। ভি পি সিং-কে যদি বিশ্বাসই করতে হয় তবে বলা যায়, সংখ্যাগরিষ্ঠ সাংসদই সাম্প্রদায়িকতার পক্ষাবলম্বন করেছিল। তাহলে, জনতা দলের বিভাজন বিশেষ করে মুলায়ম সিং যাদব ও চিমনভাই প্যাটেলও যখন বিজেপির বহ্নির মুখে তখন তাদের চন্দ্রশেখর শিবিরে যোগদানকেই বা কীভাবে ব্যাখ্যা করা হবে। নতুন প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখরও ধর্মনিরপেক্ষতা-সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে একই সুরে কথা বলছেন। বাস্তবিকই ভি পি সিং যদি বিজেপির দাবিগুলি মেনে নিতেন তাহলেও তার সরকার পড়ে যেত, অবশ্য আরও কালিমালিপ্ত হয়ে। কারণ, সেক্ষেত্রে বামপন্থীরা তাদের সমর্থন তুলে নিতে বাধ্য হত, আর চন্দ্রশেখর-দেবীলাল গোষ্ঠীও বিদ্রোহ করতই এবং তা করত আরও নৈতিক কর্তৃত্ব নিয়ে। ঐ সন্ধিক্ষণে সরকারকে রক্ষা করার জন্য তাঁর কাছে অন্য কোনো পথ খোলা ছিল না। বস্তুত তিনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বিজেপির সঙ্গে সমঝোতায় আসার সবরকম চেষ্টাই করেছেন, বিতর্কিত অর্ডিন্যান্স জারি করা ছিল এর প্রমাণ। ভি পি সিং কেবল রাজনীতিকের সত্যকেই বলছেন, যা তাঁর পক্ষে গ্রহণযোগ্য। যদিও তাঁর পতনের পিছনের প্রকৃত কারণগুলি ছিল ভিন্ন – সম্পূর্ণ ভিন্ন – গভীরে প্রোথিত সামাজিক বিভাজন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাবেকী সংঘাত ও তাঁর নিজের দলের অভ্যন্তরে বিভিন্ন গোষ্ঠীর কোন্দলের মধ্যেই কারণগুলি নিহিত আছে। সামাজিক শক্তিগুলি ও সংসদের অভ্যন্তরে তার প্রতিফলন হিসাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তির ভারসাম্য তাঁর বিপক্ষে চলে গিয়েছিল ও তাঁর পতন ঘটিয়েছিল।

সমগ্র ঘটনাটিকে বুর্জোয়া রাজনীতিকদের ক্ষমতার লালসা, নীতি-নৈতিকতার প্রশ্ন ও অর্থ-শক্তির ভূমিকাকে অতিরিক্ত বাড়িয়ে দেখার মধ্যে দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না। এগুলি সবই সাদামাটা মানুষের রাজনীতি সম্পর্কে বোঝাপড়া মাত্র এবং উদারপন্থী নৈতিকতাবাদীদের দৃষ্টিভঙ্গি, যা এটি বুঝতে অক্ষম যে রাজনৈতিক দলগুলি কিছু পেশাদার ব্যক্তির কৃত্রিম সৃষ্টি নয়, বরং আধুনিক সমাজের অপরিবর্তনীয় ও স্বাভাবিক সৃষ্টি, যার (অর্থাৎ বিভিন্ন দলগুলির) মধ্য দিয়ে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী ও স্তর তাদের স্বার্থগুলি গ্রন্থিবদ্ধ করে ও ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার জন্য পরস্পরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। ব্যক্তি রাজনীতিকদের লালসা, পার্থিব লাভ, অর্থ-শক্তি ইত্যাদি সবই সামাজিক শক্তিগুলির বিন্যাস-পুনর্বিন্যাসের সীমানার মধ্যেই কেবল কার্যকরী হয়ে থাকে। এখন আমরা ভারতীয় রাজনীতিতে ভি পি পরিঘটনাটির বিশ্লেষণ দিয়ে শুরু করব।

