(লোকযুদ্ধ পত্রিকার সম্পাদক রামজী রায় কর্তৃক গৃহীত সাক্ষাৎকার। লিবারেশন, জুন ১৯৯৬ থেকে)

বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?

বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেক অতিকথাকেই চূর্ণ করেছে। ক্ষমতার কাড়াকাড়িতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা কব্জা করতে গিয়ে বিজেপি তার পরিচিতির বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ইস্যুগুলিকে সরিয়ে রাখে। অপরদিকে যে দ্রুততার সাথে এবং অবলীলায় জনতা দল ও বামেরা নরসীমা রাও-এর কংগ্রেস ও তার অর্থনৈতিক সংস্কারের দিশার সঙ্গে তাল মিলিয়েছে, তা অনেকের কাছেই অপ্রত্যাশিত ছিল।

একক বৃহত্তম দল হিসাবে বিজেপির আবির্ভাব এবং মধ্যপন্থী, বামপন্থী, আঞ্চলিক দলগুলি ও কংগ্রেসের মধ্যে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা ও অর্থনৈতিক সংস্কার’-এর স্বার্থে এক সাধারণ বোঝাপড়া গড়ে ওঠাটা ভারতীয় রাজনীতিতে এক নতুন সন্ধিক্ষণকে চিহ্নিত করছে। এই সন্ধিক্ষণে সামাজিক ন্যায়ের বিষয়টিকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে এবং তৃতীয় শক্তিকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে হবে।

সংসদীয় নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলই সরকার গড়ার রায় সুনির্দিষ্টভাবে পায়নি, এটা কি শাসক শ্রেণীগুলির কোনো সংকট বা তাদের গণতান্ত্রিক শক্তির কোনো সংকটকে চিহ্নিত করে? আর তা যদি করে থাকে তবে এই সংকটের কারণ কী?

আমরা কমিউনিস্টরা সব সময়ই হিন্দুত্বকে মূল যোগসূত্র ধরে গড়ে ওঠা বিজেপির জাতীয়তাবাদের বিপরীতে ভারতের বহুজাতিক, বহু ভাষাভাষী আর সেই কারণে বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের কথা বলে থাকি। আদ্যিকালের ব্রাহ্মণ্যবাদী মূল্যবোধের বিপরীতে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা, গণতন্ত্র ও আধুনিক রাষ্ট্রের প্রগতিশীল মতাদর্শের ওপর ভিত্তি করেই জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। এক নরম ভাবমূর্তিকে সামনে এনেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভে বিজেপির এই ব্যর্থতা এবং বর্তমানে ভারতীয় সংসদের বিন্যাস, ভারতীয় সমাজ সম্পর্কে আমাদের উপলব্ধিকেই সঠিক প্রতিপন্ন করে।

একটি সংকট অবশ্যই দেখা যাচ্ছে। কংগ্রেসের ক্ষয়ের পর কেন্দ্রীভূত অন্য সর্বভারতীয় রাজনৈতিক সংগঠনটির সীমাবদ্ধতাও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। ভারতীয় সমাজ একটি ‘মহাসংঘ’ হতেই পারে, কিন্তু তাকে একটি স্থায়ী রাজনৈতিক জোটে রূপান্তরিত করাটা অত্যন্ত কঠিন কাজ, বিশেষত তার কেন্দ্রে যখন কোনো শক্তিশালী নিউক্লিয়াস নেই।

দ্বৈত চরিত্রের এই সমস্যাটির সমাধানকল্পে পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রক্রিয়া চলতেই থাকবে এবং এটাও দেখার বিষয় যে কতদিন এবং কতটা দূর পর্যন্ত সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানগুলি এটাকে সহ্য করবে।

রাজনৈতিক ভাষ্যকারেরা এবং অধিকাংশ বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলি এই পরিস্থিতিকে এক নতুন যুগের সূচনা হিসাবেই দেখছেন, যেখানে জোট সরকারগুলিরই প্রাধান্য থাকবে এবং তারা এই পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে তাদের কৌশলগুলিকেও সাজিয়ে নিচ্ছে। এটার থেকে আপনার কি মনে হয় না যে জোট সরকারের এক দীর্ঘ পর্যায়ের মধ্য দিয়েই ভারতবর্ষ এগোবে?

