(৪ আগস্ট ১৯৯৮, শিলিগুড়িতে অনুষ্ঠিত এক আলোচনাসভায় প্রদত্ত ভাষণের অংশবিশেষ।
লিবারেশন, সেপ্টেম্বর ১৯৯৮ থেকে)

পোখরান বিস্ফোরণ পারমাণবিক অস্ত্র-বিরোধী আন্দোলনের নতুন পর্যায়ের জন্য এক প্রয়োজনীয় গতি সঞ্চার করেছে এবং হিরোসিমা দিবসের উদযাপনকে নতুন গতি প্রদান করেছে। এই গ্রহে মজুত পারমাণবিক অস্ত্রসম্ভারকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করার সংগ্রামেও তা নতুন প্রেরণা যুগিয়েছে। পারমাণবিক বোমা বিরোধী আন্দোলনের এক শান্তিকামী দিক আছে যা সমস্ত ধরনের পারমাণবিক বোমা ও যুদ্ধের বিরোধী। আমরা আন্তরিকভাবে সেই আন্দোলনের অংশীদার। কিন্তু সাথে সাথে পারমাণবিক বোমার পিছনে রাজনীতিও বোঝা দরকার।

১৯৪৫-এর ৬ আগস্ট হিরোসিমায় বোমা বর্ষণের উদ্দেশ্য যত না ছিল জাপানকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা, তার চেয়েও বেশি ছিল বিশ্ব রাজনীতিতে, বিশেষ করে এশিয়ার বুকে আমেরিকার হিংস্র আগমন ঘোষণা করা। এই ঘৃণ্য মার্কিনী কৌশল চরিতার্থ করার লক্ষ্যেই হিরোসিমার বুকে ঐ নিষ্ঠুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়েছিল। আজ আমরা জানি আমাদের কাছে এর অর্থ কী দাঁড়িয়েছে। কাজেই বোমার পিছনের রাজনীতি বুঝে ওঠা বোমার ধ্বংসাত্মক ক্ষমতাকে উপলব্ধি করার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

আজ বোমা বানানোর বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত পারদর্শিতা ও কৌশল নিয়ে যথেষ্ট উন্মাদনা দেখা যাচ্ছে। পারমাণবিক বোমার জনক রবার্ট ওপেনহাইমার কিন্তু তাঁর আবিষ্কারকে তেমন বিরাট কিছু হবে ভাবেননি। তিনি এবং আরও অনেক বৈজ্ঞানিক পারমাণবিক বোমা মজুতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান এবং আইনস্টাইনও বারবার তাঁর উৎকণ্ঠা ব্যক্ত করেছেন। পারমাণবিক বোমার বিপদকে মোকাবিলা করার জন্য আইনস্টাইন বিভিন্ন দেশকে নিয়ে এক সর্বোচ্চ বিচার সংস্থা গড়ে তোলার প্রস্তাব করেন।

অস্ত্রসম্ভার বিজ্ঞানের বিকাশের ইতিহাসে দেখা যায় আক্রমণাত্মক অস্ত্র আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে তার যথোপযুক্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থারও আবিষ্কার হয়েছে। কিন্তু পারমাণবিক বোমার বিশেষত্ব হল যে এক্ষেত্রে প্রতিরক্ষা বা প্রতিরোধের প্রশ্নই ওঠে না। পারমাণবিক বোমার একমাত্র প্রতিরোধ হল পাল্টা পারমাণবিক বোমা বানানো। এই জন্যই হিরোসিমার ক্রমান্বয়ী প্রতিক্রিয়ায় একের পর এক দেশ পারমাণবিক বোমা বানানোর দিকে এগিয়ে গেল।

আমেরিকার আজ সাত লক্ষ পারমাণবিক বোমা মজুত আছে। ঐ পারমাণবিক ব্যবস্থাপনার রক্ষণাবেক্ষণে তাকে প্রতি বছর ৩৫০০ কোটি ডলার – প্রতিদিনের হিসাপে ৯৬০ লক্ষ ডলার ব্যয় করতে হয়। গত পঞ্চাশ বছরে আমেরিকা পারমাণবিক কর্মসূচিতে মোট খরচ করেছে প্রায় ৫.৫ ট্রিলিয়ন ডলার। এই বিপুল পরিমাণের আন্দাজ পাওয়া খুব সহজ নয়, এমনকি আমাদের কল্পনাতেও নয়। এই পরিমাণকে এক ডলারের নোটে পরিণত করে যদি একটার সাথে আর একটাকে জুড়ে দেওয়া যায়, তবে যে শিকল তৈরি হবে তার দৈর্ঘ্য চাঁদে যাওয়া ও পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তনের দৈর্ঘ্যের সমান।