সর্বভারতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেসের বিকল্প হিসাবে একটি বুর্জোয়া কাঠামো গড়ে তোলার আন্তরিক প্রয়াসের জন্য ভি পি সিং-কে সাধুবাদ জানাতেই হয়। বিরোধী রাজনীতিতে সরে আসার পর তিনি নির্দয়ভাবে তাঁর কংগ্রেসী অতীতকে প্রত্যাখ্যান করে নিজেকে লোহিয়া ও জয়প্রকাশ ঘরানার অ-কংগ্রেসী উত্তরসুরী হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেন ও এর মধ্য দিয়ে বিরোধীপক্ষের স্বাভাবিক নেতা রূপে নিজেকে তুলে ধরেন। জরুরি অবস্থার সময় সঞ্জয় গান্ধীর এক নতুন সংগ্রহ হিসাবে তিনি যাত্রা শুরু করেন, তারপর উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীরূপে উত্থানের সময় ‘সংঘর্ষ অভিযান’ পর্বে মূলত পশ্চাদপদ জাতির শত শত যুবককে হত্যা (ঘটনাচক্রে মুলায়ম সিং-এর সঙ্গে ভি পি সিং-এর বৈরিতা ঐ সময় থেকেই চলে আসছে), তারপর রাজীব গান্ধীর মন্ত্রীসভার অর্থমন্ত্রী রূপে রাজীবের অর্থনৈতিক উদারনীতিকরণের পদক্ষেপকে অতি উৎসাহে ওকালতি করা এবং শেষপর্যন্ত ভোল পাল্টে বিরোধীপক্ষের মধ্যমণিতে তাঁর রূপান্তর ইত্যাদি এ দেশের রাজনীতিতে নিজে থেকেই এক ক্যারিশমা বহন করে। বামপন্থীদের তিনি তাঁর স্বাভাবিক মিত্র হিসাবে দাঁড় করান ও কংগ্রেসী স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধশক্তি হিসাবে ১৯৮০-র দশকে গড়ে ওঠা বিভিন্ন অ-পার্টি রাজনৈতিক সংগঠন ও তৃণমূলের আন্দোলনের সঙ্গে একটা সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং এদের সবাইকে মূল রাজনৈতিক স্রোতে নিয়ে আসেন। সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, কংগ্রেস বিরোধী সমস্ত উল্লেখযোগ্য আঞ্চলিক দলগুলিকে নিয়ে তিনি সাফল্যের সঙ্গে জাতীয় মোর্চা গঠন করেন। ভি পি সিং এমন একটি রাজনৈতিক সমন্বয়ের উপর জোর দেন যা শুধু সংসদের মধ্যেই কংগ্রেসকে সংখ্যাগতভাবে অপসারিত করবে না, বরং বর্তমান ভারতীয় পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এক নতুন রাজনৈতিক বিন্যাসেরও সংকেত জানাবে। কিন্তু বিজাতীয় সৈন্যদলের একজন কমাণ্ডার হওয়ার কারণে জনতা দলের মধ্যে তাঁর অবস্থান সবসময়ই ভঙ্গুর ছিল। সর্বাধিনায়কের পরিবর্তে নিজ নিজ গোষ্ঠীপতিদের প্রতি প্রথম আনুগত্যপূর্ণ বিভিন্ন সাবেকী গোষ্ঠীর এক ঢিলেঢালা সমন্বয় ছিল জনতা দল। তিনি অবশ্য আশা করেছিলেন একটি গোষ্ঠীকে অন্য গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে নিজ দলের গোষ্ঠী বিভাজনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন। অধিক গুরুত্বপূর্ণ হল, নিজ দলের ভিতর থেকে আসা কোনো চ্যালেঞ্জের বিরুদ্ধে জাতীয় মোর্চায় তাঁর বশংবদদের কাজে লাগানোর তিনি আশা রেখেছিলেন। তাঁর প্রাথমিক পরিকল্পনায় বিজেপির কোনো স্থান ছিল না ও সচেতনভাবেই তিনি নির্বাচনী অভিযানের সময় বিজেপি থেকে একটা দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন।

গুজরাট থেকে বিহার অবধি আ জ গ র সূত্রটি ভালোই কাজ দিয়েছিল। পশ্চাদপদ জাতিগুলির কুলাক লবির একটা ভালো সংখ্যক অংশ ও তাঁর নিজস্ব রাজপুত জাতির পুরোনো ও নতুন গ্রামীণ মধ্যবিত্ত অংশ জনতা দলের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল। ভাগলপুর দাঙ্গা ও বিতর্কিত শিলান্যাস সিদ্ধান্তের পর কংগ্রেস থেকে বিচ্ছিন্নতা অনুভব করে মুসলিমরা জনতা দলের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। উড়িষ্যায় জনতা দলের মতো সংগঠনই বরাবর কংগ্রেসের স্বাভাবিক বিরোধীশক্তি। সেখানে কংগ্রেস বিরোধী হাওয়া থেকে জনতা দলই সর্বাপেক্ষা লাভবান হয়েছিল। পশ্চিমবাংলায় ১৯৮৪-র নির্বাচনে বামপন্থীরা কংগ্রেসের কাছে যে জমি হারিয়েছিল, তা পুনরুদ্ধার করে এবং এখানে ওখানে হার-জিতের মধ্য দিয়ে সংসদে একটা ভালো প্রতিনিধিত্বও অর্জন করে।

যদিও ভি পি সিং দক্ষিণ ভারতে সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছেন। দক্ষিণ ভারতের ঢেউ ছিল উত্তর ভারতের ঠিক বিপরীত ও আরও প্রবল মাত্রার।

দক্ষিণ ভারতের ভোটের আচরণ কারো কাছেই প্রত্যাশিত ছিল না ও আজও তা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধাঁধাতেই রেখেছে। এর সাথে যুক্ত হয়ে মহারাষ্ট্রের সন্তোষজনক ফলাফল কংগ্রেসকে সংসদের একক বৃহত্তম দলে পরিণত করে।

অপর অপ্রত্যাশিত বিকাশ হল উল্কার মতো বিজেপির উত্থান। নিজের শক্তির উপর দাঁড়িয়ে বিজেপি সবসময়েই উত্তর ও পশ্চিম ভারতে একটি শক্তিশালী দল এবং মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও হিমাচল প্রদেশের মতো রাজ্যে বিজেপি কংগ্রেসের অন্যতম সাবেকী প্রতিদ্বন্দ্বী। এই রাজ্যগুলিতে প্রতিটি কংগ্রেস বিরোধী ঢেউ-এর অর্থ বিজেপির উত্থান। যদিও ১৯৮৯-এর নির্বাচনে বস্তুত সাংগঠনিক জাল-এর সুবাদে ও রাম তাসকে ব্যবহার করে বিজেপি নেতৃত্ব আশাতিরিক্ত সফলতাই লাভ করেছিল। ভোটের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রথাগত প্রভাবের বাইরে বিভিন্ন স্থানেও বিজেপি সাংগঠনিক বিস্তৃতি ঘটিয়েছে ও কৃষক, পশ্চাদপদ জাতি, দলিত ও আদিবাসীদের মধ্যেও বিজেপির শাখা-প্রশাখার বিস্তার হয়েছে। বাম দলগুলি, একমাত্র যারা অবিচল বিজেপি বিরোধী শক্তি তাদের ‘বিজেপি-কে বিচ্ছিন্ন কর’ স্লোগান এই অগ্রগতির মুখে ধরাশায়ী হয়েছে। বিজেপির এই সাফল্য মোটামুটি তার স্বাধীন শক্তি প্রদর্শন এবং রাম তাস তাকে ভালো লভ্যাংশ এনে দিয়েছে।