১৯৭৭ এবং ১৯৮৯ সালেও জোট সরকারের পর্যায়ের কথা উঠেছিল, কিন্তু সেগুলি অল্প কিছুদিনই স্থায়ী হয়েছিল। এবারে জোট সরকারে দলের সংখ্যা অনেক বেশি, কিন্তু তাদের মধ্যে সবথেকে বড় শরিকটির আসন সংখ্যা মাত্র ৪২। বিজেপি এবং কংগ্রেসই হল যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় বৃহত্তম দল, কিন্তু পরিস্থিতির এমনই পরিহাস, এই দুই দলই রয়েছে সরকারের বাইরে। প্রথমটি বিরোধীপক্ষ হিসাবে এবং দ্বিতীয়টি বাইরে থেকে সরকারের সমর্থক হিসাবে। দুটি দলই যুক্তমোর্চার মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও ভাঙ্গনগুলিকে নিজেদের অনুকূলে কাজে লাগানোর কৌশল নিচ্ছে। কাজেই এই জোট সরকারের পরীক্ষা-নিরীক্ষাই যে ভবিষ্যতের সাধারণ দিশা নির্ধারণ করবে সেই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার সময় এখনও আসেনি।

সিপিআই(এম) জোট সরকারে অংশগ্রহণ না করায় সিপিআই(এমএল) তাকে অভিনন্দিত করেছে। এটা সিপিআই(এম)-এর কাছে নতুন কিছু নয়। তারা পুরোনো নীতিকেই অনুসরণ করেছে মাত্র। কাজেই অভিনন্দিত করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল কেন? এর মধ্যে কি নতুন কোনো পরিপ্রেক্ষিত রয়েছে? তা যদি হয় তবে সেটা কী?

সরকারে অংশগ্রহণ করার চাপ এবার সিপিআই(এম)-এর ওপর অনেক বেশি ছিল, আর এটাও সবাই জানে যে নেতৃত্বের একটি অংশ সরকারে অংশগ্রহণ করার ব্যাপারে মনস্থির করেই ফেলেছিলেন। এই পরিস্থিতিতে পার্টি কর্মসূচির পক্ষে দাঁড়ানোর ব্যাপারে কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্তটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক স্তরে, সরলরেখা টানলে ‘ধর্মনিরপেক্ষ বিকল্পের’ যুক্তিসঙ্গত পরিণতি সরকারে যোগদান ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না। এইরকমই অজুহাত দেখিয়ে অতীতে সিপিআই এমনকি কংগ্রেসী সরকারেও যোগদান করে। সিপিআই(এম)-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত স্রোতে গা ভাসানোর বিরুদ্ধে একটা ব্রেক হিসাবে কাজ করেছে। আপনি হয়তো লক্ষ্য করে থাকবেন যে সিপিআই এই সিদ্ধান্তকে দুর্ভাগ্যজনক বলেছে আর আমরা এটাকে স্বাগত জানিয়েছি।

কিন্তু এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর অনেক প্রশ্নই উঠে আসছে, যেগুলি সম্পর্কে সিপিআই(এম)-কে তার অবস্থান পরিষ্কারভাবে জানাতে হবে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, এর আগের বার জাতীয় মোর্চার সঙ্গে এক বোঝাপড়ায় পৌঁছনোর পরও বামফ্রন্ট তার স্বাধীন পরিচিতি বজায় রেখেছিল, কিন্তু এবার সিপিআই(এম) ও অন্যান্য বাম দলগুলি যুক্তফ্রন্টের শরিক হয়েছে। আর এটি যেহেতু যুক্তফ্রন্টেরই সরকার, তাই সরকারে অংশগ্রহণ না করেও সরকারের ভুলত্রুটিগুলির সমান দায়ভার তারও থেকে যাবে। সিপিআই-এর সরকারে অংশগ্রহণ এক ঐক্যবদ্ধ ব্লক হিসাবে বামফ্রন্টের অস্তিত্বকেই আঘাত করেছে। তাছাড়াও, দেবগৌড়া নরসীমা রাও-এর অর্থনৈতিক নীতির একনিষ্ঠ সমর্থক। একেবারে শুরু থেকেই কংগ্রেস অর্থনৈতিক নীতিকে অব্যাহত রাখার বিষয়টিকে তার সমর্থনের প্রধান শর্ত করে তুলেছে। দেবগৌড়া ও চিদাম্বরমের যথাক্রমে প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী হওয়াটা কংগ্রেসের শর্তের কাছে আত্মসমর্পণের নামান্তর। পরিহাসের বিষয় হল যে, সরকারে বাইরে থাকলেও কংগ্রেসই সরকারের কলকাঠি নাড়ছে, আর যুক্তফ্রন্টের শরিক হওয়া সত্ত্বেও সিপিআই(এম) সরকারের দিশা নির্ধারণে অক্ষম।

সিপিআই(এম)-এর অবস্থানের এই অসঙ্গতিই সরকারে অংশগ্রহণ সম্পর্কে তার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য বাইরে থেকে তার ওপর চাপকে বাড়িয়ে তুলছে এবং অন্যদিকে দলের অভ্যন্তরে বাইরে থেকে সরকারকে সমালোচনামূলক সমর্থন যোগানোর বিষয়টিও জোরালো হচ্ছে। কংগ্রেস ও বিজেপি থেকে দূরত্ব রক্ষাকারী সিপিআই(এম)-এর ঐ ধরনের যে কোনো সিদ্ধান্তকেই আমরা স্বাগত জানাব।

এই প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল এবারও সিপিআই(এমএল) কোনো যুক্তফ্রন্টে যোগ দিতে পারেনি। এটা কী পার্টির যুক্তফ্রন্ট নীতির ব্যর্থতা বা ঘাটতিকে দেখিয়ে দেয়, নাকি পরিস্থিতির বিকাশই ঘটেছে তার নীতির সঙ্গে সঙ্গতিহীনভাবে? যুক্তফ্রন্টের নীতির বিষয়ে পুনর্বিবেচনার প্রয়োজনীয়তা আছে বলে কি মনে করেন?