আমেরিকা এক সাম্রাজ্যবাদী দেশ এবং ঔপনিবেশিক ও নয়া-ঔপনিবেশিক শোষণের মাধ্যমে সে সারা পৃথিবী থেকে বিপুল উদ্বৃত্ত আদায় করে, আর তাই সহজে সে এই পরিমাণ খরচ করতে পারে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের (১৯৮৯ পর্যন্ত) এই সুবিধা ছিল না, এই বিপুল পরিমাণ খরচ তার পক্ষে ক্রমেই অসম্ভব হয়ে পড়ছিল। তাই আমরা দেখলাম, সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণ থেকে সাম্যবাদকে রক্ষা করার জন্য যে পারমাণবিক বোমার মজুত সে গড়ে তুলেছিল তা বিপরীত ফলাফল দেয় এবং সাম্যবাদের পতনের গুরুত্বপূর্ণ কারণ হয়ে ওঠে। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পক্ষে পারমাণবিক ব্যবস্থাপনার রক্ষণাবেক্ষণের সুবিপুল খরচ বহন করা শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়ে উঠল না। এটি করতে গিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর শিল্পক্ষেত্রকে চরম অবহেলা করা হল, তা অর্থনীতিতে বিকৃতির জন্ম দিল এবং শেষ পর্যন্ত সমাজতন্ত্রের পতন ঘটাল।

এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের দেশের কথায় আসা যাক। ক্ষমতায় আসার পর পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটানোই ছিল বিজেপি সরকার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই সিদ্ধান্তের পিছনে কিছু উদ্দেশ্য এবং বাধ্যবাধকতাও ছিল।

এই বিষয়ে বিজেপির আশু উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা যায় যে, তারা এই লক্ষ্য পূরণে বিস্ফোরণকে কাজে লাগিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা চেয়েছিল, দেশের অভ্যন্তরে উগ্রজাতীয়তাবাদী জিগির তুলতে, পাকিস্তানকে ভয় দেখাতে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে। মাও একবার পরমাণু বোমাকে বলেছিলেন কাগুজে বাঘ। অন্য দেশের বোমা কাগুজে বাঘ হয়েছে কিনা বলতে পারব না, কিন্তু ভারতের বোমার ক্ষেত্রে মাও-এর ভবিষ্যৎবাণী সত্য প্রতিপন্ন হয়েছে। উগ্র জাতীয়তাবাদের জিগির তোলা এবার তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। বিপরীতে এর বিরুদ্ধে ব্যাপক বিরোধিতা হয়েছে। উগ্র জাতীয়তাবাদ কথাটি এতদিন কমিউনিস্টদের অভিধানেরই অন্তর্ভুক্ত ছিল, তার মধ্যেও আবার সিপিআই(এমএল)-ই এই কথাটি বেশি ব্যবহার করত। অন্যান্য বাম দলগুলি কিছুদিন যাবৎ এর ব্যবহার ভুলে গিয়েছিল। কাশ্মীর প্রশ্নে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তাঁরা বুর্জোয়াদের ঐকতানে সুর মেলাতেন। এই প্রথমবার বুদ্ধিজীবীদের বড় অংশ আদবানির পাকিস্তান-বিরোধী প্ররোচনামূলক বিবৃতির বিরোধিতা করে সংবাদপত্রে লেখালেখি করেছেন। সংসদের মধ্যেও সরকারের উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে। ঐ সময়ে বাজপেয়ীকেও সংসদে রক্ষণাত্মক অবস্থানে দেখা যায়। এই সমস্ত কিছুই দেখিয়ে দেয় যে তারা যে ঐকমত্যের আশা করেছিল সেটি গড়ে ওঠেনি। বিশ্ব হিন্দু পরিষদকেও শক্তিপীঠ বানানো, ইত্যাদি কর্মসূচি প্রত্যাহার করতে হয়। কয়েকদিন পর পাকিস্তান যখন তার বোমা ফাটাল (ভারতের চেয়ে একটি বেশি) বিজেপির মতলবও চুপসে গেল। বিস্ফোরণের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী পর্যায়ে আমেরিকার সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে বিজেপি সুপরিকল্পিতভাবে চীন-বিরোধী ভাবাবেগ জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিল। কিন্তু হতাশ হয়ে তারা দেখল যে চীন ও আমেরিকা ভারতের বিরুদ্ধে যৌথ বিবৃতি দিচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভারত যথেষ্ট কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। কদিন আগে ভারত ও পাকিস্তান সম্পর্কে জার্মান বিদেশ মন্ত্রীর তির্যক মন্তব্য দেখলাম। তিনি বলেছেন, এই দুই দেশ যারা দেশের মানুষের জন্য খাদ্য ও পানীয় জলের ব্যবস্থা করতে পারে না এবং দেশে ভিক্ষার পাত্র নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, তারা আবার পারমাণবিক বোমা বানিয়েছে। ওরা ভেবেছিল যে বোমা তাদের ভাবমূর্তিকে বাড়িয়ে তুলবে, কিন্তু বিপরীতটাই ঘটেছে। তারা দুনিয়ার উপহাসের পাত্র হয়েছে।