এইভাবে প্রথমত একক বৃহত্তম দল হিসাবে কংগ্রেসের উত্থান ও যে কোনো পরিস্থিতিকে নিজের অনুকূলে নিয়ে আসার ঐ তুরুপের তাসটিকে নিজের দখলে রাখতে পারা এবং দ্বিতীয়ত বিজেপির আশ্চর্যজনক অগ্রগতি যা তাকে তুরুপের তাস ব্যবহার করার আকাঙ্খা জাগিয়েছে, ইত্যাদি প্রতিকূল শর্তগুলি গোড়া থেকে ভি পি সিং-কে প্রতিবন্ধী করে তোলে। এর উপর, সংসদের অভ্যন্তরে জাতীয় মোর্চার আঞ্চলিক সহযোগীদের গুরুত্বপূর্ণ সমর্থন থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলে জনতা দলের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বকে হ্রাস করার তাঁর ক্ষমতা একদম কমে যায়।

এখানে, বিজেপি ও বাম দলগুলির বস্তুগত অবস্থান ও বিষয়ীগত আকাঙ্খার মধ্যেকার এক গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যের কথা আমাদের স্মরণ করতে হবে। পশ্চিমবাংলা ও কেরলের মতো বামদলগুলির সাবেকী দুর্গে জনতা দল প্রায় অস্তিত্বহীন, আর জনতা দলের দুর্গগুলিতে বামদেরও কোনো শক্তিশালী উপস্থিতি নেই। জাতীয় রাজনীতিতে বাম দলগুলি বাস্তবিকভাবেই জনতা দলের পোঁ-ধরায় পরিণত হয়েছে। হিন্দিবলয় সহ অন্ধ্র, উড়িষ্যা, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু ইত্যাদি রাজ্যগুলিতে সম্প্রসারণ ঘটানোর যে স্বপ্নই তারা দেখুন না কেন, এটা তাদের করতে হয়েছে জনতা দল ও জাতীয় মোর্চার সহযোগীতার লেজুড়বৃত্তির পথ অনুসরণ করেই, আর এ জন্যই বাম দলগুলি জনতা দলের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্ক বজায় রেখে চলবে।

বিজেপির ক্ষেত্রে অবস্থাটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিজেপির কাজের ক্ষেত্রগুলি জনতা দলের কাজের ক্ষেত্রগুলির সঙ্গে মিশে আছে এবং এর অস্তিত্ব রক্ষা ও বিস্তার একমাত্র জনতা দলের মূল্যেই হতে পারে। এই দুই দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা তাই অন্তর্নিহিত বস্তুগত ঘটনা। এর উপর আক্রমণাত্মক হিন্দুরাষ্ট্র দর্শনের দ্বারা পরিচালিত হয়ে এবং তাত্ত্বিক ও প্রচারকদের এক ব্যাপক বিস্তৃত সাংগঠনিক জাল এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের এক সুসংগঠিত ক্যাডার বাহিনীর মদতপুষ্ট হয়ে বিজেপি ভারতীয় রাজনীতির কেন্দ্রীয় মঞ্চ দখলের আশা রাখে। ইরান ও পাকিস্তানে ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান, পূর্ব ইউরোপে কমিউনিজমের পতন, সোভিয়েত ইউনিয়নে গুরুতর ধাক্কা ও সেখানে চার্চের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন – এসবই বিজেপি-কে সহায়ক মতাদর্শগত পরিমণ্ডল সরবরাহ করেছে। ভারতের ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য ধর্মকে ব্যবহার করে সাফল্য পাওয়ায় বিজেপির উচ্চাকাঙ্খা আরও সাহসী হয়ে উঠেছে।

অনিশ্চিত চরিত্রের নবম লোকসভা ভারতীয় সমাজের প্রধান প্রধান দ্বন্দ্ব ও উঠে আসা প্রবণতাগুলির এক পূর্ণাঙ্গ প্রতিফলন। দক্ষিণ বনাম উত্তর ভারতের দ্বন্দ্ব যদি কংগ্রেসের পক্ষে ও বিপক্ষে ঢেউ হিসাবে প্রতিফলিত হয়ে থাকে, তবে হিন্দু মৌলবাদের উত্থান বিজেপির উত্থানের মধ্য দিয়ে প্রতিনিধিত্ব করছে। আর সাবেকী বামপন্থীরা স্পষ্টতই জনতা দলের পোঁ-ধরার ভূমিকা নিয়েছে। অকালি দল (মান গোষ্ঠী) পাঞ্জাবে বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছে, বহুজন সমাজ পার্টি ও এমনকি আইপিএফ তাদের স্বাধীন ক্ষমতায় সংসদে প্রতিনিধিত্ব অর্জন করেছে।

ভি পি সিং-এর বাছবিচার করার কোনো সুযোগ ছিল না। বিজেপির সমর্থন ছাড়া সরকার গঠনের অন্য কোনো পথ তাঁর কাছে খোলা ছিল না। জনগণের চাপের নামে রাতারাতি সূত্রায়নগুলি পাল্টে গেল।