এখনও পর্যন্ত যে স্তরে আমরা কাজ করছি তার মূল অভিঘাতই থাকছে আমাদের শক্তিবৃদ্ধির ওপর। সামাজিক স্তরে, জনগণের বিভিন্ন শ্রেণী ও অংশের সাথে যুক্তমোর্চা গড়ে তোলার প্রয়াস আমরা চালাচ্ছি। এটি একটি দীর্ঘকালীন প্রক্রিয়া এবং এর কোনো বিকল্প নেই।

জাতীয় স্তরে সব সময়েই আমরা কংগ্রেস-বিরোধী ও বিজেপি-বিরোধী তৃতীয় শক্তির শিবিরের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করেছি এবং যৌথ কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করেছি। কিন্তু সাংগঠনিক স্তরে কোনো মোর্চার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধলে তা বিভিন্ন রাজ্যে আমাদের উদ্যোগকে ভোঁতা করে দেবে এবং পার্টির পক্ষে তা আত্মহত্যার সামিল হয়েও দেখা দিতে পারে। এ সত্ত্বেও আমাদের শত্রুদের মধ্যকার ও তাদের অভ্যন্তরস্থ যে কোনো বিভেদকেই নিজেদের অনুকূলে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে নেওয়ার কৌশলের বিকাশ ঘটানোর চেষ্টা আমরা সব সময়েই চালিয়ে যাচ্ছি এবং এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার অবকাশ অবশ্যই রয়েছে।

কোনো বামশক্তি বা মধ্যপন্থী কোনো শক্তির সঙ্গে ফ্রন্ট গড়া যায়নি। সামাজিক ভিত্তির দিক থেকেও মধ্যবর্তী জাত বা মধ্যবর্তী শ্রেণীর কোনো অংশের সাথে কোনো ফ্রন্ট গড়াও সম্ভব হয়নি। এটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন? এ সম্পর্কে আপনাদের ভবিষ্যৎ কৌশল কী?
মধ্যবর্তী জাত ও মধ্যবর্তী শ্রেণীর কিছু অংশের সমর্থন আমরা অবশ্যই পেয়েছি। তা যদি না হত তবে বিহারে তিনটি আসনে আমাদের অগ্রগতি – যে তিনটি আসনের প্রত্যেকটিতে আমরা লক্ষাধিক ভোট পেয়েছি – তা সম্ভব হত না। এই নির্বাচনে আমরা আমাদের শ্রেণীভিত্তিকে শক্তিশালী করার ওপরই জোর দিয়েছিলাম। আমাদের সমর্থনভিত্তিতে জনতা দল ঢুকে পড়ছিল, সেই পরিপ্রেক্ষিতে এটা জরুরি ছিল।

জনতা দল ধাক্কা খাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে মধ্যবর্তী জাতগুলির মধ্যে আমাদের প্রভাব বাড়ানোর মতো অনুকূল পরিস্থিতি অবশ্যই সৃষ্টি হয়েছে এবং সুপরিকল্পিতভাবে এই কাজ হাতে তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত আমরা গ্রহণ করেছি।

বর্তমান পরিস্থিতি বামফ্রন্টের কাছ থেকে কী ভূমিকা দাবি করছে? বাম শক্তিগুলি কি এই দিশায় ঐক্যবদ্ধভাবে অগ্রসর হতে পারবে?

বাম নেতৃবৃন্দকে মধ্যপন্থী শক্তিগুলি ও কংগ্রেসের মধ্যে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা ত্যাগ করতে হবে এবং সাম্প্রদায়িকতা ও বিদেশী পুঁজি-নির্ভর অর্থনৈতিক বিকাশের বিরোধিতা করতে হবে। সংসদে যুক্তফ্রন্টের থেকে স্বতন্ত্র পরিচিতি বজায় রেখে বাম বিরোধীপক্ষের ভূমিকা পালন করতে হবে। বামপন্থী ক্যাডারাও এটা চান। তবে বাম শক্তিগুলির নেতৃবৃন্দ ঐক্যবদ্ধভাবে এই দিশায় অগ্রসর হতে পারবে কিনা ভবিষ্যতই তা বলতে পারে।