মধ্যবিত্তের উপর বিজেপির ভালো প্রভাব আছে। কিন্তু বোমার বিরুদ্ধে প্রচারে নামতে গিয়ে আমরা এক পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। জনগণ নিজের থেকেই এই ধরনের প্রাসঙ্গিক প্রশ্নগুলি তুলছেন যে আমাদের প্রতিবেশীদের সঙ্গে এইভাবে লাগাতার বিবাদ বাধিয়ে কি আমরা বাঁচতে পারব। তাঁরা অভূতপূর্ব মূল্যবৃদ্ধির জন্য বোমা বিস্ফোরণকেই দায়ী করছেন এবং বিজেপির জনপ্রিয়তার রেখাচিত্রও খুব দ্রুত নীচে নামছে। এই দিক থেকেই আমি বলেছি যে বিজেপির আশু লক্ষ্য ব্যর্থ হয়েছে এবং তারা রক্ষণাত্মক অবস্থানে চলে গেছে।

কিন্তু পারমাণবিক পরীক্ষার সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য ও তাৎপর্য রয়েছে যাকে তার যথার্থ পরিপ্রেক্ষিতে বুঝতে হবে। তাদের সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য হচ্ছে অর্থনীতির সামরিকীকরণ। আণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারপার্সন আর চিদাম্বরম বলেছেন যে, ভারতকে এক সামরিক-শিল্পীয় কাঠামোর বিকাশ ঘটাতে হবে। একবার এটি গড়ে তুলতে পারলে তা শুধু প্রতিরক্ষাই নয় বরং অর্থনৈতিক বিকাশেরও নতুন রণনীতি হয়ে উঠবে। এই লক্ষ্যে ইতিমধ্যেই তারা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে শুরু করেছে। আমেরিকা ও ইজরায়েলও এ পথ গ্রহণ করতে শুরু করেছে, এটিই হবে ভারতেরও পথ। ভারতীয় শিল্প এখন মন্দার কবলে, আর তাই শিল্পপতিরা প্রতিরক্ষা শিল্পে ঢুকতে চায় এবং এইভাবে শিল্পকে চাঙ্গা করতে চায়! এটিই হচ্ছে সমগ্র পরিকল্পনার সবচেয়ে বিপদজনক দিক। এর অর্থ হল বাজেটের এক বড় অর্থই সামরিকীকরণের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হবে, ব্যক্তি পুঁজির সঙ্গে প্রতিরক্ষার যোগাযোগ ঘনিষ্ঠ হবে এবং এরই উপজাত হিসাবে নাগরিক জীবনই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। রাষ্ট্রের কাছে নাগরিক জীবনের উন্নয়ন এখন আর প্রাথমিক লক্ষ্য থাকবে না; এখন অগ্রাধিকার দেওয়া হবে শিল্পীয়-সামরিক কাঠামো গড়ে তোলার উপর : সেনাবাহিনীর জন্য শিল্প, অস্ত্রশস্ত্রের জন্য শিল্প। সামরিক আমলা, বৈজ্ঞানিক আমলা এবং ব্যক্তিপুঁজির আঁতাত – এক নতুন শ্রেণী-আঁতাত ভারতীয় শিল্প ও অর্থনীতিকে এক সম্পূর্ণ নতুন অভিমুখে নিয়ে যেতে চাইবে।

বামপন্থীদের দায়িত্ব হল বোমার বিরোধিতা করা ছাড়াও এই শ্রেণী অন্তর্বস্তুকে উন্মোচিত করা। বোমার বিরোধিতা করার জন্য অন্যান্যদের সঙ্গে তাঁদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। কিন্তু বোমার পিছনের এই রাজনীতি সম্পর্কে, বিজেপি সরকারের এই সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য সম্পর্কে জনগণকে শিক্ষিত করার দায়িত্ব কেবলমাত্র বামপন্থীদেরই। পরমাণু বোমা বিরোধী আন্দোলনকে এই ভিত্তিতেই ঐক্যবদ্ধ করার জন্য তাদের কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।