এটি তিনি উপলব্ধি করলেন মূল্যবোধ-নির্ভর রাজনীতি বলে কিছু নেই, বরং ব্যবহারিক রাজনীতির বাধ্যবাধকতার উপরই মূল্যবোধ নির্ভর করে থাকে। আর রাজনীতি দ্বন্দ্বগুলির সামাল দেওয়ার ক্ষমতা ছাড়া অন্য কিছু নয়। যে বাম দলগুলির কাছে কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যে, নাম্বুদিরিপাদের ভাষায় কলেরা ও প্লেগের মধ্যে, পার্থক্য টানার কিছুই ছিল না, তারা অদ্ভুত ডিগবাজি খেয়ে বিজেপি-কে বিচ্ছিন্ন কর শ্লোগানের পরিবর্তে বিজেপির সঙ্গে আঁতাত গড়ে তোলার স্লোগান দিল। বিজেপি একটি রাজনৈতিক দল আর বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরঙ দল, শিবসেনা প্রভৃতি সাম্প্রদায়িক সংগঠন এই বলে তাদের মধ্যে পার্থক্য টানার চেষ্টা হল। রাজেশ্বর রাও এমনকি বিজেপির কর্মসূচিতে সদর্থক সামাজিক-অর্থনৈতিক অন্তর্বস্তু আবিষ্কার করলেন। এই আঁতাতকে ন্যায়সঙ্গত করে তোলার জন্য জাতীয় ঐক্য ও সংহতির স্লোগান হাতে কাছে পাওয়া গেল এবং আদবানী বাস্তবিকই বললেন, জাতীয় ঐক্য, পাকিস্তান ও পাঞ্জাব প্রশ্নে জনতা দলের থেকেও বিজেপির চিন্তাভাবনা বাম দলগুলির চিন্তাভাবনার সঙ্গে অনেক বেশি মিল খুঁজে পায়। পরোক্ষে, বাম নেতারা বিজেপি-কে এই সরকারের প্রতি দায়বদ্ধ করা ও তার মাধ্যমে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করা থেকে একে নিবৃত্ত করা ও একইসঙ্গে বিজেপি-কে সরকারের বাইরে রাখতে পারার তাদের রাজনৈতিক সাফল্য সম্পর্কে দাবি করতে থাকেন। ইতিহাস দেখিয়ে দিয়েছে বস্তুত এ সবই জনগণের সঙ্গে রাজনৈতিক প্রতারণা। বিজেপি সম্পর্কে একটি নির্দিষ্ট মোহ সৃষ্টি করে জনগণকে সতর্কতাহীন করে তোলা হয়েছে।

যে তাস বিজেপি-কে প্রভূত লভ্যাংশ এনে দিয়েছে সেই রামকে বিজেপি পরিত্যাগ করবে এটি আশা করা ও বামেদের ঢঙেই জনতা দল সরকারকে বিজেপি সেবা করবে এটি বিশ্বাস করা নিতান্ত ছেলেমানুষী। প্রথম দিন থেকেই জনতা দল সরকারকে নিঃশর্ত সমর্থন করতে অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে বিজেপি তার উদ্দেশ্য স্পষ্ট তুলে ধরেছিল এবং আদবানী ঘোষণা করেছিলেন যে তারা এই সরকারের ব্রেক ও এ্যাক্সিলেটার হিসাবে কাজ করবেন। ঘটনাগুলি পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী এগিয়েছে মাত্র। বামরা যদি কোনো ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হয়, তবে অন্য কেউ নয় তাদের নিজেদেরই প্রদর্শিত রাজনৈতিক সারল্য, রাজনৈতিক প্রয়োজনবাদ ও ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে লঘু করে দেওয়ার অপরাধের জন্য নিজেদের দোষারোপ করতে হবে। আমি এখনও মনে করি বামদের পক্ষে সবথেকে ভালো কৌশল হতো জনতা দল ও বিজেপি-কে সরকার গঠনে অনুমতি দেওয়া ও নিজেদের হাতে ‘ব্রেক ও এ্যাক্সিলেটার’-এর ভূমিকাটি রেখে দেওয়া। এটি বামপন্থীদের স্বাধীন চরিত্রকেই আরও উজ্জ্বল করত।

ভি পি সিং তাঁর দ্বিতীয় দফার রাজনৈতিক জীবন রাজনীতি-নির্ভর মূল্যবোধ ও দ্বন্দ্ব সামাল দেওয়ার দক্ষতা নিয়ে শুরু করেছিলেন। তাঁর প্রধানমন্ত্রীত্ব অর্জনও ছিল দেবীলালকে চন্দ্রশেখরের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর চতুর কূটকৌশলের ফসল। প্রতিটি সমর্থন তার নিজের মূল্য আদায় করে ছাড়ে ও এক সন্ধিক্ষণে সমস্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও অদম্য দেবীলাল ও চৌতালাকে বশে রাখা তাঁর পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ল। একের পর এক সংকট জনতা দলের ভিতকে কাঁপিয়ে দেয় ও শেষ পর্যন্ত তাকে দেবীলালের সঙ্গ ছাড়তে হল।

ব্যাপক জনগণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয় এমন সমস্ত গুরুত্বহীন নির্বাচনী ইস্তাহারের ঘোষণাগুলিকে কার্যকরী করতে তিনি তৎপর হয়ে ওঠেন। বোফর্সের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে তাঁর সরকার নতুন কোনো প্রমাণ হাজির করতে ব্যর্থ হয়, পরিবর্তে তাঁর শাসন বোফর্স মামলায় সন্দেহের কাঁটাকে রাজীব গান্ধীর থেকে অন্যত্র সরিয়ে দিয়েছে মাত্র।

পাঞ্জাব প্রশ্নে কোনো উদ্যোগ গ্রহণে তাঁর সরকারের ব্যর্থতা ও অকালি দল (মান গোষ্ঠী)-এর সঙ্গে দ্রুত সম্পর্ক ভেস্তে যাওয়ায় পাঞ্জাব পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়। কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় বিজেপির নির্ধারক উপস্থিতি ও ৩৭০ ধারা বাতিলের জন্য এর অনমনীয় দাবির প্রতিক্রিয়ায় কাশ্মীরে উগ্রপন্থী কার্যকলাপ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়। ভি পি সিং সমস্যাটিকে বিজেপি প্রদর্শিত পথে জগমোহনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করেছিলেন ও এইভাবে কাশ্মীর সমস্যার রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সমাধানের সমস্ত বাহ্যিক কথাবার্তাও শেষ হয়ে যায়।

অর্থনৈতিক অবস্থার আরও অবনতি ঘটে ও মূল্যবৃদ্ধি আকাশছোঁয়া হয়ে দাঁড়ায়। রাজীব আমলের অর্থনৈতিক সমস্যাগুলি আরও জটিল হয় ও উপসাগরীয় সংকট যুক্ত হয়ে ভারতীয় অর্থনীতি চূড়ান্ত পতনের মুখে এসে দাঁড়ায়। সেই ভয়াবহ সম্ভাবনা আজ দেখা দিয়েছে যখন ভারত ঋণ পরিশোধে অক্ষমদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে চলেছে।

ভি পি সিং-এর সর্বদলীয় ঐকমত্যের কাজের ধরন অচিরেই প্রহসনে পরিণত হয়। একদিকে, চূড়ান্ত অর্থনৈতিক দুরাবস্থার মধ্যে কাজ করার বাধ্যতা ও পর্দার পিছনে অপেক্ষমান কংগ্রেসের দ্বারা ঘেরাও ও অন্যদিকে, নির্ধারক ভূমিকা পালনের জন্য বিজেপির মরীয়া প্রচেষ্টা ও দলের ভিতর থেকে চন্দ্রশেখর-দেবীলাল শিবিরের ভীতিপ্রদর্শন এসব থেকে ভি পি সিং-কে হঠাৎ মণ্ডল কমিশন রিপোর্ট কার্যকরী করার ঘোষণার দিকে পরিচালিত করে। স্পষ্টতই এটি নিজের জন্য এক রাজনৈতিক ক্ষেত্র তৈরি করে নেওয়া ও জনতা দলের মধ্যে নিজ অবস্থানকে সুরক্ষিত করে সমস্ত প্রতিপক্ষকে রক্ষণাত্মক অবস্থানে ঠেলে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই করা হয়েছিল। সমস্ত ঘটনাবলী প্রমাণ করেছে তিনি হিসাবে গুরুতব ভুল করেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত মণ্ডল কমিশন রিপোর্ট কার্যকরী করাই তাঁর পতনের সংকেত ছিল। নিজের রাজপুত জাতির মধ্যে তাঁর সামাজিক ভিত হ্রাস পেল ও হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থানের শক্তিশালী জাঠগোষ্ঠী সহ অন্যান্য কিছু উঁচুজাতের মানুষ যারা এতদিন হিন্দি বলয়ে জনতা দলের সামাজিক ভিত্তি গড়ে তুলেছিল তারা আনুগত্য পাল্টে ফেললো এবং চন্দ্রশেখর-দেবীলাল গোষ্ঠী প্রাদপ্রদীপের আলোয় চলে এলো।

যে ব্যক্তিকে ছাত্র-যুবকরা, বিশেষত দিল্লীর আশপাশ অঞ্চলের, তাঁদের প্রবক্তা হিসাবে প্রচণ্ড বিশ্বাস করেছিল ও কাজের অধিকারকে সংবিধানের মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার যার ঘোষণা থেকে আশা করেছিল চাকরির সুযোগ সুবিধা আরও বৃদ্ধি পারে, সেই ব্যক্তির দ্বারা তারা বিশ্রীভাবে প্রতারিত হয়েছে বলে অনুভব করল। ঐ ব্যক্তির মধ্যে তারা এক ফন্দিবাজ রাজনীতিককে দেখতে পেল, যিনি তাদের চাকরির সামান্য সুযোগটুকু পর্যন্ত ছিনিয়ে নিয়েছেন। তাদের চূড়ান্ত হতাশার প্রতিফলন ঘটলো বহুসংখ্যক মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত যুবক-যুবতীর ‘আত্মাহুতি’র মধ্য দিয়ে, যে রূপটি তাদের দিক থেকে অস্বাভাবিক। মণ্ডল রিপোর্ট কার্যকরী করার মধ্য দিয়ে বড় বড় ধরনের কিছু পশ্চাদপদ জাতির মধ্যে নিজস্ব অবস্থানকে সংহত করলেও এটি কোনোভাবেই তাঁর পক্ষে নতুন কোনো সংযোজন ঘটাতে পারেনি। অপরদিকে, তিনি সামাজিক সমর্থনের একটি ভালো অংশ হারান। ছাত্র-যুবকদের ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ হিসাবে আত্মাহুতির ঘটনাগুলি সরকারি ক্ষমতায় তাঁর টিকে থাকার প্রশ্নে এক নৈতিক প্রশ্ন উত্থাপন করল।

শক্তিশালী সংবাদমাধ্যমগুলি তাঁর বিপক্ষে দাঁড়াল এবং কংগ্রেস, বিজেপি ও এর সাথে চন্দ্রশেখর-দেবীলাল শিবির ভি পি-র দুরাবস্থাকে সুকৌশলে কাজে লাগাল।

ভি পি সিং-এর যুক্তির ধারা হল সবুজ বিপ্লব ইত্যাদির মধ্য দিয়ে কিছু পশ্চাদপদ জাতি ইতিমধ্যেই যথেষ্ট অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে এবং তাই আমলাতন্ত্রের উপরের স্তরে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পাওয়ারও তারা অধিকারী। ঐতিহাসিকভাবে, যেহেতু এরা সামাজিক ও শিক্ষাগত প্রশ্নে পশ্চাদপদ ছিল, তাই দীর্ঘসময় এরা যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রতিযোগিতা করতে পারে না। এদের প্রতিনিধিত্ব একমাত্র চাকরি সংরক্ষণের মাধ্যমেই সুনিশ্চিত করা যায়।

তাঁর আরও যুক্তি হল, এটা শুধু সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্ন নয়, বরং সামাজিক সমতারও প্রশ্ন। “পরিবারের মধ্যে বড় ভাই যেভাবে অধিক ক্ষমতা ও স্বাধীনতা ভোগ করে, ছোটো ভাইকেও তেমনি কিছু অধিকার দিতে হবে ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় তাকে সামিল করতে হবে।”

বুর্জোয়া রাজনীতিকের দৃষ্টিভঙ্গিতে সীমাবদ্ধ হওয়ায় তার চিন্তার মূল বিষয় ছিল পশ্চাদপদ জাতিগুলির যে অংশ ইতিমধ্যেই যথেষ্ট অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠেছে তাদের শাসন ব্যবস্থার মধ্যে যুক্ত করে নেওয়া, অর্থাৎ কুলাক লবির প্রতিনিধিত্বের স্বার্থ। সাধারণ জনগণ তথা বিপ্লবের নামে নিজেদের সঙ্কীর্ণ শ্রেণীস্বার্থ পূরণ করাটাই সর্বদা বুর্জোয়া রাজনীতির কৌশল। অবশ্য আত্তীকরণের এই প্রক্রিয়া একটি বস্তুগত স্বাভাবিক প্রক্রিয়া এবং ভি পি সিং থাকুন কী নাই থাকুন এই প্রক্রিয়া চলবেই – কখনও উত্তেজনার মধ্য দিয়ে, অন্য সময় এদিক ওদিক সমঝোতার মাধ্যমে। জাতিগুলির মধ্যে শ্রেণী গঠন প্রক্রিয়া, শ্রেণী মেরুকরণ ও শ্রেণী সংগ্রামের এক ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত থেকে এই পদক্ষেপকে সমর্থন করা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। কিন্তু ভি পি সিং-এর মুখের কথায় বিশ্বাস করে কেউ যদি মণ্ডল কমিশনের রিপোর্ট কার্যকরী করাকে কোনো ধরনের বিপ্লব বলে মনে করে ও তার পিছনে সমাবেশিত হয়, তবে তা হবে রাজনৈতিক নির্বুদ্ধিতা ও কমিউনিস্টদের শ্রেণী অবস্থানকে অস্বীকার করার সমতুল।

পার্টি পরিচিতি অস্বীকার করে সর্বভারতীয় স্তরে উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণের রাজনৈতিক মেরুকরণ ঘটবে বলে যে আশা ভি পি সিং করেছিলেন তা লোহিয়াপন্থী রাজনীতিকদের ভুল ও সঙ্কীর্ণ বিচারবুদ্ধির প্রতিফলন। অত্যন্ত নির্বুদ্ধিতার সঙ্গে ভি পি সিং বিবেক ভোটের দাবি করে আশা করেছিলেন এই ধারাতেই কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যে ভাঙন ধরবে। উচ্চবর্ণের-নিম্নবর্ণের জাতিদ্বন্দ্ব নিশ্চিতভাবেই ভারতীয় সমাজের একটি অন্যতম সামাজিক দ্বন্দ্ব, বিশেষত বিহারের মতো কিছু রাজ্যে এটি মূল স্রোতের রাজনীতিকে নির্ধারণ করে। কিন্তু এটি মোটেই সর্বব্যাপী দ্বন্দ্ব নয়। বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে দ্রাবিড় আন্দোলনও উচ্চবর্ণের জাতিগুলির বিরুদ্ধে নিম্নবর্ণের জাতিগুলির উত্থান বলে চিহ্নিত করা যায়, কিন্তু সেখানেও তামিল জাতিসত্তার পরিচিতি, দক্ষিণ ভারতীয় পরিচিতি আরও বড় ভূমিকা পালন করে। দ্রাবিড় আন্দোলনও ডিএমকে-এআইডিএমকে – এই দুই প্রধান ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে এবং সম্প্রতি বানিয়াদের মতো অন্যান্য পশ্চাদপদ জাতিগুলির উত্থান একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

এরপর আবার, পশ্চাদপদ জাতিগুলি সমচরিত্রের একক সত্তা হিসাবে কাজ করে না, তারা নিজেরাই পরস্পরের শত্রুতায় অবতীর্ণ হয়, এমনকি বিহারের মধ্যেই। এর ফলে প্রায়শই দেখা যায় কোনো কোনো উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণের আঁতাত ঐ ধরনের অন্য কোনো আঁতাদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে। পশ্চিমবাংলার মতো কিছু রাজ্যে শক্তিশালী পশ্চাদপদ জাতির কোনো স্পষ্ট বর্গ দেখা যায় না এবং সেখানে উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণের এই ধরনের সংঘাতও নেই।

কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন উত্তরপ্রদেশে মুলায়ম সিং যাদব হচ্ছেন পশ্চাদপদ জাতিগুলির পশ্চাদপদ অংশের প্রতিনিধি ও সম্ভবত জাঠ কুলাক লবির বিরুদ্ধে গরিব ও মধ্য কৃষকদের সংগঠিত করার চেষ্টা করছেন, এবং মণ্ডল কমিশন হোক আর রামজন্মভূমিই হোক সবদিক থেকেই তাঁকে ভি পি সিং-এর দৃঢ় মিত্র হিসাবে মনে করা হয়েছিল। যদিও তাদের মধ্যেকার সাবেকী রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাই আজ মুখ্য হয়ে দেখা দিয়েছে এবং ভি পি সিং-এর প্রচেষ্টাগুলিও ছিল মুলায়ম সিং-এর মূল্যে নিজের জন্য উত্তরপ্রদেশে এক পাকাপোক্ত এলাকা গড়ে তোলা। মুলায়ম-অজিত সিং বিবাদ অতি পরিচিত এক ব্যাপার এবং উত্তরপ্রদেশে বাস্তবিকই জনতা দল এই ধারাতেই বিভক্ত হয়েছে। মুলায়ম সিং-এর এই অভিযোগের মধ্যে কিছু সত্য আছে যে ভি পি সিং বিভিন্ন ফন্দি এঁটে তাঁকে উৎখাত করার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। মুলায়ম সিং-চন্দ্রশেখর-কাঁসিরাম আঁতাত উত্তরপ্রদেশে বেশ কিছুদিন ধরেই ভি পি-অজিত সিং আঁতাতের বিরুদ্ধে একটা আকার ধারণ করছিল। একনিষ্ঠ কোনো রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকই ১২ অক্টোবর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সমাবেশে একই মঞ্চে এই তিনের একত্র উপস্থিতিকে অস্বীকার করতে পারেন না। সমাবেশটি একই সঙ্গে ছিল জনতা দলের মধ্যে ক্রমবর্ধমান গোষ্ঠী সংঘাতের সঙ্কেত। আশ্চর্যজনকভাবে, জ্যোতি বসু-ইন্দ্রজিৎ গুপ্তের মতো ভদ্র মহোদয়গণ যারা ঐ মঞ্চকে অলঙ্কৃত করে মুলায়মের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলেন তাঁরা সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী এই ঢক্কানিনাদের পেছনে প্রকৃত রাজনীতিকে লক্ষ্য করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। আধুনিক রাজনৈতিক পার্টিগুলি শুধু উচ্চবর্ণ নিম্নবর্ণের পার্টি নয় বা তা হতে পারে না। বিভিন্ন জাতি ও শ্রেণীর সমন্বয়ই এই পার্টিগুলির মধ্যে ক্রিয়াশীল থাকে এবং এদের সম্মিলিত যোগফলই নির্দিষ্ট জাতি ও শ্রেণীগুলির প্রতি বিশেষ সন্ধিক্ষণে প্রকাশ্যভাবে দলগুলির পক্ষপাতিত্বকে প্রতিফলিত করে এবং এটিই মৌলিক দিক। এরপর আবার তারা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, হিন্দু ও উচ্চবর্ণের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখানোই নিশ্চিতভাবে কংগ্রেসের মৌলিক দিক কিন্তু অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়ায় এটি প্রকাশ পায়।

মণ্ডল কমিশন উত্তর ভারতে বিজেপি-কে কিছু পরিমাণে শঙ্কিত করে তোলে, কেননা এটি বিজেপির হিন্দু ঐক্যের অভিযানের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছিল। বিজেপির দিক থেকে রথ যাত্রার পরিকল্পিত উদ্যোগ ও একে এক চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া নিশ্চিতভাবেই ছিল প্রত্যাঘাত। আদবানী ঘোষণা করেছিলেন তার গ্রেপ্তার ক্ষতিই ডেকে আনবে। সেই ভবিষ্যৎবাণী মিলে গেছে। কেন্দ্রে ভি পি সরকারের পতন ও বিভিন্ন গোষ্ঠীতে জনতা দলের বিভাজন হয় এবং একমাত্র বিহারেই ভি পি গোষ্ঠী ক্ষমতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। সংসদে বিজেপি প্রধান বিরোধী দলে পরিণত হয়েছে। সামাজিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বগুলির যোগফল ইতিমধ্যেই ভি পি-র বিরুদ্ধে কার্যকরী হতে শুরু করেছিল। বিজেপির সমর্থন প্রত্যাহার করা এর কারণ ছিল না বরং এর পরিণতি ছিল। ভি পি সরকারের পতনে এটি প্রয়োজনীয় অনুঘটকের কাজ করেছে। এটি কেবলমাত্র বিজেপি-শিবসেনা আঁতাতের ৯০ জনের মতো সদস্যের সমর্থন প্রত্যাহারের প্রশ্ন নয় বরং একইসঙ্গে এটি ছিল জনতা দলের বিভাজন ও কংগ্রেসের সঙ্গে নতুন সমীকরণ গড়ে ওঠার প্রশ্ন।

চন্দ্রশেখর-কংগ্রেস(ই)-র আঁতাত বাস্তবিকই খিড়কি পথে কংগ্রেস শাসনের প্রত্যাবর্তন। অনিবার্যভাবেই এটি এক অস্থায়ী আঁতাত, কেননা দেবীলাল ও জনতা দল(এস)-এর একটি অংশ কংগ্রেসের সঙ্গে দীর্ঘদিন এই সহযোগিতা চালিয়ে যেতে পারে না, এমনকি চন্দ্রশেখর যদি কংগ্রেসে মিশেও যান। নির্বাচনের সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে ও জনগণের সংগ্রামগুলি গড়ে তোলার জন্য আমাদের তাই জনগণের কাছে যেতে হবে।

ভি পি সিং-এর জনতা দল ও বাম দলগুলি স্বাভাবিক বিরোধী পক্ষের আসনে ফিরে এসেছে, আমরা তাদের জন্য আগে থেকেই সেখানে অপেক্ষা করছিলাম। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, আমাদের সঙ্গে তাদের যৌথ কার্যকলাপ, সহযোগিতা ও আঁতাতের সম্ভাবনা আরও বড় মাত্রায় সৃষ্টি হয়েছে এবং এ সমস্ত সম্ভাবনাগুলিকে আমাদের পুরোপুরি কাজে লাগানোর চেষ্টা করতে হবে। যদিও এখানে একটা সতর্কবার্তা উচ্চারণ করা ভালো। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা ও তার পরিচালক বিজেপি ভারতীয় সমাজের বুনোটকে ধ্বংস করে চলেছে। বাম দলগুলি এ বিষয়টিকেই তাদের প্রচার কর্মসূচির একমাত্র করে তুলেছে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে ব্যবহারিক রাজনীতিতে কোনো না কোনো বুর্জোয়া-জমিদার আঁতাতের লেজুড়বৃত্তির কৌশলকে কূট কৌশলে ফেরী করাই এর লক্ষ্য। মৌলিক দাবিগুলিতে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ ও সমাবেশিত করে গণতান্ত্রিক ও জঙ্গী গণআন্দোলন গড়ে তুলে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিপদকে প্রতিহত করার বামদের সবথেকে কার্যকরী ও বহু পরীক্ষিত চলতি রূপগুলিকে ব্যবহার করার প্রশ্নকে তারা বিদায় জানিয়েছে। এমনকি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে এ রূপগুলিকে বিবেচনা করতেও তারা রাজি নয়। সুতরাং বাম দলগুলি যখন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে তাদের সমস্ত আশা-ভরসা বুর্জোয়া রাজনীতিবিদদের উপর ছেড়ে দিয়ে নিজেরা মানবশৃঙ্খল, সেমিনার ইত্যাদি লোকদেখানো কর্মসূচিতে ব্যস্ত রয়েছে, তখন মৌলবাদ তৃণমূলে জনগণের মানসজগতে তার শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে চলেছে।

মতাদর্শগত আবহাওয়া, ভয়ানক নিরাশাজনক অর্থনৈতিক সংকট, ও ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের মাধ্যমে গড়ে ওঠা জাতীয় পরিচিতির অবক্ষয় ধর্মীয় মতাদর্শকে এক শক্তি হিসাবে সংগঠিত হতে উৎসাহ যুগিয়েছে, আর ধর্ম এনে দিয়েছে সান্ত্বনা, হিন্দু পরিচিতি জাতীয় পরিচিতি রক্ষার একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর কট্টর কমিউনিস্ট বিরোধী, ফ্যাসিবাদী লক্ষ্য পূরণে বিজেপি এক ধাপ এগিয়েই থাকছে। বামপন্থী ঐতিহ্যের পুনর্জাগরণ ও তার মতাদর্শগত রাজনৈতিক আক্রমণাত্মক অভিযান, জনগণের মৌলিক ও গণতান্ত্রিক ইস্যুগুলিতে জঙ্গী গণআন্দোলনই একমাত্র সাম্প্রদায়িকতাকে মুখোমুখি চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে। পশ্চাদপদ সামাজিক পরিস্থিতি, গণতান্ত্রিক চেতনার অভাব, অর্থনৈতিক দূরাবস্থা ফ্যাসিবাদের উর্বর জমি হিসাবে কাজ করে। এই একই অবস্থা বিপ্লবের অগ্রগতির পথেও সহায়ক হতে পারে যদি কমিউনিস্টরা সমস্ত ধরনের সমাজগণতান্ত্রিক ও সংসদীয় মোহকে ঝেড়ে ফেলে স্বাধীনভাবে ও জনগণের সঙ্গে একত্রে এগিয়ে যেতে সাহসী হয়।

ভি পি সিং, লালু যাদবরা আমাদের সঙ্গে কিছুদূর পর্যন্ত অগ্রসর হতে পারেন। এরা ও বিজেপি আবার বিরোধী পক্ষে চলে এসেছে এবং কংগ্রেস বিরোধিতার নামে ধাপে ধাপে নিজেদের মধ্যে সমঝোতা গড়ে তুলতে পারে। তাত্ত্বিক সূত্রায়ন করে ১৯৬০-এর দশকে লোহিয়াই এটি প্রথম শুরু করেছিলেন, তিনি তৎকালীন জনসংঘীদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। ১৯৭৭-এ এই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল জনতা পার্টির মধ্যে, আর ১৯৮৯-এ অন্যরূপে তা দেখা গেল। বিরোধীপক্ষে থাকার সময় তারা কাছাকাছি আসে আর ক্ষমতায় পৌঁছে তারা পরস্পর থেকে দূরে সরে যায়। বিষয়টি এভাবেই আছে। চূড়ান্ত কংগ্রেস বিরোধী, বিজেপি বিরোধী বর্তমান আকারের ধর্ম নিরপেক্ষ আঁতাত একইদিকে সরলরেখায় অগ্রসর হবে বলে সিপিআই(এম) এবং সিপিআই পুনরায় মোহ সৃষ্টি করে চলেছে। যদি বাহ্যিক লক্ষণগুলি দেখে আমরা নিজেদের বিপথে চালিত করি, যদি আমাদের সমস্ত উদ্যোগকে ভি পি সিং ও লালু যাদবের দলবলের করুণার উপর ছেড়ে দিই, তবে এক মর্মান্তিক আঘাত বামদের জন্য অপেক্ষা করে আছে। বুর্জোয়া ধর্মনিরপেক্ষ ও উদারনৈতিক শক্তির সঙ্গে কৌশলগত, সাময়িক ও ক্ষণস্থায়ী আঁতাতের জন্য দরজা খোলা রেখেও আমাদের স্বাধীনভাবেই অগ্রসর হতে হবে। বিপ্লবী পরিস্থিতি আমাদের অনুকূলেই বিকাশলাভ করেছে। শাসকশ্রেণীগুলি গভীর অস্থায়ীত্বের মধ্যে পড়েছে। সংসদবাদ ও আনুষ্ঠানিকতার চৌহদ্দিতে নিজেদের আটকে রাখার পরিবর্তে জনগণকে জাগ্রত করুন ও সাহসের সঙ্গে জঙ্গী গণআন্দোলন গড়ে তুলতে অগ্রসর হোন।

আসুন আমরা স্বাধীনতা ও গণসংগ্রামের পতাকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরি।